বছর পনেরো আগের কথা। এক পাকিস্তানি কূটনীতিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। পোশাকি হিসেবে তথ্য বিভাগের অধিকর্তা, কিন্তু আসলে পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগের সদস্য। যখনকার কথা বলছি, তত দিনে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পতন হয়েছে, কিন্তু তালেবান আন্দোলন থেমে গেছে, তা বলা যাবে না। বরং উল্টো, বড় বড় শহরের বাইরে আগের মতোই তালেবানি কায়দায় কাজকর্ম চলছে। তাদের চোরাগোপ্তা হামলায় মার্কিন বাহিনীর সদস্যরা রীতিমতো জেরবার হয়ে পড়েছেন।
তো সেই কূটনীতিক ভদ্রলোক আমাকে বললেন, তালেবানকে হারানো যাবে না। যতই বোমা পড়ুক, যতই বিদেশি সেনা পাহারা থাকুক, এরা হটছে না। কারণ, তালেবান ঠিক আমেরিকার পাল্টা শুধু একটা রাজনৈতিক বা সামরিক শক্তি নয়। তালেবান একটা ‘মতাদর্শ’, একে হারাতে হলে চাই তার চেয়েও শক্তিশালী একটি পাল্টা ‘মতাদর্শ’।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কেন গণতন্ত্র, সেটাও তো একটা মতাদর্শ। আমেরিকা তো আফগানিস্তানে সেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টাই করে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি তালেবানি ব্যবস্থার চেয়ে অধিক শক্তিশালী নয়? আমার প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক হাসলেন, আমাকে পরামর্শ দিলেন, একবার আফগানিস্তান ঘুরে আসুন। সেখানে পথেঘাটে যাকে পাবেন, তাকে জিজ্ঞাসা করুন, ‘কী, গণতন্ত্র চাও?’ প্রশ্ন শুনে সবাই আপনাকে পাগল ঠাওরাবে।
২০ বছর বন্দুকের ডগায় গণতন্ত্র গেলানোর চেষ্টার পর আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা বাক্সপেটরা নিয়ে নিজ দেশে ফিরে গেছে। সঙ্গে বিদায় হয়েছে তাদের ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া মার্কিন কায়দার গণতন্ত্র। তালেবান ফিরে এসেছে, সঙ্গে ফিরে এসেছে তালেবানি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। ইতিমধ্যে দেশটির নাম বদলে ইসলামি আমিরাত করা হয়েছে। কোনো রকম নির্বাচন ছাড়াই ৩৩ সদস্যের একটি সরকার গঠিত হয়েছে। সরকারপ্রধান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে একজন আমিরকে, দেশের কারও সে আমির বা সরকারপ্রধানে আস্থা থাকুক বা না থাকুক। তালেবানি ‘মতাদর্শ’ অনুসারে এ সরকারে কোনো নারীর অংশগ্রহণ নেই। দেশের এক–চতুর্থাংশ মানুষ তাজিক, তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নামকাওয়াস্তে রাখা হয়েছে দুজন প্রতিনিধিকে। আর জনসংখ্যার ১০ শতাংশ শিয়া ধর্মভুক্ত হাজারা সম্প্রদায়, তাদের আদৌ কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই।
ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে আফগানিস্তানে কেন গণতন্ত্র গেলানো গেল না, সে বিষয়ে কোনো অর্থপূর্ণ গবেষণা চোখে পড়েনি। মার্কিন কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের সামরিক মিশনের ব্যর্থতা বিষয়ে যা বলেছেন, তা থেকে স্পষ্ট, তাঁরা মনে করেন, আফগানিস্তান দেশ হিসেবে এতটাই আদিম যে সেখানে পশ্চিমা ধাঁচের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। সেখানে মানুষ এখনো কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের বদলে নিজ নিজ গোত্রীয় নেতৃত্বের প্রতি অধিক আস্থাবান। ধর্ম সেখানে এখনো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৈনন্দিন অনুষঙ্গ। যে দেওবন্দি ইসলাম সেখানে চর্চা করা হয়, তাতে গৃহের বাইরে নারীর কোনো ভূমিকা নেই। ফলে মার্কিনরা যতই মেয়েদের জন্য স্কুল-কলেজ বানাক, বা ধরে-বেঁধে তাদের কাউকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিক, নারীর ব্যাপারে আফগানদের প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে গণতন্ত্র দূর অস্ত!
পশ্চিমা অর্থে যাকে আমরা গণতন্ত্র বলি, তা প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত দুটি—গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি নাগরিক সমর্থন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নাগরিক অংশগ্রহণ। আফগানিস্তানে এ দুটির একটিও ছিল না। আধুনিক তাত্ত্বিকেরা গণতন্ত্রের কার্যকারিতা বোঝাতে আজকাল সোশ্যাল ক্যাপিটল বা সামাজিক পুঁজির কথা বলেন। দেশের মানুষ যখন নিজ রাষ্ট্র বা সরকারব্যবস্থার ওপর নিজের মালিকানা অনুভব করে (‘এ দেশ আমার, এ সরকার আমার’) সেই মনোভাবের ভিত্তিতেই সামাজিক পুঁজি গঠিত হয়। একটি দেশে যেসব দল, উপদল বা সম্প্রদায় থাকে, তাদের মধ্যে সাধারণ সম্মতির ভিত্তিতে একটি ন্যূনতম মতৈক্য গড়ে ওঠে। সব সময় যে এই মতৈক্য লিখিত-পড়িত হতে হবে তা নয়, কিন্তু সর্বসম্মত এমন কিছু ব্যাপার থাকে, যা সবাই কমবেশি মেনে চলে। একসময় একে সামাজিক চুক্তি বলা হতো। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি ইংরেজ দার্শনিক হবস তাঁর প্রস্তাবিত সে তত্ত্বে বুঝিয়েছিলেন, ঈশ্বরের নির্দেশে নয়, সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ নিজেদের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে একমত হয়ে জীবনচারিতা অনুসরণে সক্ষম। আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ দেশের বিভিন্ন জাতি-উপজাতি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে তেমন কোনো সামাজিক চুক্তি নির্মাণ করতে পারেনি, ফলে গণতন্ত্রের জন্য যে সামাজিক পুঁজি চাই, গোড়া থেকেই তার খামতি রয়ে গিয়েছিল।
আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে যে পরীক্ষা চালানো হয়, তার ব্যর্থতা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট। ওপর থেকে ধরে–বেঁধে আর যা–ই হোক গণতন্ত্র নির্মাণ সম্ভব নয়। যে নামেই ডাকি না কেন, মার্কিন সামরিক নিয়ন্ত্রণে আফগানিস্তানে একটি ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা ছিল। যাদের সেখানে ক্ষমতায় বসানো হয়, তাদের আসল লক্ষ্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল না, ছিল যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং মাখনটা-দুধটা নিজেদের মধ্যে ভাগ–বাঁটোয়ারা করে নেওয়া।
একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণের লক্ষ্যে মার্কিনরা নয়া আফগানিস্তানের জন্য পশ্চিমা ধাঁচের বিচারব্যবস্থা চালু করেছিল। তার মানে কোর্ট-কাচারি, উকিল-মুহুরি ইত্যাদি। আমাদের দেশেও এ বিচারব্যবস্থা রয়েছে, ফলে আমরা জানি, এ ব্যবস্থার অধীন কতটা হ্যাপা পোহাতে হয়। মাস গড়িয়ে বছর হয়, কিন্তু মামলার কোনো সমাধান হয় না। এর আগে আফগানরা তাদের সব সমস্যা মেটাতে শরণাপন্ন হতো স্থানীয় মাতবর বা পঞ্চায়েতের কাছে। তারাই হয় মিটমাট করিয়ে দিত, নয়তো নিজেদের হিসাবমতো রায় দিত। এভাবেই চলেছে বছরের পর বছর। গণতন্ত্রের নামে নতুন যে ব্যবস্থা চালু হলো, তাতে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই হলো বেশি। শুধু যে দীর্ঘসূত্রতা তা নয়, দুর্নীতিও এ নয়া ব্যবস্থার একটা বড় লক্ষণ। ফলে আফগানরা কখনোই এ নয়া গণতান্ত্রিক বিচারব্যবস্থা মেনে নেয়নি।
তবে সমস্যার সেটাই প্রধান কারণ নয়। নতুন যে সরকার ও সরকারব্যবস্থা গঠিত হয়, তার নেতাদের অধিকাংশকেই বিদেশ থেকে ধরে–বেঁধে ক্ষমতায় বসানো হয়। প্রথম প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই সিআইএর এজেন্ট ছিলেন, এটা কোনো গোপন ব্যাপার ছিল না। যে দুই দফা তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, সে সময়ে তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল নিজ পরিবারের সদস্যদের জন্য আখেরাতের সুব্যবস্থা করা। তাঁর ছোট ভাই মাহমুদ কারজাই সান ফ্রান্সিসকোতে রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ করতেন। ভাই প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি এত অর্থের মালিক হন যে তাঁকে আফগানিস্তানের চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। আর শেষ প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির লেখাপড়া, চাকরি–বাকরি—সবই আমেরিকায়। প্রথমে জন হপকিনসে অধ্যাপনা, পরে বিশ্বব্যাংকের চাকরি। তালেবান আসার পর তিনি কয়েক স্যুটকেসে ডলার বোঝাই করে কাতারে পালিয়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব লোক দিয়ে গণতন্ত্র হবে—এ কথা তো পাগলেও আশা করে না।
আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে যে পরীক্ষা চালানো হয়, তার ব্যর্থতা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট। ওপর থেকে ধরে–বেঁধে আর যা–ই হোক গণতন্ত্র নির্মাণ সম্ভব নয়। যে নামেই ডাকি না কেন, মার্কিন সামরিক নিয়ন্ত্রণে আফগানিস্তানে একটি ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা ছিল। যাদের সেখানে ক্ষমতায় বসানো হয়, তাদের আসল লক্ষ্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল না, ছিল যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং মাখনটা-দুধটা নিজেদের মধ্যে ভাগ–বাঁটোয়ারা করে নেওয়া। আর সে জন্যই সামাজিক পুঁজি নির্মাণের বদলে তাঁদের সব মনোযোগ ছিল তাঁবেদার বা অনুগত কিছু মানুষ বা পাতিনেতা গড়ে তোলা।
পৃথিবীর সবখানেই ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার এ চরিত্র। মার্ক্সবাদীরা মধ্যস্বত্বভোগী এ শ্রেণিকে ‘কম্প্রাডর বুর্জোয়া’ নামে অভিহিত করে থাকে। আজকাল তাদের অবশ্য এলিট বলেই ডাকা হয়।
আফগানিস্তানে গণতন্ত্রের এ ব্যর্থ পরীক্ষা থেকে তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের পথে আগুয়ান দেশগুলোর শিক্ষা গ্রহণের কিছু ব্যাপার রয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই নির্বাচনব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। ফলে গণতন্ত্রের নামে যে সরকার সেখানে গঠিত হয়, অনেক সময়ই সে সরকারের প্রতি দেশের মানুষের কোনো মালিকানাবোধ থাকে না। আফগানিস্তানে ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছিল। ক্ষমতা যখন অল্প কিছু লোকের হাতে চলে যায়, দেশের অধিকাংশ মানুষ সে ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করে।
আফগানিস্তানে এ ব্যাপারটিও ঘটেছিল। দেশের সব মানুষ নয়, অল্প কিছু লোক এ ব্যবস্থা থেকে ফায়দা পেয়েছিল। আর তৃতীয় যে ব্যাপারটি আফগানিস্তানের সর্বনাশ ডেকে আনে, তা হলো সর্বব্যাপী দুর্নীতি। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এটি একটি পরিচিত অভিজ্ঞতা।
ক্ষমতা ও সরকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, দুঃশাসন ও দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ মানুষ পোশাকি গণতন্ত্রের বদলে বিকল্প কোনো পথ খোঁজে। আফগানিস্তানে ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে সেই বিকল্প হিসেবে কারও কারও চোখ রয়েছে ধর্মের দিকে। আমাদের জন্য আসল ভয় এখানেই।
হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক