যখন দিনের আলো নিভে আসছে বলে মনে হয়...

আমি অচিকিৎস্য রকমের আশাবাদী: সৈয়দ শামসুল হক
আমি অচিকিৎস্য রকমের আশাবাদী: সৈয়দ শামসুল হক

সৈয়দ শামসুল হক লিখছেন। ক্যানসারের সঙ্গে বাস করছেন, সেই বাস্তবতার কাছে নতি স্বীকার না করে তিনি লিখেই চলেছেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই তিনি শতাধিক কবিতা লিখেছেন। একাধিক গল্প লিখেছেন। গল্প লেখেন ডিকটেশন দিয়ে, আনোয়ারা সৈয়দ হক, আরেকজন শক্তিমান লেখক আমাদের, শ্রুতিলেখন করেন। সেই সব গল্পের ভাষাভঙ্গিতে সৈয়দ শামসুল হকীয় মুদ্রা নির্ভুলভাবে মুদ্রিত থাকে। সৈয়দ শামসুল হককে বিশেষ করে আমার গুরু বা শিক্ষক বলে মান্য করি আমি। আমি তখন উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরুর জন্য অপেক্ষা করছি, রংপুর শহরে। এই সময় সৈয়দ শামসুল হক এলেন রংপুরে, অভিযাত্রিকের অনুষ্ঠান করতে, উঠলেন রংপুর সার্কিট হাউসে। আমি বিশাল একটা ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে গেলাম তাঁর কাছে, তাঁর সাক্ষাৎকার নেব। তাঁকে বললাম, আমি বিচিত্রায় প্রকাশিত আপনার ‘হৃৎ কলমের টানে’ কলামটা নিয়মিত পড়ি। তাতে আপনি বলেন, নতুন লেখকদের কর্তব্য হলো বইপড়া। পড়ার বাইরে আপনি নতুন লেখকদের উদ্দেশে আর কোনো উপদেশ দেবেন কি না। সৈয়দ শামসুল হক ডান হাতের তিন আঙুল তুলে বাঁ হাতের দুই আঙুল দিয়ে ধরে গুনতে লাগলেন, ‘পড়ার বাইরে নতুন লেখকদের উদ্দেশে আমার তিনটে উপদেশ আছে—পড়ো, পড়ো এবং পড়ো।’ তিনি বললেন, ‘অনেকেই বলে, দেশে ভালো বই পাওয়া যায় না, আমি তাঁদের বলি, আমাদের মধ্যে কজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরোটা পড়েছেন? আমাদের মধ্যে কজন বঙ্কিমচন্দ্র পুরোটা পড়েছেন?’

সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন, লেখকের পড়া আর পাঠকের পড়া এক নয়। পাঠক পড়বেন, উপভোগ করবেন। লেখক প্রথমে পড়বেন পাঠকের মতো, তারপর তিনি থামবেন, ভাববেন, কেন উপভোগ করলাম, কৌশলটা কী? কেন রবীন্দ্রনাথ কোনো গল্পে একটাও সংলাপ ব্যবহার করেননি, আর কেনই-বা একটা গল্প শুধু সংলাপ দিয়েই তৈরি করেছেন।

এরপরে যে কতবার হক ভাইয়ের কাছে গেছি, কত ইন্টারভিউ নিয়েছি।

একবার তিনি বলেছিলেন, আমি ইতিহাসকে দু দশ বছরের নিরিখে দেখি না, মহাকালের নিরিখে দেখি। একটা বছরে, দশটা বছরে দেশের চলা শ্লথ হতে পারে, মনে হতে পারে, আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে মানুষ এগোবে, সভ্যতা এগোবে, দেশ এগোবে। আমি তাঁর এই কথা কোনো দিনও ভুলি না। মাঝেমধ্যে দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, রাষ্ট্র নিয়ে, এমনকি মানুষের অভব্য আচরণ, কারণহীন করুণাহীন নিম্নরুচির আঘাতে মর্মাহত হই। ভাবি, নাহ, আর হলো না, আমাদের উন্নতি নেই, আমরা বোধ হয় আর সভ্য হব না, আমরা খারাপ বলেই আমরা সুশাসন পাওয়ারও যোগ্য নই। তখন সৈয়দ শামসুল হকের ওই কথা আমার মনে আসে, দু চার দশ বছরের নিরিখে ইতিহাসকে বিচার কোরো না।

