ধরুন, সকাল-বিকেল অফিস করতে করতে বয়স ৪৫ পার হয়েছে। আশপাশে লোকজন অগোচরে আপনাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। কারণ, আপনার কোনো বাড়ি নেই, গাড়ি নেই। ব্যাংকে ভালো ব্যালেন্স নেই। ছুটিছাটায় বউ-বাচ্চা নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে পারেন না। বাচ্চাটাকেও নামীদামি কোনো ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাঠাচ্ছেন না। পড়তে হচ্ছে সাধারণ বাংলা মাধ্যমে। তাও আবার সরকারি স্কুলে। কারণ, যে বেতন আপনি পান, তাতে বাসাভাড়া আর সংসার খরচ চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এত কিছু করা কীভাবে সম্ভব?
অন্যদিকে, একই অফিসে চাকরি করা অন্য একজনের ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে। দামি গাড়ি আর ছেলেমেয়েরা নামকরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। ঈদ আর পূজার বন্ধের সময় তারা সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া ঘুরতে যায়। আজকাল আবার শোনা যাচ্ছে কানাডায়ও নাকি বাড়ি কেনার চেষ্টা করছে।
যে সমাজে সবকিছু বিবেচনা করা হয় গাড়ি-বাড়ি-ব্যাংক ব্যালেন্স দেখে, যে সমাজ সৎ মানুষগুলোকে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে না, উল্টো পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে সৎ মানুষগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে পরাজিত মানুষ হিসেবে দেখা হয়, সে সমাজের মাঝে একজন, দুজন নয়, হাজারো-লাখো কিংবা কোটি মানুষ চাইবে, ‘আমি তো পি কে হালদারই হতে চাই!’
এ জন্য মানুষ আপনাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। ভাবে, আপনি একজন পরাজিত মানুষ। এ জীবনে কিছুই হবে না আপনাকে দিয়ে। শুধু সমাজের মানুষ কেন, আপনার পরিবারের আত্মীয়স্বজনও আপনাকে নিয়ে পরিহাস করে। কিন্তু তারা কখনো জানতে চায়নি, কী করে অন্যজন এত বাড়ি, গাড়ি ও সম্পত্তির মালিক হয়েছে। তারা কখনো জানতে চায়নি, এত অল্প বেতনে চাকরি করে কীভাবে সন্তানকে লাখ টাকার ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানো যায়। তারা বরং জানতে চেয়েছে, ‘কেন আপনার নেই?’
তখন হয়তো আপনার নিজেরও মনে হবে, সুযোগ তো আমারও ছিল। কেন আমি সেই সুযোগ নিলাম না। কেন আমি সৎ থাকার চেষ্টা করলাম। তখন হয়তো আপনার মনে হবে, ‘পি কে হালদারের মতো হলেই ভালো হতো।’
ধরুন, আপনি একজন চটপটি বিক্রেতা কিংবা খুব সাধারণ একজন কেরানি। কোনোভাবে আপনার জীবন কেটে যাচ্ছে। হঠাৎ একদিন আপনার সন্তানের শরীর খারাপ হয়েছে। দ্রুত ঢাকার হাসপাতালে নিতে হবে। পথে একটা ফেরি পার হতে হবে। কিন্তু ওই পথে একজন ‘সম্মানিত’ ব্যক্তি ঠিক ওই সময়ই যাচ্ছিলেন। ফেরিটি আপনাদের অ্যাম্বুলেন্সকে জায়গা না দিয়ে ওই ‘সম্মানিত’ মানুষের গাড়ি নিয়ে রওনা রয়েছে। আর আপনার সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পথের মাঝেই আপনার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। তখন হয়তো আপনার মনে হবে, ‘পি কে হালদারের মতো হলে আজ হয়তো আমার সন্তানকে বেঘোরে মরতে হতো না।’
ধরুন, আপনি ভীষণ রাজনীতি বোঝেন। দেশ ও সমাজ নিয়ে আপনার ভাবনার শেষ নেই। সিটি করপোরেশনের যানজট কীভাবে কমানো যায়, কীভাবে মানুষের দুর্ভোগ কমানো যায় ইত্যাদি নিয়ে আপনার কাছে ভালো ভালো পরিকল্পনা আছে। আপনি গেলেন বড় কোনো দল থেকে নমিনেশন নিতে। কারণ, আপনি আপনাকে একজন রাজনীতিসচেতন মানুষ হিসেবে মনে করেন। তো, আপনার কি ধারণা আপনি মনোনয়ন পাবেন? গিয়ে দেখবেন মনোনয়ন পাচ্ছে হালদারের মতো কেউ একজন। তখন আপনার মনে হবে, ‘কেন আমি পি কে হালদারের মতো হলাম না?’
হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যান; দেখবেন সিরিয়াল থাকা সত্ত্বেও স্রেফ টাকা আর ক্ষমতার জোরে অন্য কেউ আপনার আগে চলে গিয়েছে! জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেশের এ অবস্থা। অর্থ ও ক্ষমতাই হয়ে গিয়েছে আমাদের সমাজে সবকিছুর মানদণ্ড। সেখানে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে দেওয়া পি কে হালদারের ঘটনাকে হয়তো মনে হতে পারে একজন বিকিয়ে যাওয়া ব্যক্তির অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রকাশ। অনেক সময় আমরা সমাজ এবং সমাজের পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা ভুলে যাই।
যে সমাজে সবকিছু বিবেচনা করা হয় গাড়ি-বাড়ি-ব্যাংক ব্যালেন্স দেখে, যে সমাজ সৎ মানুষগুলোকে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে না, উল্টো পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে সৎ মানুষগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে পরাজিত মানুষ হিসেবে দেখা হয়, সে সমাজের মাঝে একজন, দুজন নয়, হাজারো-লাখো কিংবা কোটি মানুষ চাইবে, ‘আমি তো পি কে হালদারই হতে চাই!’
সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন যদি না ঘটে, এ সমস্যা আরও বাড়তে থাকবে। তখনো হয়তো দেশে জিডিপি বাড়বে। কারণ, পি কে হালদারের সংখ্যা তো বাড়তেই থাকবে। এমন হাজারটা পি কে হালদারের টাকার সঙ্গে হয়তো কোটি কোটি চটপটি বিক্রেতা কিংবা কেরানির বেতনের টাকা যোগ করে ভাগ করে জিডিপি বেড়ে যাবে। কিন্তু হালদার মশাইদের টাকা তো কখনো চটপটি বিক্রেতা কিংবা কেরানির কাছে যাবে না। তাদের টাকা যাবে ভারত, সিঙ্গাপুর কিংবা কানাডার বেগমপাড়ায়। ভাগ্য কেবল তাদেরই বদলাবে। মাঝখান থেকে কোটি মানুষের ভাগ্য আটকে যাবে এই ভাবতে ভাবতে, ‘আমি যদি পি কে হালদার হতে পারতাম।’
ড. আমিনুল ইসলাম, সিনিয়র লেকচারার ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগ, এস্তনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি।
ই-মেইল: [email protected]