সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির সমস্যা কী?

২ অক্টোবর প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘সৃজনশীলে নম্বর কমাতে রাজপথে স্কুল শিক্ষার্থীরা’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বোর্ড কর্তৃপক্ষ আগামী বছরের বোর্ড পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নে নম্বর বাড়ানো ও বহুনির্বাচনীতে নম্বর কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানাতে রাজপথে নেমে এসেছে। বোর্ডের সিদ্ধান্ত ও ছাত্রদের আন্দোলন এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করব, সৃজনশীল পদ্ধতির পথে আমরা কতটা এগিয়েছি, এর সফলতার পথে আমরা কী কী বাধার সম্মুখীন হচ্ছি।

এ প্রসঙ্গে অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে যে সৃজনশীল পদ্ধতির বয়স এখনো এক দশকও পেরোয়নি। এত কম সময়ে বহু বিষয়সংশ্লিষ্ট এ রকম একটি পদ্ধতির সফল বাস্তবায়ন আশা করা উচ্চাশাও হতে পারে। তবে দেখার বিষয়, এই পদ্ধতির ত্রুটিবিচ্যুতি বা অসম্পূর্ণতা ও অসংগতি আছে কি না; যদি থেকে থাকে, তবে সেগুলো চিহ্নিত ও সংশোধন করে পদ্ধতিটিকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমরা কতটা আন্তরিক? এখানেই বোধ হয় দুকথা বলার অবকাশ থেকে যায়।

সৃজনশীল পদ্ধতির প্রথম পর্বে ছিল এ পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। পরবর্তীকালে নিজেও প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করি এবং প্রশিক্ষণ কৃতিত্বের সুবাদে প্রথম সব বোর্ডের সমন্বিত সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও প্রধান পরীক্ষকের দায়িত্বও পালন করি। আমাদের প্রশিক্ষণ পর্বের মাঝে আয়োজন করা হয় একটি মতবিনিময় সভার। সেখানে উপস্থিত হন আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদসহ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদেরা। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল সে সভায় উপস্থিত হতে না পারায় তাঁর লিখিত প্রশ্ন ও মতামত উপস্থাপন করা হয়।

ওই মতবিনিময় সভায় শিক্ষাবিদ ও প্রশিক্ষণার্থীদের নানা প্রশ্ন, সংশয় ও মন্তব্যের জবাবে এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা বারবার একটি কথাই তুলে ধরার চেষ্টা করেন যে, এই পদ্ধতি প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নোটবই, গাইড বই, গৃহশিক্ষকতা ও কোচিংনির্ভরতা লোপ পাবে। এনসিটিবি বিশেষজ্ঞ ও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের যুক্তি ও উদাহরণ আপাতদৃষ্টিতে সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় এবং মতবিনিময় সভার সফল সমাপ্তি ঘটে। এরপর সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতি দ্রুত কার্যকর করা হয়।

কিন্তু আজ বাস্তবে আমরা দেখছি, নোটবই, গাইড বই লুপ্ত তো হয়ইনি; বরং যে নোটবই ছিল ২৫ ফর্মার, এখন তা হয়েছে ৫০ ফর্মার। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে কোচিং সেন্টার। আর অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে গৃহশিক্ষকের রুটিন হয়েছে ক্লাস রুটিনের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ অল্প কথায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তবে সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, এ পর্যন্ত এই পদ্ধতির মূল চেতনাটি শিক্ষার্থীদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি। না পারার দায় কেবল এই পদ্ধতির নয়, এ দায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক সমাজের, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের এবং অতি উৎসাহী, অতি যত্নবান অভিভাবকদেরও।

এখন এই পদ্ধতি সফল বাস্তবায়নের পথে যেসব অন্তরায়ের কথা আমরা বলেছি, তার সবটা স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে উদাহরণ হিসেবে একটি বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করা যেতে পারে। সৃজনশীল পদ্ধতি সফল বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় সৃজনশীল শিক্ষকের অভাব। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা সৃজনশীল শব্দটির সুস্পষ্ট ধারণা ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবনেও সমর্থ নন। যিনি নিজে সৃজনশীল নন, তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতার বীজ বপন করবেন!

সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষকের একটি গুরুদায়িত্ব সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা। যথার্থ সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজ। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ শিক্ষকের সৃজনের সামর্থ্যের ঘাটতি আছে। অধিকাংশ শিক্ষকই প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন নোট ও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভর করে। কেউ কেউ কম্পিউটার ফাইলে সংরক্ষিত আগের প্রশ্ন কিছুটা পরিমার্জন ও পরিশোধন করে দায়িত্ব সমাধা করেন। এ ছাড়া নোট ও গাইড যাঁরা লেখেন, তাঁরাও তো সবাই যথার্থ সৃজনশীল নন। ফলে এ পদ্ধতি প্রবর্তনের পর থেকে গতানুগতিকতারই চর্বিতচর্বণ চলছে।

অতএব, যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রবর্তন হয়েছে, আজও তার সার্থক বাস্তবায়ন ঘটছে না। আমরা প্রতিবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে ও বোর্ডে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরীক্ষা নিচ্ছি, ফলাফলের উত্তরোত্তর সাফল্যে আত্মপ্রসাদও লাভ করছি। কিন্তু এক বিরাট শূন্যতা থেকে যাচ্ছে, সেটা কেউই আন্তরিকভাবে তলিয়ে দেখছি না।

শিক্ষকের সৃজনশীলতার দৈন্য আরও প্রকটভাবে ধরা পড়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ক্ষেত্রে। শিক্ষক তো প্রকৃত অর্থে জ্ঞানদান করেন না; বরং জ্ঞানালোকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর অন্তর্লোকের একটি সম্পর্ক স্থাপন করেন। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষায় বলা যায়, বইয়ের ভেতরে যে আলো আছে, সে আলো শিক্ষার্থীর অন্তরে ছড়িয়ে দিতে পারেন যিনি, তিনিই তো প্রকৃত শিক্ষক। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা বছরে একটি বইও সম্পূর্ণ পাঠ করেন না। কাজেই যাঁর নিজের অন্তরই আলোর স্পর্শ থেকে বঞ্চিত, তিনি কী করে শিক্ষার্থীর অন্তর আলোকিত করবেন? ফলে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চলছে গতানুগতিক নিয়মে ও সনাতন আদলেই।

শিক্ষকতা যে সমাজের আর পাঁচটি পেশার মতো নয়, শিক্ষকতা যে ব্রত, তা আমাদের অধিকাংশ সহকর্মী হয়তো জানেনই না। যাঁরা জানেন, তাঁরাও অনেকে আন্তরিকভাবে অনুধাবন করেন না। এর পেছনেও রয়েছে অনেক কারণ। আমাদের শিক্ষকসমাজের এক বড় অংশ স্বেচ্ছায় এ পেশায় আসেননি, এসেছেন দায়ে পড়ে বা বাধ্য হয়ে। কাজেই এ পরিস্থিতির জন্য এককভাবে শিক্ষকদের দায়ী করাও ঠিক হবে না। কিন্তু যেভাবেই হোক এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হবে। সে দায়িত্ব নিতে হবে নীতিনির্ধারক মহলকে—সরকার ও প্রশাসনকে।

আবু রইস: সাবেক শিক্ষক, ক্যাডেট কলেজ