বাংলাদেশের উন্নয়নে সঙ্গী হোক চীন

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যঘাটতি এখন প্রায় ৮৮৪ কোটি ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে রপ্তানি করেছে ৮০ কোটি ৮১ লাখ ডলারের পণ্য। অন্যদিকে চীন বাংলাদেশে রপ্তানি করেছে ৯৬৫ কোটি ৫৮ লাখ ডলার।


চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ। চীনের অর্থনীতি রপ্তানিকেন্দ্রিক। ২০১৫ সালে রপ্তানি আয় ধরে রাখতে দেশটি তাদের মুদ্রা ইউয়ান দুই দফায় অবমূল্যায়ন করেছিল। এরপর চীনের সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্যে টিকে থাকতে বিশ্বের অন্য দেশগুলো একের পর এক মুদ্রা অবমূল্যায়নের প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন চীনের প্রভাব এতটাই।

চীনের রপ্তানি আয় প্রায় ২৩ লাখ কোটি ডলার। সুতরাং বাংলাদেশ থেকে দেশটি যে রপ্তানি আয় করে, তা খুবই সামান্য। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সংখ্যাটি অনেক বড়। বাংলাদেশ মোট চার হাজার কোটি ডলার আমদানি করে। আর এর প্রায় এক-চতুর্থাংশই আসে চীন থেকে। চীন থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে কাপড় ও যন্ত্রপাতি।

বর্তমান বিশ্বে এখন কেউ ভালোবেসে বা দয়া করে আমদানি-রপ্তানি করে না। প্রয়োজনের তাগিদেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়ে থাকে। সুতরাং চীনের বা ভারতের সঙ্গে বিশাল বাণিজ্য নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুললেও কোনো লাভ হবে না। বরং কী করে রপ্তানি পণ্য বাড়ানো যায়, সে​দিকে মনোযোগ দেওয়াটাই বরং অর্থনীতির জন্য ভালো।

চীনে যে বাংলাদেশের রপ্তানি একদমই বাড়ছে না তা নয়। যেমন গত এক দশকে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ১৩ গুণের বেশি। অন্যদিকে একই সময়ে চীনের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ। তবে ১৩ গুণ শুনতে অনেক বেশি হলেও টাকার অঙ্কে তা খুব বেশি নয়। সুতরাং এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রপ্তানি পণ্য আমরা কী করে বাড়াব? চীন বাংলাদেশকে ৫ হাজার ৫৪ পণ্যে বিনা শুল্কে বাজারে প্রবেশের সুবিধা দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের অভিযোগ হচ্ছে, এর মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি করে এমন পণ্যের সংখ্যা খুবই কম। বাংলাদেশ মূলত পোশাক খাতনির্ভর। সুতরাং রপ্তানি পণ্য বেশি না থাকার সমস্যাটি বাংলাদেশের। বাংলাদেশকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।

তবে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের শুরুতে এই প্রশ্নটি অবশ্যই করা যায় যে চীন বিষয়ে বাংলাদেশ আর কীভাবে সহায়তা দিতে পারে। বিনিয়োগ হতে পারে একটি সমাধান। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই হিসাব দিয়ে বলেছে, ১৯৭৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চীন বাংলাদেশ বিনিয়োগ করেছে ৩৭ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। এমনিতেই বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কম। আর চীনের বিনিয়োগ আরও কম। শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে চীন নেই। আশার কথা হচ্ছে, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কেবল চীনের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। দ্রুত এ কাজ শেষ হলে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ কয়েক গুণ বাড়বে বলেই মনে করতে পারি।

তবে পরোক্ষভাবেই মনে হয়, চীন সবচেয়ে সহায়তা করতে পারে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ যদি নিজেদের ‘চীন প্লাস ওয়ান’ দেশের তালিকায় ওপরে উঠিয়ে আনতে পারে, তাহলেই বাংলাদেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান—দুদিক থেকেই বাংলাদেশ লাভবান হবে। চীন প্লাস ওয়ান ধারণাটি তৈরি জাপানের। নিজেদের দেশে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় একসময় জাপানের বিনিয়োগকারীরা ব্যাপকভাবে চীনে যেতে শুরু করেছিলেন। তখন চীনে মজুরি ছিল কম, অবকাঠামো উন্নত। সুতরাং বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বেছে নেয় চীনকেই। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে এখন চীনের মজুরিও যথেষ্ট বেড়ে গেছে। ২০০০ সালের শুরুতে জাপানের বিনিয়োগকারীরা চীন থেকেও সরে যাওয়ার কথা বলা শুরু করলেন। অনেকেই চীন ছাড়াও অন্য আরেকটি দেশ বিনিয়োগের জন্য খুঁজতে শুরু করল। তখনই চালু হলো ‘চীন প্লাস ওয়ান’ ধারণাটি। এরপর জাপানি বিনিয়োগকারীরা চীনের পাশাপাশি থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে বিনিয়োগ করা শুরু করে। পছন্দের তালিকায় আছে বাংলাদেশও।

বিনিয়োগকারীরা দুভাগে ‘চীন প্লাস ওয়ান’ নীতির জন্য দেশগুলোকে বেছে নেয়। যেমন থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মতো দেশ, যেখানে মজুরি বেশি হলেও শ্রমিকেরা দক্ষ, উৎপাদনশীলতা বেশি, অবকাঠামো উন্নত। অন্যদিকে বাংলাদেশে মজুরি অনেক কম। আর দেশটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে নানা ধরনের বাণিজ্য–সুবিধা পেয়ে আসছে। আজকাল বিশ্বব্যাপী নতুন আরেকটি কথা খুব বলা হচ্ছে, তা হচ্ছে মজুরি বেড়ে যাওয়ায় আট কোটি চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। মজুরি বেড়ে যাওয়ায় চীন তা অন্য দেশ থেকে নেবে বা আউটসোর্সিং করবে।

আর এটি করতে হলে এখানে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে এ জন্য বাংলাদেশকেই প্রস্তুত হতে হবে। এখানে জ্বালানির অনিশ্চয়তা আছে, অবকাঠামোতে নানা ঘাটতি, বাড়ছে ব্যবসা পরিচালনা করার ব্যয়। এসব সমস্যার সমাধান হলে চীন থেকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অনেকভাবেই লাভবান হবে বাংলাদেশ।

তবে বিনিয়োগ বা বাণিজ্য নয়—বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত চীন সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়ে আসছে প্রকল্প বাস্তবায়নে। এ জন্য চীন অনেক দিন ধরেই সরবরাহ ঋণ বা বায়ার্স ক্রেডিট দিয়ে আসছে। তবে এ ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। চীনের ঋণে নেওয়া প্রকল্পে কাজ দিতে হয় চীনের প্রতিষ্ঠানকেই। প্রতিষ্ঠানও তারা ঠিক করে দেয়। ফলে বিপত্তি ঘটেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের কেনাকাটা আইনে এ ধরনের ব্যবস্থা নিষিদ্ধ। এ নিয়ে গত কয়েক বছর টানাপোড়েন চলছে চীনের সঙ্গে। আশা করা যায় দ্রুতই এর সমাধান ঘটবে।

চীনের রাষ্ট্রপতি এসেছেন। আশা করছি, এরপর থেকে আমরা চীনের সঙ্গে বিনিয়োগ নিয়েই বেশি কথা বলব। বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশ। সুতরাং শর্তযুক্ত ঋণ–সহায়তার চেয়ে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য–সুবিধাই বাংলাদেশকে বেশি এগিয়ে নিয়ে যাবে। চীন হোক বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার।