সত্যব্রতী এ জেড আবদুল আলী

.
.

আমি তখন দৈনিক সংবাদ-এ সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। একদিন মুনীর ভাই (খোন্দকার মুনীরুজ্জামান) একটি লেখা দিয়ে বললেন, দেখুন তো লেখাটি ছাপা যায় কি না। লেখক এ জেড এম আবদুল আলী। আনিস স্যারের বন্ধু। আনিস স্যার মানে শিক্ষাবিদ-অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। লেখাটি তিনি ছাপার জন্য অনুরোধ করেননি। লেখককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মাত্র। পড়ে দেখি লেখাটি পাকা হাতের। সেই থেকে এ জেড এম আবদুল আলী হয়ে গেলেন সংবাদ-এর নিয়মিত লেখক। এরপর ভোরের কাগজ, প্রথম আলো, ইত্তেফাক, যুগান্তরসহ আরও কয়েকটি পত্রিকায় লিখেছেন।
এই লেখার সূত্রেই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। একবার সহকর্মী হাসান মামুনকে নিয়ে তাঁর বাসায়ও গিয়েছিলাম লেখার জন্য অনুরোধ জানাতে। বাসায় তাঁর ও ভাবির আতিথেয়তা-আন্তরিকতা মনে রাখার মতো। ভাবি ছিলেন ভারতেশ্বরী হোমসের প্রথম ব্যাচের উজ্জ্বল ছাত্রী। পরে সেই ঘনিষ্ঠতা আরও নিবিড় হয় বিএনপির আমলে কিছু রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন উদ্যোগ-আয়োজনে। আলী ভাই  সেসব আয়োজনে যেতেন শ্রোতা হিসেবে। আরও পরে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তুঘলকি কাণ্ডকারখানার পর যখন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এল, তখন আরও অনেকের সঙ্গে তাঁর মনেও শঙ্কা দেখা দেয়। তাহলে কি ‘অন্তর্বর্তী’ শাসন দীর্ঘায়িত হবে? গণতন্ত্র নির্বাসিত থাকবে?
সেই সময়ে প্রথম আলোয় ‘১-১১ থেকে ৫-২৭’ শিরোনামে এক লেখায় জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেছিলেন আবদুল আলী। তিনি মনে করতেন, গণতন্ত্র যত মন্দই হোক, এর বিকল্প নেই। একাধিক লেখায় আলী ভাই তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের দুই সামরিক শাসক উন্নয়নের যতই বাগাড়ম্বর করুন না কেন, পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ শাসনামল সব অর্থনৈতিক সূচক ও প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে ছিল।
এ জেড আবদুল আলী ছিলেন দর্শনের ছাত্র। আবার সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক। এ কারণে তাঁর অধিকাংশ লেখায় বিভিন্ন ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকের গল্প, উপন্যাস, নিবন্ধ ও কবিতার উদ্ধৃতি থাকত। অনেক সময় তাঁদের মুখ দিয়ে নিজের কথাটি বলতেন।
উত্তরায় তাঁর প্রতিবেশী ছিলেন কূটনীতিক ও সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমদ। বিভিন্ন সভা-অনুষ্ঠান ছাড়াও ‘শিউলিতলা’র আড্ডায় গেলে আলী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হতো। মহিউদ্দিন ভাই জানান, মৃত্যুর সপ্তাহ তিনেক আগে আলী ভাই তাঁর বাড়িতে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন হুইলচেয়ারে বসে । সঙ্গে ভাবি ও তাঁর ছেলেও ছিলেন। সেখানে আলী ভাই গানও গেয়েছেন। তিনি ছিলেন গানপাগল মানুষ। তাঁর ভাগনি রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেছেন, ‘আমার এই অবস্থানে আসার পেছনে মামার ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি।’
মৃদুভাষী আলী ভাই আড্ডায় কম কথা বলতেন। অন্যের কথা শুনতে পছন্দ করতেন। কিন্তু মাঝেমধ্যে নীরবতা ভঙ্গ করে এমন সরস ও তির্যক মন্তব্য করতেন, যা হতো দশ কথার এক কথা। আবদুল আলীর লেখায় রাগ ছিল না, ছিল ন্যায় ও সত্যের প্রতি অনুরাগ। নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তিনি তাঁর যুক্তি তুলে ধরতেন। তাঁর লেখা ছিল তাঁর চরিত্রের মতোই আপন বৈশিষ্ট্য ও বিভায় উজ্জ্বল। তিনি কখনো পাণ্ডিত্য জাহির করতেন না; অনেক কঠিন বিষয়ও সহজ ভাষায় বলতে পারতেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি সাম্প্রতিককালে লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছিলেন।

