আমাদের মুক্তি অর্জন কোন পথে?

Sarfuddin Ahmed

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন উপলক্ষে আমাদের আজ প্রশ্ন করা দরকার: যে লক্ষ্য, আদর্শ, অঙ্গীকার ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তার কতটুকু আমরা অর্জন করতে পেরেছি? আর অর্জিত না হলে আমাদের এখন করণীয় কী?

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে সিপিডি আয়োজিত সাম্প্রতিক এক সম্মেলনে অধ্যাপক রেহমান সোবহান দাবি করেছেন যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। আর এ মুক্তির সংগ্রাম মূলত অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, যে অধিকারগুলোর উৎস আমাদের স্বাধীনতার পেছনের আদর্শ ও মূল্যবোধ নাগরিক হিসেবে যেগুলো আমাদের প্রাপ্য এবং যেগুলো প্রদানে রাষ্ট্রও অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু এ অধিকারগুলো এখনো বহুলাংশে অপূর্ণই রয়ে গেছে। প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’

এটি আজ সুস্পষ্ট যে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হলে, আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। এর জন্য অবশ্যই প্রয়োজন হবে আমাদের প্রাপ্য অধিকারগুলো অর্জন, যার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজেই আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছিলেন। আর এ অধিকারগুলোই বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনের আদর্শ, অঙ্গীকার ও মূল্যবোধের প্রতিফলন।

তবে বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনের আদর্শ, অঙ্গীকার ও মূল্যবোধগুলো কী কী? আমাদের স্বাধীনতার পেছনের আদর্শ, অঙ্গীকার ও মূল্যবোধ এবং এগুলোর বিবর্তন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হলে আমাদের তিনটি সময়ের কথা বিবেচনায় নিতে হবে: স্বাধীনতাপূর্ব, যখন মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল; স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়, যখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছিল এবং বর্তমান সময়, যখন আমাদের বিরুদ্ধে অধিকার হরণের, তথা ‘মুক্তি’র পথ থেকে সরে আসার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। প্রসঙ্গত, সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনের এসব আদর্শ ও মূল্যবোধের বিবর্তন ঘটেছে এবং প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এগুলোর নতুন ব্যাখ্যা হাজির হয়েছে।

আরও পড়ুন

এটি অনস্বীকার্য যে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে শক্তি, সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১-এর আমাদের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। আমাদের সংবিধান প্রণয়নের আগপর্যন্ত এই ঘোষণাপত্রই ছিল বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান। এতে বঙ্গবন্ধুর ‘জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা’র অনুমোদন দেওয়া হয়।

একই সঙ্গে এই ঘোষণাপত্রে ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা’ করা হয়; অর্থাৎ জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার হলো বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনের আমাদের প্রথম সংবিধান স্বীকৃত আদর্শ ও মূল্যবোধ। এসব আদর্শ স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ের প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত, তখনো বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

এসব আদর্শকেই ১৯৭২ সালে আমাদের সংবিধান রচনাকালে অঙ্গীকারে পরিণত হয়। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে; আমরা আরও অঙ্গীকার করতেছি যে আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’; অর্থাৎ স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত আদর্শ ও মূল্যবোধগুলোই পরিমার্জিত রূপে আবির্ভূত হয় ১৯৭২ সালে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের অঙ্গীকার হিসেবে। ‘(১) জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সব নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে। (২) এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ পরিচালনার মূলসূত্র হইবে, আইন-প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকের কার্যের ভিত্তি হইবে, তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না।’

প্রসঙ্গত, এসব অঙ্গীকারের অনেকগুলোই মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক-নাগরিক অধিকার ও আইনের শাসনের উৎস, যা আমাদের সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার হিসেবে এবং সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং এর অনেকগুলোই আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য।

আরও পড়ুন

রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতি আমাদের সংবিধানের ৯, ১০, ১১ ও ১২ অনুচ্ছেদে আরও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অনুচ্ছেদ ৯-তে বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি বলে আখ্যায়িত করা হয়। অনুচ্ছেদে ১০-এ সব শোষণ-বঞ্চনার অবসানের লক্ষ্যে সাম্যবাদী সমাজ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়।

অনুচ্ছেদে ১১-তে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করা হয়, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশ গ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’
অনুচ্ছেদ ১২-তে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার ওপর নিপীড়ন’ বিলুপ্ত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়।

সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং এর অনেকগুলোকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, এসব অঙ্গীকার আজও প্রায় অপূর্ণই থেকে গেছে। গত ৫০ বছরে কোনো সরকারই এগুলো অর্জনে এগিয়ে আসেনি, যদিও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি অর্জন করতে হলে এই মূলনীতিগুলোকে আমাদের বাস্তবে রূপ দিতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন হবে এগুলোর সময়োপযোগী সংজ্ঞায়ন, ব্যাখ্যা দান এবং এগুলোকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিণতকরণ।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি উন্নত, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, ন্যায্য ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমেই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য হতে হবে ধর্ম-বর্ণ, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও জাতিগত বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, বিশেষত কতগুলো মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি। সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা হতে হবে সামাজিক ন্যায়বিচার, বৈষম্যের অবসান এবং সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা।

গণতন্ত্রের লক্ষ্য হতে হবে মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, নাগরিক অধিকার, আইনের শাসন, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি এবং জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা প্রদান। ধর্মনিরপেক্ষতার লক্ষ্য হতে হবে বহুত্ববাদ ও অন্তর্ভুক্তকরণ, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সহনশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা; অর্থাৎ এগুলোকে কার্যকর করতে হলে কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এবং প্রেক্ষাপট বদলের কারণে আমাদের মূল্যবোধগুলো সম্পর্কে ধারণাগত পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

পরিশেষে, এটি সুস্পষ্ট যে বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ অর্জন করতে হলে আমাদের স্বাধীনতার আদর্শ, অঙ্গীকার ও মূল্যবোধগুলোর বাস্তবায়ন জরুরি। কারণ, এগুলোই আমাদের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের উৎস এবং এ-সম্পর্কিত রাষ্ট্রের অঙ্গীকারের ভিত্তি; অর্থাৎ এগুলোই আমাদের মুক্তির রক্ষাকবচ, যে মুক্তির জন্য আমাদের বীর সেনানীরা বিনা দ্বিধায় প্রাণ দিয়েছেন। সুতরাং এ মূল্যবোধগুলো যাতে বাস্তবে রূপায়িত হতে পারে, সে লক্ষ্যে প্রয়োজন বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে এগুলোর সংজ্ঞায়ন ও স্পষ্টীকরণ। তাহলেই এগুলো বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে, সব অন্যায্যতার অবসান হবে এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের ঋণ শোধ হবে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুজনÑসুশাসনের জন্য নাগরিক