আমার হুইলচেয়ারটা পরিবর্তন করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রায় সাত বছর হয়ে গেল এই হুইলচেয়ারের। আমার ফিজিওথেরাপিস্ট মার্ক ম্যাকডোনাল্ড বলেছিলেন, ‘এই হুইলচেয়ার কিন্তু তুমি বেশি দিন ব্যবহার করতে পারবে না। কারণ, এটি বেশি দিন ব্যবহারের উপযোগী নয়।’ আমি কৌতূহলী হয়ে মার্ককে বলেছিলাম, ‘কেন, এই চেয়ারে কী সমস্যা?’ উনি তখন বলেছিলেন, ‘এসব চেয়ারের গুণগত মান খুব একটা ভালো না। তোমাকে বছরখানেকের মধ্যে এর চেয়ে ভালো চেয়ার কিনতে হবে।’ আমি কিছু না বুঝেই বলেছিলাম, ঠিক আছে। কিন্তু আমি ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হয়েছিলাম, কারণ হুইলচেয়ারের দাম যে এত বেশি হতে পারে, তা আমি জীবনে কখনোই ভাবিনি। পরে অবশ্য বুঝেছি, মান ভালো হলে দামও বেশি হবে। যদিও অস্ট্রেলিয়ায় যেকোনো জিনিসের দাম যেকোনো জায়গার চেয়ে বেশি আর মেলবোর্নে তো আরও বেশি।
১৬৫৫ সালের দিকে এক জার্মান ঘড়িনির্মাতা তাঁর নিজের ব্যবহারের জন্য হুইলচেয়ার তৈরি করেন। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, সম্ভবত ১৫০০ শতকের দিকে হুইলচেয়ারের আবিষ্কার হয়। খুব অদ্ভুত লাগে যে একজন মানুষের বানানো বা উদ্ভাবিত কোনো জিনিস দ্বারা পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষ কীভাবে উপকার লাভ করে! তাহলে যে মানুষের কারণে পৃথিবীর অজস্র এবং অসংখ্য মানব উপকার লাভ করে যাচ্ছে, সেই মানুষ নিশ্চয়ই পরকালে সৃষ্টিকর্তার নিকট বিশেষ সুবিধা লাভ করেন।
হুইলচেয়ারটি আমার প্রায় আশি কেজি ওজনের শরীরটিকে বহন করে চলেছে খুব ভালোভাবেই। কী যে জরুরি এই চার চাকার বাহন আমার কাছে, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমার মতো মানুষ, আমরা যারা পক্ষাঘাতের মতো একটি জটিল বিষয়ের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করি এবং জীবনকে উপভোগ করার জন্য চলাফেরা আর ঘোরাঘুরি করতে চাই, আমরা হুইলচেয়ার ছাড়া আমাদের জীবন কল্পনাই করতে পারি না। কী আশ্চর্য; আমি কি জীবনে কখনো ভেবেছিলাম যে হুইলচেয়ার হবে আমার যোগাযোগের প্রধান বাহন। কারণ, আমি ঘরে-বাইরে, গাড়িতে, ট্রেনে, বিমানে, জাহাজে বা যেখানেই যাই না কেন, এই চেয়ারে উঠেই আমাকে অন্যগুলোয় উঠতে হয়, চলতে হয়।
আমাকে জানানো হয়েছিল, আমি আর কোনো দিন হাঁটাচলা করতে পারব না। এমনকি আমি আর কোনো দিন দাঁড়াতেও পারব না। আমাকে যখন প্রথম বিছানা থেকে হুইলচেয়ারে বসানো হয়েছিল, তখন কেমন যেন একটি অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখতাম, চারদিকে কী হচ্ছে! কারণ, সবকিছুই আমার জন্য চরম অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।
হুইলচেয়ারটিকে চরম শত্রু বলে মনে হচ্ছিল। এই বসার বাহন যে আমার চিরস্থায়ী চলাচলের মাধ্যম হিসেবে সারা জীবন আমার সঙ্গে থাকবে, এটি আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। পরিণতি জানা সত্ত্বেও আমি নিজে নিজেই ভাবতাম, তোমাকে আমি ব্যবহার করব না এবং খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে দূরে সরিয়ে দেব। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী অন্য মানুষদেরও কেন জানি আমি কোনো দিনই বন্ধু ভাবতে পারিনি। আমি সব সময় তাদের থেকে দূরে দূরে থাকতাম এবং আমি ভাবতাম, আমি তো তোমাদের দলের লোক নই আর আমি কোনো দিন তোমাদের দলে ভিড়তে চাই না, তোমাদের সঙ্গে থাকতেও চাই না। আমার মনে হতো, যেহেতু কিছুদিন পরই আমি আবার সাধারণ মানুষের মতো হাঁটাচলা শুরু করব, তাহলে কেন এই হুইলচেয়ারে চলাচলকারী মানুষদের সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব করব!
আমি আমার হুইলচেয়ারকে আপন ভাবা শুরু করলাম এবং এই চেয়ারের ওপর ভর করে বা বসে থেকে আমাকে আমার বাকি জীবন পার করতে হবে, ব্যাপারটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে থাকলাম। ধীরে ধীরে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষেরা আমার বন্ধু হতে থাকলেন এবং আমি নিজেকে তাঁদের দলের মানুষ হিসেবে ভাবা শুরু করে দিলাম।
আমার আরও খুবই বিরক্ত লাগত তাঁদের কিছু কাজকর্ম দেখে। যেমন প্রায় সময়ই দেখতাম যে তাঁরা বেশ হাসিখুশি থাকতেন, অন্য সাধারণ মানুষের মতোই কাজকর্ম করতেন, ঘুরে বেড়াতেন। যদিও সেটা হুইলচেয়ারে বসেই। তাঁরা অন্য সব ভালো মানুষের মতোই সবকিছু করতেন এবং এমন ভাব করতেন যেন তাঁদের কিছুই হয়নি। হুইলচেয়ারের ওপর থাকার পরও তাঁরা সবকিছুই অন্য সাধারণ মানুষের মতো করতে চাইতেন। আমার প্রায়ই মনে হতো, তাঁরা ভালো থাকার অভিনয় করছেন, কিন্তু আসলে তাঁরা সুখে নেই। কীভাবে মানুষজন হুইলচেয়ারে করে জীবনে সুখী হতে পারে, এটা আমি কোনোভাবেই বুঝতে পারছিলাম না। যদিও বেশ কিছুদিন পরই আমার ভুলটি ভেঙে যায়।
এভাবে আমি দূরে দূরে থাকতাম হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী অন্যান্য মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে যখন বুঝতে লাগলাম এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আমি যখন মেনে নিতে শিখলাম যে আমি হয়তো আর কখনোই হাঁটাচলা করতে পারব না, তখন থেকেই আমার মনের পরিবর্তন শুরু হয়, যা ছিল খুবই জরুরি আমার জন্য। সত্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সত্যকে যত তাড়াতাড়ি মেনে নেওয়া যায়, তা সবার জন্যই মঙ্গলজনক হয়, সেটা আমি বুঝতে পারলাম। আমি আমার হুইলচেয়ারকে আপন ভাবা শুরু করলাম এবং এই চেয়ারের ওপর ভর করে বা বসে থেকে আমাকে আমার বাকি জীবন পার করতে হবে, ব্যাপারটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে থাকলাম। ধীরে ধীরে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষেরা আমার বন্ধু হতে থাকলেন এবং আমি নিজেকে তাঁদের দলের মানুষ হিসেবে ভাবা শুরু করে দিলাম।
আমাদের জীবনের যেকোনো বাধা, ব্যথা, হতাশা, অনিশ্চয়তা বা পরিবর্তন হঠাৎই হয়ে থাকে। শারীরিক অসুস্থতা বা দুর্ঘটনার কারণে জীবনে যেসব পরিবর্তন ঘটে থাকে, তা মানসিকভাবে আমাদের সাংঘাতিক আঘাত করে। অসুস্থতা বা দুর্ঘটনার গভীরতার ওপর নির্ভর করে একেক মানুষের জীবন একেকভাবে এলোমেলো হয়ে যায়। শারীরিক সমস্যা তখন জড়িয়ে যায় আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সঙ্গে। এত সব সমস্যার মধ্যে মানুষ মানসিকভাবে চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যেভাবে আমি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম আমার জীবনে। অকস্মাৎ একটি সড়ক দুর্ঘটনা আমার জীবনকে চরমভাবে এলোমেলো করে দেয়। সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়, থেমে যায় এবং শেষ হয়ে যায়। আমার শারীরিক জটিলতার মাত্রা এতই বেশি ছিল বা আছে, যা তখন আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছিল, আর বোধ হয় সম্ভব না, আমি আর কোনোভাবেই পারব না। শারীরিক জটিলতার বেশ কিছু বিষয় আমাকে চরমভাবে হতাশার গভীরে ঠেলে দিচ্ছিল। যেমন যেদিন আমি শুনলাম যে বাথরুম (পায়খানা এবং প্রস্রাব) নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমি চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলেছি, সেদিন আমি মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি প্রচণ্ড বিচলিত ও বিক্ষিপ্ত ছিলাম আমার ভাগ্যের ওপর। শরীরের বিশেষ প্রয়োজনীয় এসব বিষয় আমি কীভাবে ম্যানেজ করব, তা আমি কোনোভাবেই বুঝতে পারছিলাম না।
একটা বিশাল দেওয়াল আমার সব স্বপ্ন আর ইচ্ছার পথের মধ্যে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল এবং আমার সব চিন্তাচেতনা পুরোপুরি লোপ পেয়ে গেল। চারদিকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। কোনোভাবেই কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমার বাকি জীবনের। সারা জীবন এই হুইলচেয়ারে কীভাবে চলব, কী করব, কীভাবে করব—কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
