এবার নারী জঙ্গি!

.
.

নারীদের জঙ্গি কিংবা যোদ্ধা হওয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস বা আইসিসে দুটি মত আছে। একটি মত হলো শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁদের যেকোনো কাজে ব্যবহার। অপর মতটি হলো নারীদের আর যা-ই করা হোক, যোদ্ধা করা যাবে না। কেননা, নারী যোদ্ধার হাতে কেউ নিহত হলে তিনি বেহেশতে যেতে পারবেন না।
ধর্মের নামধারী আইএস নারীদের কী চোখে দেখে, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। তারা নারীদের কোনো সম্মান বা মর্যাদা দেয় না; বরং কখনো মানবঢাল হিসেবে, কখনো যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। আইএস থেকে যেসব নারী পালিয়ে এসেছেন, তাঁরা যেসব বিবৃতি বা জবানবন্দি দিয়েছেন, তা পড়লে গা শিউরে ওঠে। ধর্মের নামে মানুষ এত বড় অধর্মের কাজ করতে পারে!
আমাদের আলোচনার বিষয় মধ্যপ্রাচ্য বা আইএস নয়, বাংলাদেশ। প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা চললেও এ কাজে নারীদের ব্যবহার অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। এর আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম, বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বেশ কয়েকজন নারী মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছেন আইএসএ যোগ দিতে। তবে এই সংখ্যা ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে যোগদানকারী নারীদের তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া নারীদের কেউ কেউ সেখানে মারাও পড়েছেন বলে জানা যায়। সম্প্রতি এক চিকিৎসক সপরিবারে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। সেই চিকিৎসকরে সঙ্গে তাঁর স্ত্রী, পুত্রবধূও গিয়েছেন। কিন্তু এই নারীদের কেউ স্বেচ্ছায় গিয়েছেন, তা ভাবার কারণ নেই। তাঁরা যখন বিয়ে করেন, তাঁদের স্বামীরা কেউ জঙ্গি ছিলেন না। বরং পরবর্তীকালে পুরুষ জঙ্গিদের পাল্লায় পড়েই তাঁদের কেউ কেউ জঙ্গি হয়েছেন বা হতে বাধ্য হয়েছেন।
গত শনিবার রাজধানীর আজিমপুরে অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশের ওপর নারী জঙ্গিরা ছুরি মেরে, বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ও মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে তাদের রুখতে চেষ্টা করেন বলে পুলিশের বরাত দিয়ে পত্রিকার খবরে বলা হয়। পুলিশের কাছে খবর ছিল, সেখানে মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলাসহ কয়েকজন জঙ্গি আছেন। কিন্তু অভিযান শুরুর আগেই জেবুন্নাহার পালিয়ে যান। অভিযানে তাঁর সন্তান ও আহত অবস্থায় তিন নারী ধরা পড়েন।
শনিবার সন্ধ্যায় পুলিশ অভিযান চালালে প্রথমে বাসায় অবস্থানকারী নারী-পুরুষ তাঁদের ওপর চড়াও হন। এরপর পুলিশের আরও কয়েকটি ইউনিট সেখানে হামলা চালালে জঙ্গিরা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকের ভাষ্য অনুযায়ী নিহত আবদুল করিম আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। পুলিশের অভিযানের সময় আহত তিন নারীর মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁর নাম খাদিজা। তাঁর মাথার পেছনে ধারালো অস্ত্রের কোপ আছে। অপর দুই নারী শারমিন ও শাহেলার অবস্থা স্থিতিশীল। শারমিনের পেটে ও হাতে গুলি ঢুকেছিল। অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করা হয়েছে। তাঁরা সবাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। পুলিশ বলছে, নিহত ব্যক্তি এবং এই তিন নারী নব্য জেএমবির সদস্য। তাদের ধারণা, ওই বাসায় জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহারও (শিলা) ছিলেন। বিপদ আঁচ করতে পেরে তিনি এক বছরের সন্তানকে নিয়ে কেটে পড়েছেন।
নিহত জঙ্গির আঙুলের ছাপ নিয়ে তা জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে, তাঁর নাম শমসেদ। বাবার নাম মোসলেহ উদ্দীন। বাড়ি রাজশাহীর বোয়ালিয়া উপজেলার মেহেরচণ্ডী গ্রামে। তাঁর সাংগঠনিক নাম আবদুল করিম। আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হওয়া শাহেলা তাঁর স্ত্রী। অভিযানের সময় স্বামীর মতো শাহেলাও নিজেকে নিজে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছেন। ওই বাসা থেকে উদ্ধার করা তিনটি শিশুর মধ্যে ১৩-১৪ বছরের ছেলেটি এই দম্পতির যমজ সন্তানের একটি।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ বলেছে, পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বাসার বাসিন্দারা দরজা খুলে তাঁদের ওপর হামলা চালান। তাঁরা দুই পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে আহত করেন। হামলাকারীদের মধ্যে একজন নারী ছোরা হাতে পালানোর চেষ্টা করেন। একদল পুলিশ ওই নারীর পিছু নেয়। পুলিশের অন্য সদস্যরা ওই বাসার ভেতর অভিযান অব্যাহত রাখেন। এ সময় পুলিশের গুলিতে আবদুল করিম নিহত হন। বাসায় থাকা অপর দুই নারী সদস্য ছুরি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
এর আগে জঙ্গি আস্তানায় নারী সদস্যের সন্ধান পাওয়া গেলেও তাঁদের কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছেন, সে রকম কোনো তথ্য নেই। সে ক্ষেত্রে এটি বাংলাদেশে জঙ্গি হানার নতুন মাত্রা। আগে পুরুষ জঙ্গিরা পরিবার থেকে আলাদা হয়ে জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিতেন, বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এখনো পরিবারের নারী সদস্যদেরও এতে যুক্ত করছে। অর্থাৎ সমাজে তাঁরা ভালোভাবেই শিকড় গাড়ার চেষ্টা করছেন। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, জঙ্গিদের কোনো সামাজিক ভিত্তি বা সমর্থন নেই। সাধারণ মানুষও তা-ই মনে করতেন। কিন্তু জঙ্গিরা যেভাবে গোটা পরিবারকে জঙ্গিবাদে দীক্ষিত করছেন, এখন নতুন করে সবকিছু ভাবা দরকার।
এর আগে গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় একটি বাড়ির তিনতলার একটি ফ্ল্যাটে অভিযানে কানাডাপ্রবাসী তামিম চৌধুরী ও তাঁর দুই সহযোগী নিহত হন। গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নয়জন নিহত হন। সেখানে আহত অবস্থায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও কোনো নারী জঙ্গির হদিস পাওয়া যায়নি।
এর আগে বিএনপি আমলে শায়খ আবদুর রহমান ও ছিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ যেসব জঙ্গি ধরা পড়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকলেও নারীদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, এমন প্রমাণ নেই। হতে পারে তাঁদের সামাজিক অবস্থান ও পড়াশোনা কম থাকার কারণে সেটি করতে তাঁরা সাহস পাননি। কিন্তু এখন সচ্ছল পরিবারের উচ্চশিক্ষিত লোকজন জঙ্গি হয়ে উঠছেন এবং স্ত্রী ও সন্তানদেরও জঙ্গিবাদের তালিম দিচ্ছেন। ভয়টা এখানেই।
এ অবস্থায় কেবল ঝটিকা অভিযান চালিয়ে চিহ্নিত কয়েকজন জঙ্গিকে হত্যা করলেই সমস্যার সমাধান হবে না, তাঁদের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান চিহ্নিত করে শিকড় উপড়ে ফেলার কাজেই মনোনিবেশ করতে হবে।