আফগান সরকার ও তালেবান উভয়কেই ছাড় দিতে হবে

আফগানিস্তানের হেরাতে রাস্তায় টহলরত আফগান সেনাছবি: এএফপি

কাবুলের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্য রশি-টানাটানি চলছে। কিন্তু আফগান জনগণ সমর্থন না দিলে তাদের কারও ক্ষমতা যে কিছুতেই বৈধতা পাবে না, সে কথা উভয় পক্ষই মানতে নারাজ।

বর্তমান আফগান প্রশাসন এবং তালেবান—উভয় পক্ষকেই বুঝতে হবে, মধ্যযুগের মতো অবস্থা এখন আর নেই। আগের দিনে শাসক হলেই রাজনৈতিক ক্ষমতা শাসকের হাতে থাকত। কিন্তু এই জমানায় রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে রাখতে হলে অবশ্যই জনগণের সেবক হতে হবে। যখন যুদ্ধ ও শান্তি, প্রশাসন, সম্পদ আহরণসহ বিভিন্ন জাতীয় বিষয় সামনে আসে, তখন সেসব বিষয়ে জনগণের সিদ্ধান্তই শেষ কথা বলে বিবেচিত হয়।

গত বছর আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হওয়ার পরপরই থেমে যায়। এরপর থেকে আফগানিস্তানে বেসামরিক মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অর্থনীতিতে মহা ধস নেমেছে। খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোটি মানুষের জীবন অচল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থার দ্রুত অবসান হওয়া দরকার।

আফগান জনগণ স্পষ্টভাবেই দেখতে পাচ্ছে, দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাপন, তাদের সহায় সম্পদ ও ভালো-মন্দের বিষয়ে তালেবান ও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরস্পরবিরোধী। উভয় পক্ষই দাবি করছে, মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে তারা বৃহত্তর জনগণের মঙ্গলের জন্য লড়াই করছে এবং সহিংসতার পর তারা দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ এবং যুদ্ধরত পক্ষগুলোও বুঝতে পারছে, সামরিক পন্থায় এই সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এবং সামরিক পন্থার ওপর নির্ভর করার অর্থ আরও অনেক বেশি রক্তপাত ও সহিংসতা। এ কারণে দ্রুত সব পক্ষকে অস্ত্র বিরতিতে যেতেই হবে।

রাজনৈতিক সমাধান, শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মিটমাটের পথে না গেলে অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, রাজনৈতিক পরিকাঠামোর অকার্যকারিতা, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে না। দোহা চুক্তি স্বাক্ষরের পর আফগান জনগণ চলমান পরিস্থিতির দ্রুত একটি ইতিবাচক অগ্রগতি আশা করেছিল। এরপর এক বছর ধরে সুনির্দিষ্ট বিষয় ধরে আলোচনা না করে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধরত শক্তিগুলোর যে আলোচনা চলছিল, তা-ও স্থগিত হয়ে গেছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া সমঝোতায় বসা পক্ষগুলোর মধ্যে কার্যকর কোনো মিলমিশ সম্ভব হবে না।

এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংঘাতে, প্রতিটি পক্ষের বহু মানুষ হতাহত হয়েছে, বহু অর্থ সম্পদ নষ্ট হয়েছে এবং সব মিলিয়ে গোটা আফগানিস্তানের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। ইতিহাস থেকেই জানা যাচ্ছে, দুনিয়ার কোথাও তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়া বিবদমান পক্ষগুলোর পক্ষে সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তালেবানের প্রধান দাবি হলো, প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকারকে বিদায় নিতে হবে এবং সেখানে একটি অন্তর্বর্তী সরকারকে বসাতে হবে। এ ছাড়া আফগানিস্তানের জেলখানায় যে কয়েক হাজার তালেবান যোদ্ধা আটক রয়েছে, তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে।

প্রেসিডেন্ট গনি এবং তাঁর সরকারের কর্মকর্তারা মনে করছেন, তালেবানের এই দাবি যদি তাঁরা মেনে নেন, তাহলে সেটি সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হবে এবং এতে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর পুরো চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়বে। এই বিষয়ে দুই পক্ষ একমত হতে না পারার বিষয়টিই আলোচনায় অচলাবস্থা তৈরি করেছে।

এই অবস্থায় আফগান শান্তি মধ্যস্থতাকারী দল পিস মেডিয়েশন টিম (পিএমটি) সমাধানের রাস্তা বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মাঠপর্যায়ে অনেক গবেষণা করে এবং বিশেষজ্ঞ, প্রভাবশালী উপজাতীয় নেতা, প্রভাবশালী আলেম, তালেবানের ঘনিষ্ঠ সূত্র, নারী ও যুব সংগঠন ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তারা একটি রাস্তা দেখাতে পারে। এ বিষয়ে তারা অনেকখানি এগিয়ে এসেছেও। পিএমটি আফগান সরকারকে বোঝাতে চায়, রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থে তাদের অনেক বেশি ছাড় দেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে, যাতে বেসামরিক লোকের প্রাণহানি ঠেকানো সম্ভব হয়।

পিএমটি তালেবানকেও হুঁশিয়ারি দিতে চায়, আফগান রাষ্ট্র যদি ভেঙে পড়ে, তাহলে দেশটিতে মহা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে এবং তার খেসারত অনিবার্যভাবেই আফগান নাগরিকদের দিতে হবে। যদি তালেবান শান্তি আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে শুধু হাতিয়ারের জোরে ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাদের ওপর আন্তর্জাতিক অবরোধ আসার আশঙ্কা আছে। পিএমটির সদস্যরা যথেষ্ট প্রভাবশালী এবং তাঁরা উদ্যোগ নিয়ে আফগান সরকার ও তালেবান প্রতিনিধিদের আলোচনায় বসানোর চেষ্টা করতে পারেন।

পিএমটি মনে করে, ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তা আফগানিস্তানে একটি শান্তিপূর্ণ সরকার গঠনের বাতায়ন খুলে দিয়েছে। এই চুক্তি দেশটিতে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি নৈতিক তাগিদ সৃষ্টি করেছে। পিএমটি চায়, এই শান্তি উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের পাশে এসে দাঁড়াক। তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের সমঝোতা বৈঠক আয়োজনে কাতার সরকারের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। পিএমটি চায়, তালেবান নেতাদের আলোচনার টেবিলে আনার ক্ষেত্রে পাকিস্তান আরও সক্রিয় হোক।

সামরিক উপায়ে যে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, সে বিষয়টি আফগান সরকার এবং তালেবানকে বুঝিয়ে তাদের আলোচনায় বসানোর মহান দায়িত্ব এখন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নেতাদেরই নিতে হবে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

তাজ আইয়ুবী আফগান পিস মেডিয়েশন টিমের সদস্য