এভাবেই চলতে থাকে আমার চিকিৎসা ও পুনর্বাসন। আমার মানসিক চিকিৎসকেরা সব সময়ই আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন যে এই নতুন হুইলচেয়ারের জীবনকে আমাকে মেনে নিতে হবে এবং এভাবেও অনেক ভালো থাকা যায়। হুইলচেয়ারে বসে থাকা বেশ কিছু মানুষ আমাদের পুনর্বাসনকেন্দ্রে কাজ করতেন। তাঁদের পিয়ার কাউন্সিলর বলা হতো। তাঁদের কাজ ছিল আমাদের বোঝানো যে হুইলচেয়ারে বসে থেকেও স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়, যেটা তাঁরা করছেন। কিন্তু তাঁদের কথাবার্তা ও সঙ্গ আমার খুবই বিরক্তিকর লাগত।
এরই মধ্যে আমার প্রধান ফিজিওথেরাপিস্ট মার্কের একটি কথা আমার মনে ভীষণভাবে গেঁথে গেল। মার্ক খুবই দৃঢ়ভাবে একদিন আমাকে বললেন, ‘আসিফ, তুমি তোমার এই অবস্থা মেনে নাও মন থেকে। ভালো থাকা অবস্থায় তুমি কখনোই যে উচ্চতায় যেতে পারতে না, এই হুইলচেয়ার জীবনে বসে থেকে তার চেয়েও অনেক বেশি উচ্চতায় যেতে পারবে, যদি তুমি চাও। চিন্তাচেতনা আর কাজকর্মে পরিবর্তনের মাধ্যমে তুমি অনেক বেশি ভালো অবস্থানে চলে যেতে পারবে এবং তুমি অনেকের জন্য অনুকরণীয় হয়ে যাবে। কিন্তু তোমাকে অনেক কষ্ট করতে হবে।’
যদিও এসব কথার অর্থ ও গুরুত্ব আমি তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই বুঝতে পারিনি বা অনুধাবন করতে পারিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি এসব কথার মানে বোঝার চেষ্টা করতে থাকলাম মনে মনে। বিভিন্ন জ্বলন্ত এবং জীবন্ত উদাহরণ দেখে বা শুনে আমি বুঝতে পারছিলাম, কীভাবে এসব কথা জীবনের সত্যে রূপান্তরিত হতে পারে। আমি বুঝতে পারছিলাম, এই হুইলচেয়ার জীবনকে মেনে নিয়ে এবং এটিকে অবলম্বন করেই আমাকে আগামী দিনের পথ চলতে হবে। যেহেতু আমার পক্ষে থেমে যাওয়া সম্ভব নয়, তাহলে এতে করেই আমাকে এগিয়ে চলতে হবে। আমার দুই পায়ের মাধ্যমে যেহেতু আমি আর কোনো দিনই আমার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব না, তাই আমাকে এই হুইলচেয়ারের সাহায্যই নিতে হবে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য বা জায়গায় পৌঁছানো, কীভাবে পৌঁছালাম সেটা কিন্তু কোনো বিষয়ই হতে পারে না। যদিও বিষয়টি আমাদের মস্তিষ্কে অসাধারণ নিয়মে কাজ করে থাকে, যা সৃষ্টিকর্তা এভাবেই তৈরি করেছেন। আমরা যা চাই বা আমাদের নিজেদের যে লক্ষ্যে নিজেকে নিয়ে যেতে চাই, আমাদের মস্তিষ্ক ঠিক সেভাবেই পরিকল্পনা করে আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। জীবনের কঠিন বিষয়গুলো যত সহজভাবে মেনে নেওয়া যাবে, তা ততই ভালো হবে এবং জীবনকে সহজ করে দেবে। এই মেনে নেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ, যা আমরা সহজে নিতে পারি না।
আমাদের নিজেদের ভেতরের ইচ্ছাশক্তি হলো এর মূলমন্ত্র। ইচ্ছাশক্তি যত দৃঢ় ও মজবুত হবে, তত ভালোভাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে। আমার ইচ্ছাশক্তি এবং আমার সব স্বপ্ন আমার এই হুইলচেয়ারের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। আমি খুবই পরিষ্কার ও সহজভাবে বুঝে গিয়েছিলাম যে জীবনে এগিয়ে যেতে হলে আমাকে চাকাগুলোকে ঠেলে ঠেলেই যেতে হবে। হুইলচেয়ার ছাড়া আমি আমার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় কোনোভাবেই পৌঁছাতে পারব না। জীবনকে কোনোভাবেই থামানো যাবে না, এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যেমন আমি এগিয়ে চলছি ধীরে ধীরে আমার হুইলচেয়ারে বসে এবং কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি আরও লাখো মানুষ, যাঁরা হুইলচেয়ারে বসে আছেন এবং আমার মতো এগিয়ে যেতে চান, তাঁদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য।
আসিফ ইকবাল চৌধুরী প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মী