আলী ভাই সব সময়ই প্রগতি ও প্রতিক্রিয়াশীলতার মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা টেনে চলতেন। তেলে-জলে মেশানোর চেষ্টা করতেন না। তিনি মনেপ্রাণে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তাকে লালন করতেন। সত্য, ন্যায়, মানবাধিকার ও সুশাসনের পক্ষে তীক্ষ্ণ ছিল তাঁর কলম ও কলাম। তিনি সাম্প্রদায়িকতাকে সর্বতোভাবে ঘৃণা করতেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক মানুষের জীবনসংগ্রাম থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দুর্দশা, নারীর ওপর নির্যাতন থেকে সামাজিক অবক্ষয়, আমলাদের কপটতা থেকে রাজনীতিকদের স্ববিরোধিতা—সবকিছুই তাঁর লেখনীতে উঠে আসত।

এ জেড আবদুল আলী প্রকৃত অর্থেই সংসদীয় ব্যবস্থা ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চেয়েছেন। তিনি কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিরুদ্ধে ছিলেন বলেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশাল ক্ষমতা খর্ব করার কথা বলতেন। তিনি মনে করতেন, প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত মন্ত্রণালয়ের বাইরে কোনো মন্ত্রণালয় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের খবরদারি করা ঠিক নয়। তিনি বলতেন, বাংলাদেশে যে সংসদীয় ব্যবস্থা আছে, সেটি কার্যত রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার আদলে। আসলে ১৯৯১ সালের সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার সময়েই এই ত্রুটি ছিল। তখন আওয়ামী লীগ এর প্রতিবাদ করলেও ক্ষমতায় এসে তারা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়নি।

এ জেড এম আবদুল আলী আরেকটি বিষয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন—অসাম্প্রদায়িক চেতনা। তিনি সাম্প্রদায়িক ধ্যানধারণাকে ঘৃণা করতেন। মনে আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মতিনের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপুষ্ট একটি বইয়ের সমালোচনা করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, সেই বই ফটোকপি করে জনে জনে বিলি করেছেন, অন্যদের লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। মতিনের আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বইয়ে এমন সব সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কথাবার্তা ছিল, যা স্বাধীনতাবিরোধীরাও উচ্চারণ করতে সাহস পাননি। ২০০০ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পাওয়ার ঘটনাটি তিনি দেখেছেন অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টিতে। তাঁর মতে, এতে নাকি ‘কথিত বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের নাচানাচি ও হইহুল্লোড় বেড়ে যাবে।’ পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করে ওই উপদেষ্টা আরও লিখেছিলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে এ দেশের স্বতন্ত্রকে মুছে ফেলার জন্য দেশের এক-দশমাংশ ভূখণ্ডকে (পার্বত্য চট্টগ্রাম) অন্যের দখলদারিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’ ভাগ্যিস, তাঁর আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। ওই ভূখণ্ড বাংলাদেশেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ আছে এবং থাকবে।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই ক্ষমতাধরদের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আবদুল আলী ওই বইয়ের সমালোচনা করেছিলেন। এ থেকে  নিভৃতচারী মানুষটির মনের সাহস আঁচ করা যায়।

আওয়ামী লীগের প্রতি যে আলী ভাইয়ের কিছুটা পক্ষপাত ছিল তা তাঁর লেখালেখি থেকেই আমরা জানতে পারি। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ যখন খেলাফত মজলিসের সঙ্গে চুক্তি করল, তিনি সেটিকে অভিহিত করলেন ‘পরাজয় নিশ্চিত করার দলিল’ হিসেবে। পরে অবশ্য দলটি সেই চুক্তি বাতিল করেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে আরও অনেকের মতো এ আলী ভাইও খুশি হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি তাদের সতর্ক করে দিতেও ভোলেননি ।

২০০৯ সালের ২৭ এপ্রিল প্রথম আলোয় ‘সংস্কৃতি: দেশের ও রাজনীতি’ কলামে তিনি লিখেছিলেন, ‘সম্প্রতি হয়ে যাওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দিনবদলের স্বপ্ন দেখিয়েছে। কিন্তু ছাত্রলীগের ছেলেদের কাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, তারা সেই দিনবদলে বিশ্বাস করে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কয়েক দিন ধরে যা শুরু হয়েছে, কঠোর হাতে বন্ধ করতে না পারলে সেই দিনবদলের সনদ কার্যকর করা কঠিন হবে।’

এ জেড আবদুল আলী যে দিনবদলের আশা করেছিলেন, সেটি অপূর্ণই রয়ে গেল।

এই সত্যব্রতীর প্রতি বিনীত শ্রদ্ধার্ঘ্য।  

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক