হলি আর্টিজান হামলা ও জঙ্গিবিরোধী পদক্ষেপ

হলি আর্টিজানে হামলার পর বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই
হলি আর্টিজানে হামলার পর বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই

যাহোক, আইএসের সম্পৃক্ততা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা ধরনের বক্তব্য এখনো শোনা যায়, সেই বিতর্ক এখন অপ্রয়োজনীয়। যা প্রয়োজনীয় তা হলো বাংলাদেশে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর বিদেশিদের উদ্বেগ কতখানি কমেছে তা এখন পরিষ্কার নয়। তবে ইংল্যান্ড ক্রিকেট টিমের ঢাকায় অবস্থান হয়তো বিশ্বের অনেককেই আশ্বস্ত করবে।

বাংলাদেশের ওই দুই হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। গুলশান হামলার পর তাদের অভিযানে গত ১০০ দিনে প্রায় ৩৩ জন কথিত জঙ্গি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মিরপুরের অভিযানের পর তথাকথিত নব্য জেএমবিসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতায় ভাটা লক্ষ করা যায়। তবে গত শনিবারের অভিযান প্রমাণ করে তৎপরতা কমলেও তারা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এসব অভিযান যেমনটা হয়, তাৎক্ষণিকভাবে যথেষ্ট কার্যকর হয়, তবে এসব অভিযানে জঙ্গি তৎপরতা একেবারে সমূলে উৎপাটন হয়, তেমন নয়। এ পর্যন্ত যেসব তথ্য-উপাত্ত ও গবেষণালব্ধ ফলাফল পাওয়া গেছে তাতে প্রতীয়মান যে এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দেশে জঙ্গি সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে, যা সামরিক ভাষায় বলা হয় ‘রিগ্রুপ’ মানে নতুনভাবে সংগঠিত হওয়া। এ সময়টিতে জঙ্গি তৎপরতা তেমন দৃশ্যমান হয় না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাপের মুখে জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা ঝিমিয়ে যায় বলে মনে হলেও, তেমনটি নয়। যার উদাহরণ আল-কায়েদা। শীর্ষ পর্যায়ের বহু নেতাকে হত্যার পরও আল-কায়েদা নতুনভাবে নতুন নেতৃত্বের ছায়াতলেই গড়ে উঠেছে। পরিবর্তিত হয়েছে সংগঠন। কেন্দ্রীভূত নেতৃত্বের বদলে গড়ে উঠেছে স্থানীয় নেতৃত্ব। পরিবর্তিত হয়েছে কৌশল। অনুরূপভাবে আইএসও এখন আন্তর্জাতিক বাহিনীর তৎপরতায় ক্রমেই নেতৃত্ব এবং কৌশল পরিবর্তনের মুখে রয়েছে। আইএস তাদের দখলে থাকা বহু জায়গা হাতছাড়া হওয়ায় সংকুচিত হওয়ার মুখে বিদেশি নতুন জঙ্গিদের নিজ নিজ দেশে তৎপরতা চালাতে নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে প্রচলিত যুদ্ধের বদলে গেরিলা কায়দায় হামলা, এমনকি এককভাবে আত্মঘাতী হামলার কৌশল গ্রহণ করেছে। যার উদাহরণ ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে দৃশ্যমান হয়েছিল। বাংলাদেশেও এ ধরনের হামলার ছক প্রত্যক্ষ করা গেছে। হলি আর্টিজানও ছিল একধরনের আত্মঘাতী হামলা বা জঙ্গি ভাষায় ‘শহীদি হামলা’।

জঙ্গি তৎপরতার পুনর্গঠন পর্বে নব উদ্যমে নতুন রিক্রুটদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। যারা অভিযানে মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের শহীদ হিসেবে মর্যাদার সঙ্গে তুলে ধরা হয়। সদ্য প্রকাশিত রুমাইয়া নামক মুখপত্রে তামিম চৌধুরীর লেখা বলে কথিত প্রবন্ধের ইংরেজি শিরোনাম থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়। লেখাটির শিরোনাম হচ্ছে ‘দ্য শহুদা অব দ্য গুলশান অ্যাটাক’ (The Shuhda of the Gulshan Attack)। কথিত এই প্রবন্ধে হলি আর্টিজান এবং কল্যাণপুরের অভিযানে মৃত জঙ্গিদের বীরত্বের এবং অপারেশনে বড় ধরনের সাফল্যের কারণে তাদের ‘আত্মদান’কে মহিমাময় করে তুলে ধরা হয়েছে। জঙ্গি ন্যারেটিভ বা উপাখ্যান যে শুধু উদ্বুদ্ধকরণ বয়ান দিয়ে মগজধোলাই বা চরমপন্থার পাঠ দেওয়া হয় তা নয়, এ ধরনের বীরগাথা প্রচারের মাধ্যমেও নতুন জঙ্গিমনা তরুণ-তরুণীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। ধ্বংসের পথ জেনেও প্রচারের আকর্ষণে তরুণ-তরুণীরা সম্পৃক্ত হন এবং হচ্ছেন। ধারণা করা হয়, আইএস-সমর্থিত কথিত নব্য জেএমবিও এখন এই পর্যায়েই রয়েছে। যোগ দিচ্ছেন তরুণ-তরুণীরা, যার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এ ধরনের আগ্রাসী এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রচারণার বিরুদ্ধে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে কৌশল গ্রহণ করা উচিত বা করে তা একধরনের প্রতি-প্রচারণা (Counter Narrative)। তবে ধরনের প্রতি-প্রচারণাও হতে হবে কার্যকর ও যৌক্তিক। দাঁড় করাতে হবে জঙ্গিতত্ত্বের বিপরীতে ধর্মের কার্যকর ব্যাখ্যা ও সঠিক তত্ত্ব। এটা দীর্ঘমেয়াদি এবং এর জন্য সময় দরকার। পাশাপাশি এই প্রতি-প্রচারণা হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। যে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা যে সরকারকে তারা তথাকথিত ‘তাগুতি’ সরকার বলে মনে করে সে সরকারের সমর্থকদের দিয়ে প্রতি-প্রচারণা স্বল্প মেয়াদে কার্যকর মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে কাজে দেয় না। কাজেই প্রতি-প্রচারণায় এমন সংগঠন ও ব্যক্তির প্রয়োজন যাদের জনগণের মধ্যে সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এবং এ ধরনের প্রতি-প্রচারণা চালাতে হবে লম্বা সময়ের জন্য।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি শান্ত মনে হলেও আমাদের আত্মতৃপ্তিতে থাকার কোনো কারণ নেই। এ সময়ে প্রয়োজন সরকারের সঠিক প্রতি-প্রচারণার পদক্ষেপগুলো নেওয়া। জঙ্গিবিরোধী সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় আমরা কতখানি এগিয়েছি, তা পরিষ্কার নয়। মাস খানেক আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অনেকগুলো সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপের কথা বলেছিলেন, কিন্তু তা জনসাধারণের কাছে স্পষ্ট বলে মনে হয় না। যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছিল তার প্রায় সবগুলোর সঙ্গেই জনগণের সম্পৃক্ততার প্রয়োজন রয়েছে। কাজেই এসব পদক্ষেপ সব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও সর্বদলীয় সমর্থনে হলে যথেষ্ট কার্যকর হয়। সরকারের একার পক্ষে সুদূরপ্রসারী জঙ্গিবিরোধী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা তেমন ফলপ্রসূ হয় না।

প্রতি-প্রচারণার একটি উপাদান হলো ফিরে আসা অথবা আত্মসমর্পণ করা জঙ্গিদের বৃত্তান্তকে কাজে লাগানো। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বেশ কিছু কথিত জঙ্গির আত্মসমর্পণের খবরাখবর প্রকাশিত হয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত তাদের এই ফিরে আসার সিদ্ধান্তের পেছনের কারণগুলোকে প্রচারণার কৌশলে কাজে লাগাতে দেখিনি। এসব বৃত্তান্ত প্রতি-প্রচারণার বড় ধরনের হাতিয়ার হতে পারে।

প্রতি-প্রচারণার একটি বড় হাতিয়ার গণমাধ্যম, যার ব্যাপক ব্যবহারে সমাজ ও বিপথগামী তরুণ অথবা বিপদের পথে পা বাড়ানোর অবস্থায় থাকা ব্যক্তিদের নিবৃত্ত করতে পারে। প্রয়োজন ধর্মের সঠিক প্রচারণা, এমনকি ইসলামের ইতিহাসের মানবিক দিকগুলোর ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর ওপরে ডকুড্রামা তৈরি করে প্রচার করাকেও গবেষকেরা যথেষ্ট কার্যকর মনে করেন। ইন্টারনেটের সচেতন ব্যবহারের বিষয়ে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করা, বিভিন্ন স্কুল–কলেজে জঙ্গিবিরোধী প্রচারণায় তরুণদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এসব প্রতি-প্রচারণায় যত বেশি তরুণদের সম্পৃক্ত করা যাবে, ততই বেশি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সন্দেহ নেই যে সরকার জঙ্গিবিরোধী পদক্ষেপে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অবশ্যই নিয়েছে, তবে সেগুলো দৃশ্যমান হতে হবে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও গোয়েন্দা বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়ন অতীব জরুরি। জঙ্গিবিরোধী তৎপরতার অন্যতম উপাদান আগাম তথ্যপ্রাপ্তি এবং সময়মতো তথ্যভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়া। জঙ্গিবিরোধী তৎপরতায় আগাম তথ্যপ্রাপ্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু আধুনিকায়নই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সুদূরপ্রসারী প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। যার জন্য প্রয়োজন প্রচুর অনুশীলন ও ধৈর্য।

পরিশেষে বলতে হয় যে আমাদের দেশে জঙ্গি তৎপরতা মধ্যপ্রাচ্য বা উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মতো শক্ত ভিতে দাঁড়াতে পারবে না, তবে যে ধরনের হামলা হয়েছে সে ধরনের হামলার সম্ভাবনা থেকে সমাজ ও দেশকে রক্ষা করতে হলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়াই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সবাইকে সুদূরপ্রসারী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা। জঙ্গিবাদের এই সমস্যা বাংলাদেশের একটি সামাজিক ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয় হলেও তা বিশ্ব জঙ্গিবাদের প্রভাবে প্রভাবিত। তাই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাগুলোও কার্যকর করার দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে।

এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷

আরও পড়ুন