বিশ্বের দৃষ্টি এখন মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে সংযোগকারী বিশ্ব ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্থান আফগানিস্তানে। আফগানিস্তান থেকে ২০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ইসলামিক কট্টরপন্থী হিসেবে বিবেচিত যে তালেবানকে বিতাড়িত করেছিল, তারা এখন ক্ষমতায়। এই ২০ বছরে পশ্চিমা শক্তি সেখানে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। আফগানিস্তানে পশ্চিমা শক্তির এই পতনের পর বিশ্বব্যাপী ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব মোড়লির সক্ষমতা নিয়ে তর্কবিতর্ক চলছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান নিয়ে গঠিত ইন্দো প্যাসিফিক সিকিউরিটি বা কোয়াডের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আফগান ইস্যুতে ভারতের পিছিয়ে থাকা পররাষ্ট্রনীতি এবং এর ব্যর্থতা নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য বিবেচনায় নিলে এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদে যেসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, তা আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী দেশ ইরান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, চীন ও পাকিস্তানের জন্য বেশ উদ্বেগজনক। অন্যদিকে তালেবানপূর্ব আফগানিস্তানে ভারতের যে প্রভাব ছিল, সেটা এখন যেমন খর্ব হবে, তেমনি তালেবানের উত্থান ভারতের নিরাপত্তার জন্য বাড়তি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে দেশটির নিরাপত্তা ও ভূকৌশল বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ করলে যা দাঁড়ায়, তা হলো আইএস (কে) এবং টিটিপি (তেহরিক–ই–তালেবান পাকিস্তান) ছাড়াও আল–কায়েদা ইন সাবকন্টিনেন্ট এবং মধ্য এশিয়ার কয়েকটি উগ্রপন্থী সংগঠন গত ২০ বছরের যুদ্ধে তালেবানের সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে।

এসব গোষ্ঠীর সঙ্গে বিশেষ করে হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে তালেবান নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ বজায় রেখেছে এবং তা এখনো অটুট। যদিও বিগত বছরে আফগানিস্তানের ভেতরে বড় কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়নি এবং টিটিপি ছাড়া আর কোনো সংগঠনের তেমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, টিটিপিকে ভারত এবং আশরাফ গনি সরকার পাকিস্তানে চীনা টার্গেটের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এমনকি পাকিস্তানের অভিযোগ, ভারত আফগান সরকারের সহযোগিতায় বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎসাহ দিয়েছে।

তালেবান ক্ষমতায় আসার আগে স্পষ্ট করে বলেছে, আফগানিস্তানের মাটি অন্য দেশের বিরুদ্ধে কোনো গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতে দেবে না। এরপরও প্রতিবেশী দেশগুলো বিশ্বাস রাখতে পারছে না। একইভাবে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদেশগুলো একধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজে এবং তার চাপে বিশ্বব্যাংক আফগান রিজার্ভ অর্থ ছাড় দিচ্ছে না। এটা আফগানিস্তানের সাধারণ জনগণের ওপর চাপ তৈরি করছে। এমন পরিস্থিতিতে কাতার তালেবানশাসিত আফগানিস্তানে সম্ভাব্য সন্ত্রাসীদের উপস্থিতির অজুহাতে দেশটিকে একঘরে না করার পরামর্শ দিয়েছে।

আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে কোনো দেশ এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। সম্ভবত পূর্ণাঙ্গ সরকার গঠনের অপেক্ষায় রয়েছে। তালেবানের সামনে অন্যান্য বড় চ্যালেঞ্জ ছাড়া কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক দুটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর একটি অভ্যন্তরীণ পানশির উপত্যকাসহ প্রদেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। মনে রাখতে হবে, পানশির উপত্যকায় এ বিরোধ অতীতের মতো নয়। অতীতের মতো যে শক্তি এবারও প্রয়াত আহমেদ শাহ মাসুদের উত্তরসূরি আহমেদ মাসুদকে সাহায্য দিতে পারত, সেসব যুদ্ধবাজ নেতা তাঁদের শক্তি হারিয়েছেন এবং পলাতক অবস্থায় রয়েছেন। পানশিরের পতন এবং এর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যই হয়তো বিলম্বিত হচ্ছে তালেবানের সরকার গঠন।

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি ভূরাজনৈতিক। বিশেষ করে রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও ইরানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করা। মধ্য এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ তাজিকিস্তান ছাড়া বাকি দুই দেশ উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান কিছুটা উদ্বিগ্ন হলেও নিজ স্বার্থে এবং রাশিয়ার সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তির কারণে কিছুটা নির্ভার রয়েছে।

বিভিন্ন তথ্য, সূত্র ও গবেষকদের মতে, মধ্য এশিয়ার অন্যতম উগ্র ইসলামি সংগঠন হচ্ছে ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তান বা আইইউএম। সংগঠনটি রাশিয়ার আধিপত্য এবং মধ্য এশিয়ার কথিত দুই ইসলামি দেশ উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান সরকারের বিরোধী। আইইউএম তালেবানের উত্থানে সহযোগিতা করে আসছে। উগ্রপন্থী এ ইসলামিক সংগঠন সোভিয়েত সেনাবাহিনীর কমান্ডো সদস্য জুমা নামানগানি ও তাঁর সমর্থকদের নিয়ে গঠিত। পুরো মধ্য এশিয়ায় তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাবুলসহ আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে তালেবান–সমর্থক এই সংগঠনের সক্রিয় কার্যক্রম রয়েছে। তালেবানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হলেও উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তানসহ রাশিয়াকে তালেবান এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আফগানিস্তানের মাটি তাদের বিরুদ্ধে কোনোভাবেই ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।

