আমেরিকার নির্বাচন, বাংলাদেশের চোখ

ডোনাল্ড ​ট্রাম্প
ডোনাল্ড ​ট্রাম্প

প্রথম বিতর্কে ট্রাম্পের কথার মাঝখানে হিলারি বাধা দিয়েছেন ১৭ বার। ট্রাম্প দিয়েছেন ৫১ বার। তার মানে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প হবেন একজন অসহিষ্ণু মানুষ। বিতর্ক শেষে সত্যতা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বিতর্ককালে ট্রাম্প অসত্য কথা বলেছেন চারবার, হিলারি একবার। হিলারি যুক্তি-তর্কে তঁাকে নাস্তানাবুদ করেন পাঁচবার, ট্রাম্প দুবার। প্রথম বিতর্কে তাই হিলারি জিতেছেন। কিন্তু এ বিজয়ে আসলে
কি কিছু আসে-যায়? অতীতে বিতর্কে হেরেও আসল নির্বাচনে জিতেছেন বেশ কয়েকজন প্রার্থী। আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে এমন নানান বিশ্লেষণ চলছে বিশ্বব্যাপী। মনে হয় না অন্য কোনো দেশের নির্বাচন নিয়ে এত মাথা ঘামায় পৃথিবীর মানুষ।
কারণটা বোধগম্য। আমেরিকা বহু বছর ধরে বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে তাই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সব সময় আগ্রহ ছিল। এই আগ্রহ নতুন মাত্রা পায় ২০০৮ সালে বারাক ওবামা নামের এক কালো চামড়ার মানুষ আমেরিকার নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হওয়ার পর। আমরা যাঁরা আলেক্স হ্যালির রুটস পড়ে বা অন্য কোনোভাবে আমেরিকার কালো মানুষের হৃদয়বিদারক ইতিহাসের কথা জানি, তঁাদের জন্য এটি একটি আবেগময় বিষয়ও হয়ে দাঁড়ায়। ওবামার বিজয়ে তাই আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের নির্যাতিত ও তাদের প্রতি সহমর্মী মানুষ।
আমেরিকার এবারের নির্বাচন নিয়েও বিভিন্ন কারণে পৃথিবীব্যাপী আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এর একটি বড় কারণ, ডেমোক্রেটিক পার্টি কর্তৃক ওবামার উত্তরসূরি হিসেবে একজন নারীকে মনোনয়ন দেওয়া। বাদবাকি বিশ্বের জন্য না হলেও আমেরিকার জন্য এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। আমেরিকার জন্য এটি একটি অস্বস্তিকর বিষয়ও। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৪ সালের একটি গবেষণা অনুসারে ১৪২টি দেশের মধ্যে ৬৩টি দেশে কোনো–না–কোনো সময় নারীরা রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সম্মান অর্জন করেছিলেন। বর্তমানে ২৩ জন নারী এমন দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ আমেরিকার শতাধিক বছরের ইতিহাসে এমন সুযোগের দ্বারপ্রান্তে আসতে পেরেছেন হিলারিই প্রথম। হিলারি তাই নির্বাচনে জিততে পারেন কি না, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হতে পারেন কি না, তা নিয়ে যেকোনো অঞ্চলের মানুষের আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক।
আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববাসীর আগ্রহের সম্ভবত আরও বড় কারণ হচ্ছে, হিলারির প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন আচরণ ও নীতি। ট্রাম্প রাখঢাকহীনভাবে মুসলিমবিরোধী এবং হিস্পানিক ও কালো আমেরিকানদের প্রতি সন্দিহান ও রুষ্ট একজন মানুষ। ট্রাম্প জাপান, কোরিয়া ও সৌদি আরবকে দেওয়া সামরিক নিরাপত্তা অব্যাহত রাখতে, এমনকি ন্যাটো জোট বজায় রাখতেও অনাগ্রহী। তিনি নাফটা আর ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ-বিরোধী বলে মেক্সিকো থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ তঁার অর্থনৈতিক কর্মসূচির লক্ষ্যবস্তু।
ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তাই সারা বিশ্ব এক নতুন ব্যবস্থার শিকার হতে পারে। আমেরিকায় এবং এর বাইরে বিভিন্ন দেশের মানুষ নজিরবিহীন ব্যাপকতায় এর প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। ফলে আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর বহু দেশের মানুষের আগ্রহী না হওয়ার কোনো অবকাশ ছিল না। এ পটভূমি থেকে হিলারি আর ট্রাম্পের বিতর্ক বিশ্বব্যাপী মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। টেলিভিশনে বিতর্কের সরাসরি দর্শক ছিল বাংলাদেশেরও অনেক মানুষ।

২.
