স্পিভাকের টেলিগ্রামে জামায়াত দায়ী

বুদ্ধিজীবী হত্যা
বুদ্ধিজীবী হত্যা

জামায়াতের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ আছে। এটা সংগ্রহে বাংলাদেশ সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি সম্পর্কে ডেইলি স্টার প্রতিবেদন দেখে এটা মনে পড়েছে সর্বাগ্রে। ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি হলে নির্বাচনে বিচ্যুতি ঘটবে’ বলে কেরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোনে উল্লেখ করেছেন বলে ১২ ডিসেম্বর ডেইলি স্টার-এ খবর বেরোয়। কেরির ওই ফোনসূত্রে সৈয়দ বদরুল আহসানের একটি সংবাদ ভাষ্যও ওই দিন ছাপা হয়।
১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল। সিনেট কমিটিতে কেরির দেওয়া একটি ঐতিহাসিক জবানবন্দি তাঁকে রাতারাতি সেলিব্রিটিতে পরিণত করেছিল। ‘...তাঁরা ধর্ষণ করেছে, কান কেটেছে। মাথা কেটেছে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটেছে। নিরীহ লোকের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। ধ্বংস করেছে গ্রামের পর গ্রাম, যা চেঙ্গিস খানের বর্বরতাকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।’ মনে হচ্ছে কেরি যেন বাংলাদেশেরই চিত্র এঁকেছিলেন। টেড কেনেডির মতো কেরি একাত্তরের বাংলাদেশে এলে চিত্রটা একই আঁকতেন। ভিয়েতনাম ফেরত কেরি ওই বর্ণনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘এসব অপরাধ সংঘটনের হোতা আমরাই।’ পরদিন নিক্সন-কিসিঞ্জার-বব হ্যাল্ডেম্যান জরুরি বৈঠকে বসেন। আর দায়সারাভাবে কেরি ‘বিরাট একটা কাজ করেছেন বটে’ বলে তাঁরা মেনেও নেন। কেরির মধ্যে তাঁরা কেনেডির ছায়া দেখেন। একাত্তরের বাংলাদেশ যুদ্ধ সম্পর্কে কেরির ব্যক্তিগত মনোভাব কী ছিল, তা জানতে পারিনি। তাঁর সাক্ষাৎ চেয়ে ওয়াশিংটনে সিনেটর কেরির দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তাঁর একজন সহকারী প্রাথমিক সাড়াও দিয়েছিলেন। কিন্তু সময়াভাবে আমাকেই হাল ছাড়তে হয়।

বৃহস্পতিবারেই ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ক্যালি ম্যাককার্থির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, স্টারের ওই খবরের সত্যতা কী? কেরি মোল্লার ফাঁসির বিষয়ে হাসিনাকে ঠিক কী কথা বলেছিলেন? শুক্রবার ম্যাককার্থি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করতে পারি যে, সেক্রেটারি কেরি বাংলাদেশের ‘‘চলতি ঘটনাবলি’’ নিয়ে আলোচনা করেছেন।’ আপনার উত্তর দ্ব্যর্থবোধক। ওই তথ্যের সত্যতা আপনি সরাসরি নাকচ করলেন না তো? এর উত্তরে ক্যালি বলেন: ‘অন্যের রিপোর্টের ওপর আমরা মন্তব্য করি না।’ তিনি অবশ্য ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মেরি হার্ফের বরাত দেন। হার্ফ ১২ ডিসেম্বরে মোল্লার ফাঁসিসংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘বাংলাদেশের এটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর মুহূর্ত।’ কিন্তু ওই ব্রিফিংয়ে কেরি হাসিনাকে মোল্লার বিষয়ে কিছু বলেছিলেন কি না, তার কোনো উল্লেখ নেই। তবে যুদ্ধবিরোধী জন কেরির প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকা বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দলিলগুলো, বিশেষ করে স্পিভাকের তারবার্তাগুলো উদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা কেন, সেটা আজ ব্যাখ্যা করতে চাই। বিশ্বাস করি, কেরি এ বিষয়ে যথা সহযোগিতা দেবেন।