এই তো আগস্ট ২০১৬ সালের কথা। প্রথম আলোতে পনেরোই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংখ্যা বের করতে হবে—শোক ও শ্রদ্ধা। সৈয়দ শামসুল হক তখন লন্ডনে চিকিৎসাধীন। তাঁকে ফোন করলাম। কবিতা দিন। তিনি কবিতা ই-মেইলে পাঠালেন। পড়ে অভিভূত হলাম। কলমে জাদু না থাকলে এই রকম লেখা সম্ভব না। এরপর শুরু হলো এসএমএস চালাচালি। তিনি নিচের দিক থেকে দশম লাইনের একটা শব্দ বদলাতে চান। প্রথমে একটা বিকল্প শব্দ দিলেন। পরে সেটাও পাল্টালেন। বললেন, এটা দাও, ছন্দও সুন্দর হবে। আমি বললাম, হক ভাই, আপনার কাছে আমাদের শেখার আছে। এই শরীর, এই স্বাস্থ্য নিয়ে সুদূর লন্ডন থেকে আপনি কবিতার একটা শব্দ নিয়ে কী খুঁতখুঁতই না করছেন।

তিনি আমাকে আবারও উপদেশ দিলেন, গুরুবাক্য হিসেবে যা আমি সর্বদা মনে রাখার চেষ্টা করব। বললেন, লেখালেখির ব্যাপারে লেখকের অবশ্যই ‘প্যাশন’ থাকতে হবে, এটা তুমি কখনোই বিসর্জন দিতে পারো না।

সৈয়দ শামসুল হকের এই যে প্যাশন, সেটা তাঁর রোগশয্যাতেও অটুট আছে। অটুট আছে জিগীষাও। জয় করার ইচ্ছা। তিনি লিখছেন, লেখাই তো অস্ত্র। কী অসাধারণ কবিতা তিনি আমাদের দিয়েছেন, পরানের গহীন ভিতর, কিংবা বৈশাখে রচিত পঙ্‌ক্তিমালা, কাব্যনাট্য—নূরলদীনের সারা জীবন কিংবা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়,  কথাসাহিত্য—অন্তর্গত, দূরত্ব, নিষিদ্ধ লোবান। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বইগুলো—প্রণীত জীবন বা তিন পয়সার জ্যোৎস্না—সাম্প্রতিক বইগুলোও জানান দেয় যে তিনি এখনো আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখকদেরই একজন।

ডাক্তার যখন আপনাকে বলে দেয়, আপনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না, তখন কেমন লাগে! স্টিফেন হকিংয়ের কাছ থেকে সেই রকম অনুভূতি আমরা জানতে পারি। স্টিফেন হকিং পৃথিবীর সেরা মহাকাশবিজ্ঞানীদের একজন, যাঁর লেখা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের একটা। তিনি ব্ল্যাক হোলস অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স অ্যান্ড আদার স্টোরিজ বইয়ে তাঁর অসুস্থতার গল্প, শৈশবের গল্প আর ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম লেখার গল্প আমাদের শুনিয়েছেন। ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন স্টিফেন হকিং। তিনি যখন ছাত্র, অক্সফোর্ডে পড়েন, তখন তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর একটা রোগ আছে, তিনি ঝাপসা দেখেন কখনো কখনো। তাঁর ২১ বছর বয়সে, ১৯৬৩ সালে, তিনি হাসপাতালে যান টেস্ট করাতে। তখন জানা গেল, তাঁর মটর নিউরন ডিজিজ হয়েছে। এটা আর সারবে না। তিনি ধীরে ধীরে অচল হয়ে যাবেন এবং তিনি মারা যাবেন। সেটা কত তাড়াতাড়ি তা তিনি জানতেন না। হয়তো ছয় মাস, হয়তো কয়েক বছর। তখন তাঁর পাশের বিছানায় লিউকোমিয়া রোগে আক্রান্ত এক বালককে তিনি দেখেন। সেও মারা যাবে। স্টিফেন হকিং ভাবলেন, আমার অবস্থা ওর চেয়ে ভালো। আমি কবে মারা যাব, তা জানি না। আর এখন তো আমি রোগটাকে অনুভব করতে পারছি না।

তিনি হাসপাতাল থেকে ফিরলেন। তাঁর মনে হলো, তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামি। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, তিনি জীবনকে আগের চেয়ে বেশি করে উপভোগ করতে শুরু করলেন এবং কাজ করাটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন। তিনি বিয়ে করলেন। কাজ করে চললেন। তাঁর চলাচল সীমিত হয়ে আসতে লাগল। হুইলচেয়ার ছাড়া তিনি চলতে পারেন না। এভাবে চলল প্রায় এক যুগ। ১৯৮৫ সালে, তাঁর ৪৩ বছর বয়সে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলেন। এরপর তাঁর একটা অপারেশন হলো। এরপরে বন্ধ হয়ে গেল তাঁর কথাও। তখন তিনি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতেন চোখের পাতা ফেলে। কেউ একজন তাঁর সামনে একটা অক্ষর ধরত, আর তিনি চোখের পাতা ফেলে সেটাকে অনুমোদন করতেন। তারপর তাঁর জন্য একটা কম্পিউটার সফটওয়্যার এল, যেটা দিয়ে চোখের পাতা ফেলে লিখতে পারতেন। এখনো তিনি কথা বলতে পারেন না, কম্পিউটারের মাধ্যমে তাঁর চিন্তাগুলো লেখা হয়। এভাবে তিনি বই লেখেন। ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইমও লিখেছেন প্রতিবন্ধিতা সত্ত্বেও। পাতার পর পাতা সংশোধন করেছেন। এখন তিনি এভাবে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তৃতাও দিচ্ছেন। ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকেই যাঁর জীবনাবসান হওয়ার কথা, তিনি এই ২০১৬ সালেও আছেন, বিপুলভাবে। তিনি চলতে পারেন না, নড়তে পারেন না, চোখের পাতা ছাড়া কিছুই নড়াতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না, কিন্তু তিনি লিখছেন, গবেষণা করছেন, লেকচার দিচ্ছেন। ভাবা যায়!