আমাদের জন্য হিলারি আর ট্রাম্পের বিতর্কের আরও প্রাসঙ্গিকতা ছিল। এ বিতর্কের মধ্য দিয়ে উন্নত একটি গণতন্ত্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে পরিচয় ফুটে উঠেছে, তা বিভিন্ন কারণে উল্লেখযোগ্য।
হিলারি আর ট্রাম্পের বিতর্কের লক্ষণীয় বিষয় ছিল তঁাদের ভবিষ্যৎ-ভাবনা এবং এ নিয়ে শাণিত বিশ্লেষণ। যেমন কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য তঁাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা জানতে চাওয়া হয়েছে বিতর্কে। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি বড় ব্যবসার জন্য ট্যাক্স অর্ধেকের বেশি নামিয়ে আনবেন, যাতে তারা আমেরিকায় বিনিয়োগ করে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে। পাল্টা যুক্তি এসেছে যে তঁার কর্মসূচি আরও সম্পদ-বৈষম্য সৃষ্টি করবে এবং এতে ফেডারেল রিজার্ভ কমে যাবে বলে সামাজিক নিরাপত্তা ও সেবা কর্মসূচি ব্যাহত হবে। হিলারি এর বিপরীতে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও বিনিয়োগে তঁার কর্মসূচির কথা বলেন। তিনি দাবি করেন যে একটি নিরপেক্ষ গবেষণায় তঁার কর্মসূচিতে ১ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং ট্রাম্পের কর্মসূচিতে ৩৫ লাখ কর্মসংস্থান কমে যাবে বলে বলা হয়েছে। দাবি–পাল্টাদাবির সত্যতা নিরূপণে ফ্যাক্ট চেকার গ্রুপগুলো বিতর্কের পরপরই সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাতে দেখা যায়, কারও বক্তব্যই পুরোপুরি সঠিক ছিল না। সুনির্দিষ্টভাবে হিলারির কর্মসূচির কারণে ১ কোটি নয়, ৩২ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে এবং ট্রাম্পের কারণে ৪ লাখ কর্মসংস্থান কমতে পারে। আবার হিলারি যখন ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ গঠনে তঁার ভূমিকা আড়াল করতে চেয়েছেন, তখন ট্রাম্প তঁার প্রতিবাদ করেন এবং বিতর্কের পরের সত্যতা পরীক্ষায় হিলারির বক্তব্যে অসততাও ফুটে উঠেছে।
এ ধরনের কোনো বিতর্কে তাই যা খুশি বলে পার পাওয়ার উপায় থাকে না। প্রার্থীদের বক্তব্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে তঁাদের আগেকার সব কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য বিবেচনায় নিয়েও। যেমন নিরাপত্তা–ভীতিতে জর্জরিত আমেরিকানদের মন জয় করতে ট্রাম্প মুসলিম, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। হিলারি আগে বহুবার বলেছিলেন এবং বিতর্কেও বলেছেন, ট্রাম্পের নীতি বরং জঙ্গিবাদকে উসকে দেবে; তঁার মুসলিমবিরোধী কঠোর ও ঢালাও অবস্থান বরং আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোতে নতুন কর্মী সংগ্রহকে সহজ করে দেবে।
বিতর্কে ইরাক আক্রমণ করে এবং পরে দেশটিকে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে আইএসের উত্থানের সুযোগ দেওয়ার জন্য হিলারিকে দায়ী করেন ট্রাম্প। তঁার এ অভিযোগ সারবত্তাহীন নয়। কিন্তু তিনি যখন বলেন ‘গোটা যৌবনকাল’ হিলারি আইএসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পেয়েও কিছু করতে পারেননি; এখন আর নতুন কী করবেন, তখন এ আক্রমণের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফ্যাক্ট চেকাররা প্রশ্ন তুলেছেন, ২০০৯ সালে জন্ম নেওয়া আইএস দমন করতে তিনি কীভাবে গোটা যৌবনকাল ব্যবহার করতে পারলেন? ১৪ বছর আগে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প আসলে নিজে ইরাক আক্রমণ সমর্থন করেছিলেন, এ তথ্যও বিতর্ক-প্রক্রিয়ায় উদ্ঘাটন করা হয়েছে।
বিতর্কে সামাজিক, সাম্প্রতিক নিরাপত্তাবোধ, অস্ত্র আইন, লৈঙ্গিক বৈষম্য, বর্ণবাদী পররাষ্ট্রনীতি, আমেরিকার ভাবমূর্তি—এসব নানা বিষয়ে প্রার্থীরা তঁাদের অবস্থানের কথা বলেছেন। প্রতিপক্ষ বক্তা, উপস্থাপক, বিতর্ক শেষের বিশ্লেষণ আর ফ্যাক্ট চেকারদের কারণে এখানে আমাদের দেশের (এবং অন্যান্য অনুন্নত গণতন্ত্রের) মতো অসত্য, বিকৃত এবং একতরফা প্রচারণার সুযোগ ছিল না। আরও যা লক্ষণীয়, এতে বরং প্রার্থীর ব্যক্তিগত জীবনের নানা প্রসঙ্গের উপস্থাপন এবং তা নিয়ে মুক্ত আলোচনার অবারিত সুযোগ ছিল, যা আমাদের মতো দেশে অকল্পনীয় একটি বিষয়।

৩.
হিলারি আর ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবনের কিছু প্রসঙ্গ বিতর্কে আলোচিত হবে, এটা অনুমিত ছিল। কিন্তু আমাদের দেশের মতো তা অপ্রাসঙ্গিক বা ভিত্তিহীনভাবে আসেনি তঁাদের বিতর্কে। ট্রাম্পের আয়কর রিটার্ন জনগণকে দেখাতে ব্যর্থতার কথা এসেছে, হিলারি এটা লুকানোর পেছনে মারাত্মক কোনো বিষয় আছে এমনও বলেছেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুধু কর ফাঁকি নয়, তিনি যে জনহিতকর কাজে কোনো দান করেন না, তা উঠে আসতে পারে বলেই ট্রাম্প তা বহু বছর ধরে জনগণের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির আর্থিক স্বচ্ছতার প্রশ্নটি অবশ্যই প্রাসঙ্গিক এবং তাই এটি যে খোলামেলা আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত, তা এতে আবারও ফুটে উঠেছে।
শুধু তা-ই নয়, এই বিতর্কে আমরা প্রার্থীদের দায়িত্ববোধ (যেমন হিলারি কর্তৃক ব্যক্তিগত ই-মেইল সার্ভার ব্যবহার, রুচিবোধ। ট্রাম্প কর্তৃক নারীদের মিস পিগি, মিস হাউসকিপিং বলে সম্বোধন), রাজনৈতিক শিষ্টাচার (যেমন ট্রাম্প কর্তৃক ওবামার জন্মস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলা) নিয়ে প্রশ্ন উঠতে দেখেছি। দেখেছি দুই প্রবল প্রার্থীকে কয়েকবার কিছু বিষয়ে একমত হওয়ারও উদাহরণ। দেখেছি বিতর্ক সঞ্চালকের স্বাধীন সত্তা এবং আত্মমর্যাদাবোধ, ফ্যাক্ট চেকারদের নিরপেক্ষতা এবং বিশ্লেষকদের নিঃশঙ্কচিত্তে কথা বলার স্বাধীনতা।
স্বপ্ন দেখি—বাংলাদেশের এমন খোলামেলা বিতর্ক হবে প্রধান দলগুলোর কর্ণধারদের মধ্যে। স্বপ্ন দেখি—সেখানে অতীতের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে ভবিষ্যৎ-ভাবনা; সেখানে নিঃশঙ্কচিত্তে প্রশ্ন তোলা যাবে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা, সততা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে; সেখানে মানুষ পরিষ্কার ধারণা পাবে তাদের নেতা-নেত্রীদের প্রকৃত চরিত্র সম্পর্কে!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।