হার্বাট ড্যানিয়েল স্পিভাক ছিলেন বাংলাদেশে প্রথম ভারপ্রাপ্ত মার্কিন মিশনপ্রধান। ২০০৪ সালে তিনি মারা গেছেন।

‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ খ্যাত অর্চার ব্লাডকে আমরা চিনি। কিন্তু স্পিভাককে সেভাবে চিনি না। কিসিঞ্জার ব্লাডকে শাস্তিমূলক বদলি করে স্পিভাককে কনসাল জেনারেল করেছিলেন। স্পিভাক কিন্তু ব্লাডের ঐতিহাসিক টেলিগ্রামে সই করেননি। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাবেক রিপোর্টার ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক অধ্যাপক গ্যারি জে. বাসের নতুন বই দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম নিক্সন, কিসিঞ্জার, অ্যান্ড এ ফরগটেন জেনোসাইড সম্প্রতি বেরিয়েছে। এতে তিনি স্পিভাককে একটু খাটোই করেছেন। আমি তাঁর সঙ্গে একমত হতে অপরাগ। ব্লাডের মতো অতটা সাহসী না হলেও তাঁর ভীরুতার পরিচয় আমি পাইনি। গ্যারি দেখিয়েছেন, স্পিভাক ব্লাড টেলিগ্রামে সই দেননি। ঢাকার উন্নয়নকর্মী অ্যারিক গ্রাফেলের মতে, স্পিভাক ‘বেশ রক্ষণশীল চরিত্র।’ জেনারেল জ্যাক জ্যাকব কেন তাঁকে ‘ভাঁড়’ বলেছেন, তা-ও নির্দিষ্ট করেননি প্রিন্সটন অধ্যাপক। গ্রিফিল দেখেছেন ব্লাড চলে যাওয়ার পর কেব্লগুলোর ধার কমে। ‘স্পিভাক আবেগরহিত মানুষ। পুরোনো ধাঁচের। অনেক বেশি বিশ্বস্ত আমলা।’ আমি দেখি তিনিও ব্লাডের অনুসারী হয়েছিলেন। স্পিভাক বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর অনুরাগী হন। গ্যারি বাস গ্রিফিলের স্পিভাক মূল্যায়নের ওপর বেশি নির্ভর করেছেন। স্পিভাক যদি এতই ‘বিশ্বস্ত’ হবেন তাহলে নিক্সন-কিসিঞ্জার কেন তাঁকে গালি দেবেন? তাঁদের টেলিফোন আলাপের একটি বিবরণে দেখি স্পিভাকের ভূমিকায় তাঁরা ভীষণ ক্ষুব্ধ। তাঁকে গালিও দিয়েছিলেন। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে উৎসাহী স্পিভাক স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছিলেন। কিছুটা হলেও চাকরির ঝুঁকি তিনি নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত হন। তিনি কিসিঞ্জারকে লিখলেন, সব মিশনপ্রধানেরা থাকবেন। যুক্তরাষ্ট্র না থাকলে ভালো দেখায় না। অনুদার কিসিঞ্জার অনুমতি দেননি। বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি দেওয়ার সপক্ষে প্রেরিত তাঁর তারবার্তাগুলো সাহসী।

মার্কিন কনসাল স্পিভাক ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে পাঠানো একটি তারবার্তায় (আমার নোটবুক অনুযায়ী এর ক্রমিক নম্বর ঢাকা ৫৭২৪) উল্লেখ করেছেন, বুদ্ধিজীবী হত্যায় জামায়াতি দুর্বৃত্ত বা ‘জামায়াত থাগস’রা জড়িত। একাত্তরে তাঁর পাঠানো ডিসেম্বর ও জানুয়ারির তারবার্তাগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্পষ্ট ইঙ্গিত পাই, মুক্তিযোদ্ধারা বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী কি না, তা যাচাই করতে ওয়াশিংটন থেকে বার্তা এসেছিল। ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর স্পিভাক ৫৭৭২ নম্বর কনফিডেন্সিয়াল তারবার্তায় কেন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য মুক্তিবাহিনীকে দায়ী করা সন্দেহ সৃষ্টি করে, তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

বুদ্ধিজীবী হত্যায় আলবদরই আসল নেতৃত্ব দেয়। এটা মার্কিন দলিলপত্রে যেমন, তেমনি তা পাশ্চাত্যের গবেষকেরাও নিশ্চিত করেছেন। এর মধ্যে ইরানি বংশোদ্ভূত মার্কিন অধ্যাপক ড. সাইদ ভালি রেজা নসর অন্যতম। তিনি জামায়াত-ই-ইসলামি ও এর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী সম্পর্কে দুটি গবেষণামূলক বই লিখেছেন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ডিন। ওবামা-কেরির পররাষ্ট্র দপ্তরের ফরেন অ্যাফেয়ার্স পলিসি বোর্ডের সদস্য। জন কেরি মার্কিন সিনেটে তাঁকে উদ্ধৃত করে এর আগে বক্তব্য রেখেছেন।

ভালি নসরের লেখা বই দ্য ভ্যানগার্ড অব দি ইসলামিক রেভল্যুশন: দ্য জামায়াত-ই-ইসলামি বইয়ের ৬৬ পৃষ্ঠায় তিনি জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ইসলামি জমিয়তে তুলাবা (আইজেটি)-র সঙ্গে আলবদরের সম্পর্ক এবং তাদের দ্বারা বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য দিয়েছেন। এতে মতিউর রহমান নিজামীর নাম আছে।

ভালি নসর লিখেছেন, ‘এটা বিস্ময়কর নয় যে জমিয়তে তুলাবা ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে যখন আইয়ুব খানের শাসন ভেঙে পড়ে এবং পিপলস পার্টি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাঙালি পার্টি আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরোধের কারণে গৃহযুদ্ধ ঘটে এবং পাকিস্তান ভেঙে যায়, তখন তুলাবা পুনরায় সামনে চলে আসে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আইজেটি পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি ও আওয়ামী লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত জামায়াতের ন্যাশনাল ক্যাম্পেনের নেপথ্যের মূল শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই প্রচারণার ফলে জাতীয় রাজনীতিতে আইজেটির অবস্থান নিশ্চিত হয়, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মে মাসে। এ সময় আইজেটি পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ দমন অভিযোনে যোগ দেয়। সেনাবাহিনীর সাহায্যে আইজেটি দুটি আধা সামরিক বাহিনীর ইউনিট সংগঠিত করে। আর তা হলো আলবদর ও আলশামস। তাদের কাজ ছিল বাঙালি গেরিলাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা। অধিকাংশ আলবদর নেওয়া হয়েছিল আইজেটি সদস্যদের মধ্য থেকে, যারা পূর্ব পাকিস্তানে মুহাজির সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছিল। আইজেটির নাজিম-ই-আলা মতিউর রহমান নিজামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলবদর ও আলশামস সংগঠিত করেন। গৃহযুদ্ধে তাদের ওই ভূমিকার কারণে তাদের চরম মূল্য দিতে হয়।’

৮ ডিসেম্বর ২০০৭ লন্ডনের দি ইকোনমিস্ট ‘গিল্টি অ্যাট বার্থ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে নিজামীকে আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে উল্লেখ করে। নিজামী এর প্রতিবাদ করেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে, আলবদরের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। অথচ আলবদরের সঙ্গে নিজামীর সম্পৃক্ততা তাঁরই (নিজামী) দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের বরাতে দাবি করেছেন অধ্যাপক ভালি নসর। তিনি তাঁর বইয়ের ফুটনোটে নির্দিষ্টভাবে এর তথ্যসূত্র দিয়েছেন। আর সেটি হলো ১৯৮১ সালে লাহোর থেকে প্রকাশিত সৈয়দ মুত্তাকিল রহমানের য্যাব ভু নাজিম-ই আলা দি।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুরু ২৫ মার্চেই। এর নেপথ্যের কারণ কালকের লেখায় বলব। ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ কিসিঞ্জারের জন্য প্রস্তুত একটি স্মারকে উল্লেখ দেখি, ইয়াহিয়া ৪ সেপ্টেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন কিন্তু ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেট জানিয়েছে যে বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড কেবল ডিসেম্বরের বিষয় ছিল না।

১৯৭২ সালের ২৮ জানুয়ারি ওয়াশিংটন থেকে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম পি. রজার্স ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেটে পাঠানো এক তারবার্তায় [নম্বর ১৬৮৯২] বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তথ্য জানতে মার্কিন কংগ্রেস অব্যাহতভাবে আগ্রহ দেখিয়ে চলেছে। তাই ডিসেম্বরের গোড়ায় যেসব বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন, তাঁদের নাম এবং নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপট জানিয়ে অতিরিক্ত তথ্য জানতে চাইছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।

১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর স্পিভাক (তারবার্তা নম্বর ঢাকা ৫৭১৪) ‘যুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্প আগে গ্রেপ্তার হওয়া কয়েক শ বুদ্ধিজীবীর’ কথা উল্লেখ করেন। তিনি মূল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ১৪-১৬ ডিসেম্বরে সংঘটিত হয় বলে বর্ণনা করেন। লক্ষণীয় যে, ১১ ডিসেম্বরে মুজিবনগর সরকার দ্বারা জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার পরপরই গণহারে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটে।

স্পিভাক ঢাকা ৫৯৯৬ নম্বর তারবার্তায় ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনকে অবহিত করেন যে, ‘বিশ্বাস করা হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মির স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা সমর্থক ও রাজাকাররা আত্মসমর্পণের শর্তাবলি যাতে তাদের অনুকূল হয়, সে জন্য প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিজীবীকে গ্রেপ্তার করেছিল “হোস্টেজ” (জিম্মি) হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।’ স্পিভাকের এই ধারণা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। একাত্তরের ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণসংক্রান্ত অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে। জেনারেল জ্যাক জ্যাকবের নিজস্ব পরিকল্পনায় আত্মসমর্পণের বিবরণ ভারত সরকারিভাবে গ্রহণ করে না। কিন্তু অধ্যাপক বাস তাঁর উল্লিখিত বইয়ে জ্যাকবের বীরত্বের স্বীকৃতি দিয়েছেন। সন্তুষ্ট জ্যাকব আমাকে তা জানিয়েছেনও।

১৯৭২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি স্পিভাক অপর এক তারবার্তায় (ঢাকা ৩৯৩) যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ বুদ্ধিজীবী হত্যার তথ্য উল্লেখ করেন। অন্যান্য বড় শহর থেকেও একই ধরনের খবর এসেছে। তবে তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।...ইউসিসের স্থানীয় জ্যেষ্ঠ স্টাফদের রিপোর্ট করেছেন যে, ইতিপূর্বে গণনায় ধরা হয়নি এমন অনেক নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীকে মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল এবং তাদের হত্যা করা হয়।’ এই তারবার্তাটির এর পরের অংশ খুঁজে পাইনি।

‘বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা’ শীর্ষক তারবার্তায় [৫৭৭২] আরও তিনটি বার্তার [ঢাকা ৫৭২৪ ও ৫৭৪৩: ইসলামাবাদ ১২৮৫৬] উল্লেখ দেখেছি। মনে হচ্ছে ওই বার্তাগুলো বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডবিষয়ক, এগুলোর হদিস আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেও পাইনি।

মার্কিন কংগ্রেস যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একাত্তরের গোড়া থেকেই সচেতন ও উদ্বিগ্ন ছিল, তার সাক্ষ্য দেবে মার্কিন কংগ্রেশনাল রেকর্ড। জাতিসংঘও বলেছে, একাত্তরের ডিসেম্বরের বাংলাদেশ পরিস্থিতি মার্কিন কনস্যুলেটই সবচেয়ে ভালোভাবে নজরদারি করতে পেরেছে। সুতরাং জন কেরির প্রশাসনের কাছে স্পিভাকের তারবার্তাগুলো উদ্ধারে একটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কিংবা রাষ্ট্রের সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতায় একটি সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন মনে করি।

স্পিভাকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যার কারণ হিসেবে ‘অবাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণতা’ ও তাদের সহযোগীদের (জামায়াতের) বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধাপরাধের’ অভিযোগ উঠতে পারে বলে যে মন্তব্য করেছিলেন, সেটাই আজ সত্যে প্রমাণিত হয়েছে।

আগামীকাল পড়ুন দ্বিতীয় কিস্তি

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।