দোষ শুধু বদরুলের, ছাত্রলীগের নয়!

আমার স্ত্রী শীলা আহমেদকে চেনেন অনেকে। আগুনের পরশমণি আর আজ রবিবার-এর সময় সে ছিল মিষ্টি এক কিশোরী। এখন সে মধ্য তিরিশের নারী। কিছু জিনিস তবু বদলায়নি তার। এখনো সে ভূত, অন্ধকার আর পোকামাকড় ভয় পায়। রক্তপাত, নৃশংসতা বা কদর্যতার কথা শুনতে পারে না। বানানো গল্পের অ্যাকশন ছবি, তাও সহ্য করতে পারে না।
এমন নরম হৃদয়ের মেয়েটি সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরে গম্ভীর হয়ে। ইউএসএইডর একটি প্রকল্পের অর্থনীতিবিদ হিসেবে সে কাজ করছে কয়েক বছর ধরে। কিন্তু অফিসের গাম্ভীর্য কখনো বাড়িতে বয়ে নিয়ে আসে না। আজ সে গম্ভীর কেন?
কারণ, আজ একজন অমানুষের নৃশংসতার কথা শুনে এসেছে। রাস্তার পাগলা কুকুরকে যেভাবে পিটিয়ে মারে মানুষ, সেই অমানুষ তারচেয়েও শতগুণ নৃশংসতায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছে এক তরুণীকে। শীলা আমাকে তার ফালি ফালি হয়ে যাওয়া মাথার ছবিটির কথা বলে! কোপ খেয়ে কুঁকড়ে গোল হয়ে বাঁচার চেষ্টার কথা বলে। রক্তে ভেসে যাওয়া মুখের কথা বলে।
অমানুষটাকে চিনি না আমি, সে আমার ছাত্র না, এমনকি আমার বিশ্ববিদ্যালয়েরও কেউ না। কিন্তু তবু কেন মনে হয়, কিছু কি করার ছিল আমার, কিছু কি করার আছে। আমি শীলাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই হয়তো বলি: ভালো হয়েছে তাকে পিটিয়েছে মানুষ!
আমার কথা তেমন স্পর্শ করে না তাকে। সে বরং স্থিরকণ্ঠে বলে: তাকে সেখানেই মেরে ফেলা উচিত ছিল!
আমি চমকে যাই। বিশ বছর ধরে চিনি তাকে। শান্ত জলাশয়ের মতো হৃদয় তার। কতটা আক্ষেপে, কী যন্ত্রণায় তার মতো একটা মেয়ে বলতে পারে এমন কঠিন কথা!
হায় রে বদরুল! সে কি শুধু খাদিজার মাথা কুপিয়েছে! সারা দেশে কত মানুষের মস্তিষ্ক আর হৃদয় কুপিয়ে ফালা ফালা করেছে সে! কত মানুষের বুকে জ্বালিয়েছে অক্ষম আগুনের শিখা! এই বদরুলের কি বিচার হবে? তার বিচার কি সম্ভব এই নশ্বর ভুবনে? ফাঁসি বা ফায়ারিং স্কোয়াড কিছুই কি হতে পারে তার উপযুক্ত শাস্তি!
মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ছবি আছে, ফেসবুকে অভিযোগ আর অভিশাপ আছে, শিয়ালের চেয়ে শতগুণ ধূর্ত হিসাব-নিকাশ আছে। বদরুলের তাই কিছু শাস্তি হবে হয়তো। কিন্তু বদরুলের কারিগরদের? তাদের কি শাস্তি হবে কোনো? বদরুলদের তৈরির কারখানা কি বন্ধ হবে কখনো?

২.
আমরা ভাবতে চাই না কিছু জিনিস। কিন্তু এটি তো সত্যি বদরুল পশু হয়ে জন্ম নেয়নি। তার বাবা-মা হাতে চাপাতি তুলে নেওয়ার জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়নি। যেকোনো বদরুলের বাবা-মা সন্তানকে কষ্ট করে শিক্ষিত করে। আশা করে, সম্মান আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন হবে তাদের। চাপাতি বদরুলকে তাহলে জন্ম দিল কে?
আমরা চট করে ছাত্রলীগের দোষ খুঁজি। বিএনপি আমলে চাপাতি বা বন্দুকের দোষ দিই ছাত্রদলকে। তারা এক পক্ষ অন্য পক্ষকে মেরে ফেলে, হিসাব না মিললে নিজেরা নিজেদের মারে। রক্তে খুনের নেশা গাঢ় হয়ে উঠলে একসময় চাপাতি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে খাদিজার মতো অন্য কারও ওপর। ক্ষমতাকালে তাদের আছে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের তকমা। এই তকমার জোরে সাহস বাড়ে তাদের, এর জোরে বেঁচে যায় তারা। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের দোষ তো তাই দেবই আমরা।
কিন্তু দোষ কি শুধু বদরুল বা বদরুলের ছাত্রসংগঠনের? দোষ কি ‘চাপাতি বদরুল’দের মাতৃজঠরের নয়? যেখানে সে জন্মে আর
ক্রমেই আরও দানবীয় হয়ে ওঠে, সেই কারখানার নয়?
বদরুলের জন্ম যে কারখানায় তার নাম রাজনীতি। এই রাজনীতি সিপিবি বা বাম মোর্চার রাজনীতি নয়। এটা আওয়ামী লীগ-বিএনপির নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিও নয়। এই রাজনীতি নোংরা কৌশলের রাজনীতি।

৩.
ক্ষমতার রাজনীতির কুশীলবেরা জানে র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা, বিজিবি দিয়েও সব সময় টিকে থাকা যায় না ক্ষমতায়। কখন মানুষের বিদ্রোহ হয়। সবচেয়ে আগে বিদ্রোহ করে তরুণ সমাজ, ছাত্রসমাজ। একবার জেগে উঠতে পারলে বন্দুক, ক্রসফায়ার, গুম, হুমকি কিছুই দমাতে পারে না এদের। ক্ষমতা পাকা রাখতে আর ক্ষমতা বজায় রাখতে তাই প্রথমেই গলা টিপে ধরতে হয় এদের। হুমকিটা বিশ্বাসযোগ্য রাখতে মাঝে মাঝে দু-একটা খুন-জখম করতে হয়।
শিক্ষাঙ্গনে ঢুকে পুলিশ গোয়েন্দার পক্ষে খুন-জখম করা সম্ভব না। সম্ভব সাধারণ ছাত্রসমাজেরই কিছু সার্বক্ষণিক সহপাঠীর পক্ষে। সম্ভব ছাত্র নামধারী কিছু মার্সেনারি বা ভাড়াটে সৈনিক বা লাঠিয়ালের পক্ষে। বদরুলদের জন্ম এই কুৎসিত প্রয়োজন থেকেই। একটু টাকা, একটু আরাম, একটু ভোগবিলাসের লোভে এরা হয়ে ওঠে ক্ষমতার লাঠিয়াল।
এরা জানে শিক্ষককে অপদস্থ করলে, সহপাঠীর ওপর চড়াও হলে, প্রতিপক্ষকে মেরে ফেললে সমস্যা নেই। এরা জানে ছাত্রাবাসে আসন করায়ত্ত করে রাখলে, টেন্ডারে বখরা নিলে, ব্যবসায় জোর করে চাঁদা তুললেও কোনো সমস্যা নেই। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার কারও সাহস নেই, মামলা হলে জামিন ঠেকানোর কেউ নেই, জামিন হলে সাক্ষী দেওয়ার লোক নেই, মামলার পাহাড় জমে গেলে তাকে ঠেকানোর আর কেউ নেই! যত সে বেপরোয়া লাঠিয়াল, ততই তার কদর, ততই সে বড় ছাত্রনেতা!
কিন্তু তাকে নেতা বানায় ছাত্ররা নয়, ছাত্রলীগও নয়। বানায় সে বা ছাত্রলীগ, যাদের লাঠিয়াল সেই কারিগরেরাই। এই কারিগরেরাই সাজায় পুলিশ-গোয়েন্দা, আইন-আদালত। এদের প্রশ্রয়েই দিনে দিনে বেসামাল আর বেপরোয়া হয়ে ওঠে এদের লাঠিয়াল আর পাহারাদার। একদিন এদের চোখ পড়ে অন্যের জমি, অন্যের টাকা, অন্য নারীর দিকে। কখনো বঞ্চিত হলে এদের কোপ নেমে আসে খাদিজাদের ওপর।
এই গল্পের শেষ নেই। কার বিচার চাইব আমরা? সবচেয়ে সহজ শুধু বদরুলদের বিচার চাওয়া। বদরুলের কপাল খারাপ তার পাপের অকাট্য স্থিরচিত্র আর ভিডিও আছে, হাতেনাতে ধরা পড়েছে সে। কয়েক বছর আগে খাদিজাকেই উত্ত্যক্ত করতে গিয়ে সে পিটুনি খেয়েছিল আশপাশের মানুষের কাছে। সে উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে জামায়াত-শিবির নাম দিয়ে। তার গল্পে বিভোর হয়ে কলাম লেখা হয়েছে, তার পক্ষে মিছিল হয়েছে, তাকে আরও বড় নেতা বানানো হয়েছে।
এবার তার কপাল সত্যিই পুড়েছে। মোবাইল ফোনে তার উন্মত্ততার ছবি না তোলা থাকলে বলা যেত খাদিজাকে আসলে জামায়াত-শিবির মেরেছে। জনতার হাতে ধরা না পড়লে সে পালিয়ে যেতে পারত অন্য বহু খুনির মতো। এখন এসব আর সম্ভব নয়।
তার এখন কিছু করার নেই। বিশ্বজিতের খুনিদের মতো শাস্তির রায় পেতে হবে তাকে। বিশ্বজিতের খুনিদের হুকুমদাতা (যারা সেদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে রাজপথে নেমেছিল আন্দোলন প্রতিরোধ করতে) বা তাদের নেপথ্য নির্মাতাদের কোনো সমস্যা হয়নি তাতে। তাঁরা আইনের শাসন আর দলনিরপেক্ষ বিচার করার একটা উদাহরণ পেয়েই নানাভাবে গর্ব করেছেন। বদরুলের ক্ষেত্রেও তাই হয়তো হবে।
৪.
আমরা তবু বদরুলের বিচার চাই। দ্রুত, কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। সেটা হয়তো হবে। হয়তো ছাত্রলীগও আরও কিছু গালমন্দ শুনবে। কিন্তু এটুকুই শুধু হবে আমাদের সান্ত্বনা। কারণ আমরা জানি বদরুলের মতো পশুদের তৈরির কারখানা থেকে যাবে এই পোড়া দেশে। সেই কারখানার মালিকদের বন্দনাও চলতে থাকবে। নতুন বদরুল তৈরি হবে।
আমরা বহু খাদিজা, বহু সনিকে রক্ষা করতে পারিনি। পারিনি আবুবকর বা জুবায়েরদের রক্ষা করতেও। দানব বানানোর কারখানা বন্ধ না হলে ভবিষ্যতেও পারব না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।