দ্য ইস্ট তুর্কমেনিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টের সঙ্গে আইইউএমের যুক্ততা রয়েছে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে উইঘুর মুসলিমদের উগ্রবাদী সংগঠন। তালেবান চীনকে আশ্বস্ত করেছে, এ ধরনের সংগঠনগুলোকে আফগানিস্তান থেকে কোনো ধরনের তৎপরতা চালাতে দেবে না। শুধু তা–ই নয়, উইঘুর মুসলিম অথবা কথিত পূর্ব তুর্কমেনিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে তালেবানদের কোনো সম্পৃক্ততা থাকবে না। তালেবানের এই আশ্বাসে আপাতত চীন সন্তুষ্ট বলেই মনে হয়। উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে তালেবান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের আগেই যোগাযোগ ও আলোচনা হয়েছে। এ দুই দেশ থেকে তালেবান যেমন স্বীকৃতির আশা রাখে, তেমনি নিজ স্বার্থে দেশ দুটি তালেবানের সঙ্গে বেশ কিছু বছর যোগাযোগ রক্ষা করে আসছে। আফগানিস্তানে উজবেকদের বড় ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। উজবেকিস্তানের তুলা ও অন্যান্য সামগ্রী রপ্তানির ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করতে হয়।

তুর্কমেনিস্তান রাশিয়া কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের যে পরিকল্পনা করছে, তাতে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতের যুক্ত হওয়ার কথা। এই উদ্যোগ তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান এবং ভারত (ইন্ডিয়া) বা টিএপিআই পাইপলাইন হিসেবে পরিচিত। কাজেই আইইউএম নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ থাকলেও তুর্কমেনিস্তান তালেবানদের ওপর ভরসা রাখতে চায়।

আফগানিস্তান ঘিরে যে জটিল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা শুধু ওই অঞ্চলেই নয়, উপমহাদেশের ভূরাজনীতি ও ভূকৌশলগত অবস্থানেও দ্রুত পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে গভীর পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

তবে প্রতিবেশী যে দেশের সঙ্গে তালেবানের এখনো তেমন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, সেটি তাজিকিস্তান। এর প্রধান কারণ আফগানিস্তানে তাজিকদের তালেবানবিরোধী মনোভাব। আফগানিস্তানে তাজিকরাই দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী, প্রায় ২৭ শতাংশ। তাজিকিস্তানে নিষিদ্ধ ‘জামাত আনসারুল্লাহ’ তালেবানের সহযোগী হিসেবে বিবেচিত। কাজেই তাজিকিস্তান তথা রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে হলে তালেবানকে এদের সঙ্গ ছাড়তে হবে।

ইরান আগে তালেবানের পক্ষে ছিল না, তবে যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারত্বের পর থেকে ইরান আফগানিস্তানের হাজারা শিয়া সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত ও অস্ত্রসজ্জিত গোষ্ঠী ফাতেমউন গ্রুপ তৈরি করে সিরিয়ায় পাঠিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তালেবানের সহযোগী হিসেবে বিবেচিত আইএস (কে) ও আল–কায়েদার বিরুদ্ধে তাদের কাজে লাগিয়েছে। এখন ইরান চাইবে যে হাজারা শিয়াদের তালেবানদের সঙ্গে একীভূত করতে।

আগেই বলেছি, পাকিস্তানের মাথাব্যথার প্রধান কারণ টিটিপি, যারা কয়েক দিন আগে প্রথমবারের মতো কোয়েটায় আত্মঘাতী হামলা করেছে। তালেবানের পক্ষে এদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু আইএস (কে) বা ভারতের সমর্থনপুষ্ট বিএলএকে (বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি) তালেবান কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সেটা এক বড় প্রশ্ন। এই দুই গোষ্ঠী আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে তৎপর। পাকিস্তান চায় তালেবান এদের উৎখাত করুক। আবার আল–কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের (একিউআইএস) ভূমিকা এবং কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে। ভারতের অভিযোগ, এই গোষ্ঠী এখন তালেবানের সঙ্গে থাকলেও পাকিস্তান ভবিষ্যতে একিউআইএসকে ব্যবহার করতে পারে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সহযোগিতা পেতে হলে তালেবানকে প্রমাণ করতে হবে যে আল–কায়েদা বা আইএসসহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে বর্তমান তালেবানের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

আফগানিস্তান ঘিরে যে জটিল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা শুধু ওই অঞ্চলেই নয়, উপমহাদেশের ভূরাজনীতি ও ভূকৌশলগত অবস্থানেও দ্রুত পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে গভীর পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। তবে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো তালেবান ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে উপেক্ষা করলে তার ফল ভালো না–ও হতে পারে। উনিশ শতকের ‘গ্রেট গেম’ বিশ ও একুশ শতকে খেলতে গিয়ে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে আফগানিস্তানের আপামর জনগোষ্ঠীর। আফগান জনগণের পাশে দাঁড়ানো বিশ্ববাসীর নৈতিক কর্তব্য।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

[email protected]