মিয়ানমারের খোলা দুয়ার

মিয়ানমারের রাজনীতি তত সরল নয়
মিয়ানমারের রাজনীতি তত সরল নয়

ইয়াঙ্গুন এয়ারপোর্টে নামার আগে বিমানটা যখন শহরতলির মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছিল, তখনই চোখে পড়ে সরলরেখার মতো সড়ক পড়ে আছে বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরজুড়ে। দেশটি নিয়ে আমাদের যে রহস্যভরা কৌতূহল, সেটি পাখির চোখে দেখা নগরীর ওপরতল দেখে নিবৃত্ত হয় না। ইয়াঙ্গুনে দীর্ঘ যাত্রাবিরতির পর মান্দালয় বিমানবন্দরে নামতে নামতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই সামনে চোখে পড়ে অবিশ্বাস্য সরলরেখার মতো সড়কবাতির সারি। দীর্ঘদিনের সেনাশাসনের কারণে বোধ করি সড়ক নির্মাণের জন্য জমি হুকুমদখল করার সময় প্রভাবশালী ভূমি মালিকেরা নানান বাহানা দেখিয়ে সড়কের গতিপথ পরিবর্তন করাতে পারেননি। তাই ম্যাপেও দেখা যায়, মিয়ানমারের বিভিন্ন শহরের রাস্তাগুলো কিংবা হাইওয়েগুলো দীর্ঘ পথ সরলরেখায় পাড়ি দিয়েছে।

রাস্তাঘাট সরলরৈখিক হলেও দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধকবলিত সেনাশাসিত দেশটির রাজনীতি তত সরল নয়। দীর্ঘ সময়ের সেনাশাসিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক আবহ সৃষ্টি করার জন্য ২০১০ সালে যে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়, অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সেটি বয়কট করেছিল বলে তা বহির্বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তবে পাঁচ বছর পর ২০১৫ সালের নির্বাচনে এনএলডির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরও ক্ষমতায় আরোহণের সেই পথটি সোজা হয়ে যায়নি। কারণ, ২০০৮ সালে রচিত সংবিধানে পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে সেনাবাহিনীর জন্য। ফলে যেকোনো ধরনের সংবিধান সংশোধন সেনা সমর্থন ছাড়া অসম্ভব। সংবিধান মোতাবেক বিদেশি স্বামী বা স্ত্রী কিংবা সন্তান রয়েছে এমন কোনো বর্মি নাগরিকের জন্য দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের পদটি নিষিদ্ধ। এটি যে সু চির রাষ্ট্র-নেতৃত্ব গ্রহণ ঠেকানোর জন্য, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানেই শেষ নয়, সংবিধান অনুযায়ী সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়: স্বরাষ্ট্র, সীমান্তবিষয়ক ও প্রতিরক্ষা। ফলে আপাত বেসামরিক সরকারের চরিত্র কেমন হবে সেটা সহজেই বোঝা যায়।

মিয়ানমার যাত্রার আগে সংশয় ছিল, চার দশকেরও বেশি সময় সমাজতান্ত্রিক সরকারের কণ্ঠরোধী শাসন, তারপর দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন এবং পরবর্তী সময়ে সেনানিয়ন্ত্রিত বেসামরিক শাসনের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকবে সহজাত ভীতি এবং বাক-সংযম। কিন্তু চমকে দিলেন আমাদের তরুণী গাইড জিন খাইং। অং সান সু চির কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, সু চি আমাদের মা। তারপর দেশের অর্থনীতি প্রসঙ্গে খুব খোলামেলাভাবে জানান যে মিয়ানমারের সব বড় ব্যবসা এখনো ক্রোনিদের কবজায়। ‘ক্রোনি’ শব্দের বাংলা হতে পারে ‘স্যাঙাত’ (যেমন ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বলতে বোঝায়, সরকারের সঙ্গে কোনো শিল্পগোষ্ঠীর অশুভ আঁতাতের পুঁজিবাদ)। মিয়ানমারেও সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে বড় বড় ব্যবসা সব বাগিয়ে বসে আছে এসব ক্রোনি। জিনের কথায় বোঝা গেল, খনি, হোটেল, বিমান, ব্যাংকিং—এ  জাতীয় বড় সব ব্যবসার মালিকানা স্যাঙাতরাই কুক্ষিগত করছে। দেশটির মোট জনসংখ্যার একটা ক্ষুদ্র অংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণির, এই দুই শ্রেণি ছাড়া অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র শ্রম ও কৃষিজীবী।

জিনের কথার প্রমাণ মেলে ২০১৩ সালের আদমশুমারিতে। এই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশটির  ৩০ শতাংশ মানুষেরঘরে রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, কম্পিউটার বা ইন্টারনেটের মতো আধুনিক সরঞ্জাম কিছুই নেই। ৩ শতাংশ মানুষের মোটরগাড়ি আছে, আর প্রায় ৩৯ শতাংশের রয়েছে মোটরসাইকেল। ২০১৩ সালের অন্য একটি হিসাবে দেখা গেছে, ৪০ জনের মতো ধনকুবেরের হাতে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, ২০২২ সালের মধ্যে এই ধনকুবেরদের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩০০ জনে এবং পরবর্তী ১০ বছরে দেশের আয়ের বৈষম্য আরও বাড়বে। দেশটিতে যদি তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ—এসব পুঁজিঘন খাতে বিনিয়োগ হতে থাকে, তাহলে দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ বাড়লেও ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েই চলবে। ২০১০ পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগের যে প্রবণতা দেখা যায়, তাতে অর্থনীতিবিদদের এই আশঙ্কা দৃঢ় ভিত্তি পায়। জিনের গাইডসুলভ ধারাবর্ণনায়ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁর উদ্বেগ প্রচ্ছন্ন থাকে না।

বিরল মান্দালয় রেঙ্গুন এক্সপ্রেসওয়ে ধরে আমাদের গাড়ি যখন ছুটছিল, জিন আমাদের তখন বলছিলেন মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য এবং শাসক দলের মদদপুষ্ট ধনকুবেরদের পুঞ্জীভূত সম্পদের কথা। এ সময় আমাদের সফরসঙ্গীদের একজন কিছুটা মজা করার জন্য জিজ্ঞেস করেন, আমাদের কেউ যদি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে চায় সেটা এই রাস্তায় সম্ভব কি না। জিন বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বলেন, সে ক্ষেত্রে আপনাকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝতে পারি, তিনি রাস্তার পাশের বুশ অর্থাৎ ঝোপের আড়ালে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন। তারপর কথার খেই ধরে দেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ে আরও কিছু ব্যঙ্গাত্মক কৌতুক করেন তিনি। দেশটি নিয়ে আমাদের নানান কৌতূহলের জবাবে একসময় গাড়ির বাইরের অপস্রিয়মাণ আবছায়া অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে জিন বলেন, আসলে আমরা জানি না জাতি হিসেবে আমরা কোথায় বা কোন দিকে যাচ্ছি। দেশের নানান জায়গায় উপদলীয় কোন্দল, সীমান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গৃহযুদ্ধ—এসবের শেষে দেশের মানুষ চায় শান্তি। আসলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে ভাত-কাপড়ের চিন্তায় এত বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় যে দেশের রাজনীতি বা অর্থনীতি নিয়ে তাদের ভাবার সুযোগ নেই। ভিনদেশি ট্যুরিস্টদের কাছে অকুণ্ঠে স্বীকার করা কথায় ফুটে ওঠে দেশ ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদ। ইয়াঙ্গুন থেকে রাজধানী দূরবর্তী শহর নেপিডোতে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়েও জিনের মনোভাব আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো, কী দরকার ছিল এই বিশাল খরচের? এই টাকা দিয়ে মানুষের ভাগ্য ফেরানো যায় এ রকম অনেক কিছু করা যেত।