গত পরশু প্থম আলোয় এসেছিলেন বিজ্ঞানী দীপঙ্কর তালুকদার। আইনস্টাইনের সূত্র প্রমাণিত করে গত বছর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ লাইগোতে ধরা পড়েছে, সেই গবেষক দলের একজন বরগুনার দীপঙ্কর তালুকদার। ছেলেবেলায় যাঁর স্কুলের বেতন ২৪ টাকা দেওয়াও ছিল কষ্টকর। এখন অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। জার্মানির ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট, ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পড়েছেন। তিনি গত পরশু কিশোর আলো ও গণিত অলিম্পিয়াডের কিশোরদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। একজন তাঁকে প্রশ্ন করল, এলিয়েন কি আছে? দীপঙ্কর তালুকদার বিজ্ঞানের মানুষ, প্রমাণ ছাড়া তিনি কথা বলবেন না। তিনি বললেন, এটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর গবেষণা করেছে, টাকা খরচ করেছে, এলিয়েন পায়নি। এলিয়েন তো পাওয়া যাবে না, সংকেত পাওয়া যেতে পারত। এখনো যায়নি।

স্টিফেন হকিং মজার মানুষ। কিছুদিন আগে ইংল্যান্ডে তাঁকে বাচ্চারা জিজ্ঞেস করেছিল, জায়ান মালিক (জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা) ওয়ান ডিরেকশন (গানের দল) ছেড়ে দিয়েছেন, অন্য কোনো জগতে কি জায়ান মালিক সেই ব্যান্ডে ফিরতে পারেন না?

স্টিফেন হকিং বলেছেন, ‘আরেকটা গ্যালাক্সিতে হয়তো আরেকটা ওয়ান ডিরেকশন আছে, জায়ান মালিক সেখানে তার ব্যান্ড ছেড়ে দেয়নি।’

অন্য গ্রহ থেকে এলিয়েনরা এসে পৃথিবী ধ্বংস করবে কি না। স্টিফেন হকিং জবাব দেন, তার চেয়েও বড় শঙ্কা হলো পৃথিবীতে যে পরিমাণে আণবিক বোমা আছে, তা পৃথিবীর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেন, ভুল করে কোনো দুর্বল দেশের পারমাণবিক বোমার সুইচে কোনো পাগল বা সন্ত্রাসী ঢুকে পড়ে সুইচ টিপে দিলেই পৃথিবী শেষ। কারণ, সেটাকে প্রতিরোধ করতে সব দেশই তার তার সুইচ টিপে দেবে। হকিং বলেন, তাই আমাদের উচিত সব সরকারকে চাপ দেওয়া অস্ত্র কমানোর জন্য।

তিনি বলেন, একটা অসুস্থ কৌতুক আছে, পৃথিবীতে এলিয়েন আসে না। কারণ, কোনো এলিয়েন প্রজাতি যখন খুব উন্নতি করে, তখন তারা নিজেরাই নিজেকে ধ্বংস করে। তিনি বলেন, আমি আশা করি, পৃথিবীর ক্ষেত্রে তা ঘটবে না।

সৈয়দ শামসুল হক বলেন, আমি অচিকিৎস্য রকমের আশাবাদী। আর গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলেন, মানুষের পরাজয় মেনে নিতে আমি অস্বীকার করি। কিংবা হেমিংওয়ের মতো আমরা বলতে পারি, মানুষকে ধ্বংস করা যেতে পারে, কিন্তু পরাজিত করা যাবে না।

আমরা সবাই মরণশীল। আমাদের হাতের অবশিষ্ট দিনও তো গোনা। যে কটা দিন বাঁচি, আমাদেরও তো ভালো ভালো কাজই করা উচিত। ‘সংসার মাঝে কয়েকটি সুর, রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর, দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর, তারপর ছুটি নিব।’ একটা হলেও যেন কাঁটা দূর করতে পারি!

আনিসুল হক: সাহিত্যিক  সাংবাদিক