জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সংস্কৃতি

একটা সত্য ঘটনা দিয়ে শুরু করি। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রাম চলছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট তখন দ্য গল। স্বৈরাচারের ভাষায় তিনি বলছেন, ‘আমিই ফ্রান্স।’ সে সময় উপর্যুপরি আক্রমণে ফরাসি সৈনিকেরা দিশেহারা। একই সময়ে জাঁ-পল সাত্রেঁ ফরাসি সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় দাঁড়িয়ে লিফলেট বিতরণ করছেন। কিন্তু ফরাসি পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে সাহস পাচ্ছে না। জায়গাটা ঘিরে রেখেছে মাত্র। পুলিশের মন্ত্রী এবার স্বয়ং দ্য গলের অফিসে গিয়ে উপস্থিত। ঘটনার বিবরণ শুনে ক্রুদ্ধ দ্য গল বলে ফেললেন, তাঁকে এক্ষুনি গ্রেপ্তার করো। মন্ত্রী একটু দ্বিধা করেই বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ করে দ্য গল ক্রুদ্ধ স্বরেই বলে উঠলেন, ‘না না, গ্রেপ্তার কোরো না, তিনিও ফ্রান্স।’
এবার সরকার বেশ নড়েচড়ে বসেছে এবং সর্বত্রই উচ্চারিত হচ্ছে, সংস্কৃতিই পারে জঙ্গিবাদ ঠেকাতে। এ ক্ষেত্রে দফায় দফায় সভা করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে কিছু দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। সে দায়িত্ব পালনে মন্ত্রণালয় মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে। মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে শিল্পকলা একাডেমিকে দিয়ে স্কুল–কলেজে কিছু নাটক, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বা শিক্ষা সপ্তাহ পালন করবে। কিন্তু তাতে জঙ্গিবাদ কতটা রহিত হবে?
আসলে প্রয়োজন ছিল যা, তা কোনো সরকারই কর্ণপাত করেনি। শিক্ষার অংশ হিসেবে সংস্কৃতিচর্চাকে যুক্ত করার কথা আমরা বহুবার বলেছি। নাটকে যে লোকশিক্ষা হয়, কোনো সরকার কখনো বোঝেনি। একেবারে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে যদি চিত্রাঙ্কন, সংগীত, আবৃত্তি, নাটক—এসবকে যুক্ত করা যেত, তাহলে শিশুকাল থেকেই জীবনাচরণে তার প্রতিফলন দেখা যেত। শিল্পকলা তো পরের কথা। আগে একটা মানসভূমি নির্মাণ করা দরকার। শিশুটি বড় হয়ে হয়তো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা, পুলিশ, সেনা অফিসার যা-ই হোক না কেন; যদি তার মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক মন ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়, তাহলে কোনো রকম অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না।
আজকের দিনে লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মধ্যে স্বশিক্ষিত শিল্পী হওয়া সম্ভব নয়। এমনভাবে সব জাগতিক পরিবর্তন
হয়ে গেছে, যেখানে মানুষ বাধ্য হয়ে বিদ্যালয়েই আশ্রয় নেয়। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের সেই তপোবন শিক্ষার প্রচেষ্টা
ব্যর্থই হয়ে গেছে। বিশ্বভারতী এখন কোনো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় নয়। শিক্ষার সঙ্গে শিল্পের যোগসূত্র স্থাপিত না হওয়ার কারণে ছাত্ররা শুধু শিখছে কীভাবে নম্বর বেশি পাওয়া যায়। বড় হয়ে অর্থ উপার্জনই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। পাঠক্রমে নতুন প্রথা চালু হওয়ায় ছাত্ররা শুধু সৃজনহীন হয়ে পড়ছে তা নয়, প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিতও হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইংরেজি স্কুলের শিক্ষা তো একেবারেই জীবন বিচ্ছিন্ন শুধু নয়, শিল্প-সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন। জাতীয় সংস্কৃতি থেকে বহু মাইল দূরে তাদের বসবাস।

>জঙ্গিবাদ কিন্তু একা নয়, তার সঙ্গে সন্ত্রাস আছে, দুর্নীতি আছে এবং অসহিষ্ণুতা আছে। এসব মোকাবিলা করার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করাই হবে সরকারের কাজ

পাকিস্তান আমলে আমাদের একটা প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের সংস্কৃতি ছিল, যাতে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার একটা বড় সংগ্রাম করতে হয়েছে। স্বাধীন হওয়ার পর আমরা সেই সংগ্রামকে ভুলে গিয়ে আমাদের পাঠ্যতালিকায় সংস্কৃতির বিষয়টি উহ্য রেখেছিলাম। সেনা শাসনের ১৫ বছরে একটা উল্টো পথে চলতে শুরু করল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। তারপরও চারদলীয় সরকারের আমলে সেই পাকিস্তান আবার মাঝেমধ্যেই ঘাড়ে চড়ে বসেছে। কিন্তু সংস্কৃতিবান্ধব এই সরকারও কি বিষয়টায় কোনো গভীর মনোযোগ দিয়েছে?
শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় লগ্নির ফলাফল মিলতে সময় লাগে। সংস্কৃতিচর্চার ফলাফল আরও সুদূরপ্রসারী। কিন্তু আমাদের তো একটা সংস্কৃতি ছিল, তাকে লালন করার জন্য উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থাটি থাকলেই হতো।
জাপানে একটা কথা চালু আছে—সব সভ্য জাতি সংস্কৃতিবান নয়। তারা সভ্য কাপড়চোপড়ে, প্রযুক্তিতে; কিন্তু তাদের কোনো সাংস্কৃতিক ইতিহাস নেই, আছে যুদ্ধবিগ্রহের, দখলদারত্বের ইতিহাস। এই তথাকথিত সভ্যতার সংকটে আমরাও নিমজ্জিত। সভ্য মানুষ মানেই অর্থবিত্ত, প্রযুক্তি, বাড়ি, গাড়ি। যেহেতু সংস্কৃতিচর্চা আমাদের জীবনযাপনকে নিয়ন্ত্রণ করছে না, তাই শিক্ষার লক্ষ্য সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে অর্থ উপার্জনে, ভোগ-বিলাসে। আর এই সুযোগে বিজাতীয় অপসংস্কৃতি আমাদের এখানে স্থান করে নিচ্ছে।
কাজেই সংস্কৃতির কাজটি করতে হবে শিক্ষাকে দিয়ে। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নেই, আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থাকা মানেই নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটি এসে যায়। ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে সাধারণত কোনো মন্ত্রী থাকেন না। প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতে রাখেন এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের কাজটি করে থাকেন। অনুন্নত, পশ্চাৎপদ জাতিসমূহকে সাহায্য করেন। শিক্ষা সপ্তাহ হয়তো আবার চালু হবে, কিন্তু তা হবে প্রতিযোগিতামূলক। প্রতিযোগিতা শিশু-কিশোরদের মানসভূমিতে আঘাত করে। যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় এই প্রতিযোগিতা আকাঙ্ক্ষিত নয়। এর জন্য নতুন কোনো ভাবনা দরকার। বাংলাদেশে মানুষ বা সংস্কৃতিবান হওয়ার প্রক্রিয়ায় এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে পরিবার। বিশেষ করে অভিভাবকেরা। নিজেদের সন্তানকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়ার দুর্দমনীয় অভিলাষে তাঁরা শিশুমনে প্রচণ্ড চাপ দেন তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্র বানিয়ে ফেলেন। এই যন্ত্র প্রতিমুহূর্তের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে চারদিকের সমাজ বা মানুষকে দেখতে পায় না। কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় না। সবই যেন বৈরী।
এই বৈরী পরিবেশে যে শিশুর বিকাশ, সেই শিশু বড় হয়ে কী করবে? তার সামনে আমরা কোনো আদর্শও তুলে ধরতে পারছি না। টাকার ক্ষমতা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষমতা তার চোখে পড়ে না। অর্জন মানেই অর্থ উপার্জন, কোনো নতুন জ্ঞান, নতুন ভাবনা, অগ্রসর কোনো চিন্তা দিয়ে সমাজকে আলোড়িত করার মানসিকতা তার নেই। এসবের পেছনেও একটা সংস্কৃতি কাজ করে, সেটি হচ্ছে আত্মসর্বস্ব ভোগী সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সুস্থ সংস্কৃতির কথা যদি বলতে চাই, তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গোড়ার দিক থেকেই শুরু করতে হবে। সংস্কৃতি বলতে একটা ভুল ধারণা আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। নাটক, গান, নৃত্যকলা, কাব্যসাহিত্য, চিত্রকলা—এসবকেই আমাদের সংস্কৃতি বলে ভাবি। কিন্তু সংস্কৃতি আমাদের মানসভূমির নির্মাতা, জীবনাচরণের নির্দেশিকা, যার সহায়ক শিল্প-সাহিত্য।
শিক্ষার প্রচণ্ড চাপের মুখে শিশু-কিশোর-তরুণদের মধ্যে পাঠাভ্যাস একেবারেই কমে গেছে। কবিতা, উপন্যাস, গল্পের আত্মজীবনীর এবং দর্শনের পাঠক নেই। মননশীল চলচ্চিত্র, নাটক গানের সমঝদার নেই, আছে বিনোদনকামী দর্শক–শ্রোতা। এই দর্শক–শ্রোতাদের কীভাবে মননশীল করা যায়, তা-ও এক বড় সমস্যা আমাদের সামনে।
আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এ ধরনের দর্শক সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। ঈদের অনুষ্ঠানমালা তার একটা বড় উদাহরণ। শত শত নাটক নির্মিত হয়। উদ্দেশ্যহীন, সমাজচিন্তাহীন বিনোদন প্রচেষ্টা। চ্যানেল ও স্পনসররা চায় শুধু হাসির নাটক, বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন বিনোদন। তাই নিয়ে কী অস্থিরতা নির্মাতাদের! সঙ্গে অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলীদেরও। দু-চারজন নির্মাতা এর মধ্যে খেটেখুটে ভালো কিছু নাটক করলেও বিজ্ঞাপনের তোড়ে তা ভেসে যায়। এতে কিছু টাকাপয়সার আমদানি হয় বটে, কিন্তু পকেট ভারী হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের, যাদের মধ্যে ন্যূনতম সমাজচিন্তার লেশমাত্র নেই। এই মাধ্যমটি অবশ্যই বিনোদন মাধ্যম, কিন্তু শক্তিশালী গণমাধ্যমও বটে। তাই এখানে সরকার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুবই জরুরি ক্যাম্পাস। শান্তিনিকেতনের মতো তপোবন না হোক, অন্তত সবুজের একটু ছোঁয়া, খেলার একটা মাঠ, ফুলের গাছ—এসব তো থাকতে হবে। এসবের ভেতর ঘুরে বেড়ানোও তো একটা বিনোদন। এটা ভাবতেই অবাক লাগে লাখ লাখ জন–অধ্যুষিত গুলশান, বনানী, উত্তরায় একটা সিনেমা হল নেই, নাটকের মঞ্চ নেই, লাইব্রেরি, জাদুঘর নেই এমনকি বইয়ের দোকানও নেই।
পাঠাগারকেন্দ্রিক একটা আন্দোলনও তো হতে পারে। এই সময়ে দেশের সর্বত্র লাইব্রেরি স্থাপনের কথাও ভাবা যেতে পারে। আর বেশ কিছুদিন ধরে যে পেশাভিত্তিক নাট্যচর্চার কথা বলে আসছি, তারও বাস্তবায়ন হওয়া উচিত নয় শুধু, জরুরি। মননশীল অভিনয়, আবৃত্তি ও সংগীতশিল্পীরা যাতে রাষ্ট্রের অর্থে চর্চা চালিয়ে যেতে পারেন, তারও একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বহু বছর ধরে নাট্যদলগুলোকে স্যালারি গ্রান্ট, ফেস্টিভ্যাল গ্রান্ট দিয়ে আসছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে সম্মতি দিলেও দীর্ঘদিন ধরে তা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। আমরা আনন্দিত যে শিল্পের বিভিন্ন শাখাকে সক্রিয় করে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত করার ভাবনা এসেছে। জঙ্গিবাদ কিন্তু একা নয়, তার সঙ্গে সন্ত্রাস আছে, দুর্নীতি আছে এবং অসহিষ্ণুতা আছে। এসব মোকাবিলা করার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করাই হবে সরকারের কাজ। মনে রাখতে হবে, যে দেশ তার কবি, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, সাহিত্যিক, দার্শনিকদের সম্মান করে না, সে দেশ দুর্ভাগা। কারণ এঁরা প্রতিদিন জন্মান না। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন কবি-শিল্পীরা জন্মায়, তৈরি করা যায় না।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।