জিনের এই স্বদেশ সচেতনতা কি তাহলে শ খানেক বছর আগে দেশটির রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে প্রকাশ্য ছিল না? ১৯১৯ সালে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারের অধীনে ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’ পাস করার সময় বার্মাকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। ব্রিটিশ-রাজের এই আচরণের বিষয়ে বার্মার কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা তদানীন্তন ভারত সচিব এডউইন মন্টেগুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ভারত সফর করেন। মন্টেগু পরে মন্তব্য করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন ‘ভদ্র, সরলমনা সুবেশধারী মানুষ। সম্পূর্ণ অনুগত। রাজনৈতিক অস্থিরতার কোনো লক্ষণ নেই।’ মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়, যে বার্মায় রাজনৈতিক সংস্কারের কোনো দাবি বা দরকার নেই। ভারতীয়দের তুলনায় বর্মি জনগণ রাজনৈতিক চেতনায় তেমন উন্নত নয়। (সূত্র: রবার্ট এইচ টেলর-দ্য স্টেট অব মিয়ানমার) অথচ সেই বার্মাতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী পরাভূত হয়েছিল জাপানি বাহিনীর হাতে। আর ব্রিটিশ বিতাড়নের লক্ষ্যে জাপানি বাহিনীকে সহায়তা দিয়েছিলেন সু চির বাবা জেনারেল অং সান।

প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন ইতিহাসে ‘সুবর্ণভূমি’ নামের যে অঞ্চলের কথা বিধৃত আছে, বর্তমান মিয়ানমারকেও তার অন্তর্ভুক্ত বলে ধারণা করা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রাও এই নামের ভাগীদার। আর থাইল্যান্ড তো নিজেদের বিমানবন্দরের এই নামই দিয়েছে। মিয়ানমারের তেল, গ্যাস, কয়লা, রুপা, তামা, দস্তা, টিনের মতো ধাতু ছাড়াও চুনী, পান্না, পিলু, নীলকান্তমণি, পোখরাজের খনি, দামি কাঠ—দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা অনাবিষ্কৃত এসব সম্পদের দিকে নজর আছে বহু দেশের। তাদের চোখে তাই বার্মাই এখন প্রকৃত সুবর্ণভূমি। এমন সব মূল্যবান সম্পদ গর্ভে ধারণ করে মিয়ানমার এত দিন ছিল বদ্ধ দরজার ওপারের এক দেশ। প্রতিবেশী দেশের কাছে এসব সম্পদ রপ্তানির আয় সাধারণ জনগণের কাছ পর্যন্ত পৌঁছায় না।

অর্থনৈতিক কারণে দেশটির সরকার শেষ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে খোলা দুয়ার নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে কৃষি ও কুটিরশিল্পনির্ভর দেশটি এখন বিদেশি লগ্নি ডেকে আনছে। অর্থনৈতিক সংস্কারের এই সুফলও পাওয়া যাচ্ছে দ্রুত। এশিয়ার সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ হয়েছে মিয়ানমার ১৯৯৪ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত গড়ে ৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। ২০১৩ সালে এই হার ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল, ২০০৮ সালে ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০১৬ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে বলে আশা করছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, যা হবে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ। বড় বড় বিনিয়োগের কারণে জিডিপিতে একসময়ের সর্ববৃহৎ খাত কৃষির অবদান দ্রুত নেমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশে, বেড়ে গিয়েছে সেবা খাতে (৩৮%)। শিল্প খাতের অবদান এখনো ২৬ শতাংশ হলেও দ্রুত বর্ধনশীল। বাংলাদেশের চেয়ে সাড়ে চার গুণ বড় আয়তনের দেশটির জনসংখ্যা মাত্র পাঁচ কোটির মতো (২০১৪)। খনিজ সম্পদের সম্ভার নিয়ে শিল্পায়নের অসীম সম্ভাবনার এই দেশটিতে ঢোকার জন্য ওত পেতে বসে ছিল প্রতিবেশী চীন, জাপান, কোরিয়া, ভারতসহ পশ্চিমা বিশ্বের বহু দেশ। কিন্তু সীমিত সময়ের মধ্যে গাইডদের মুখস্থ ধারাবর্ণনায় যতটুকু বোঝা যায়, নতুন ব্যবস্থায়ও ক্রোনি বা স্যাঙাতদের প্রভাব ক্ষুণ্ন হওয়ার নয়। ফলে গাইড জিনের মতো সাধারণ মানুষের যে হতাশামিশ্রিত আশঙ্কা, সেটি দূর করে অচলায়তন ভাঙতে মিয়ানমারকে আরও পথ পাড়ি দিতে হবে।

ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক  ব্যাংকার৷