আরব দেশগুলো যে কারণে ইসরায়েলের সামনে অবলা

ফিলিস্তিনের দুর্গতির জন্য সবচেয়ে বেশি দোষ দিতে হয় আরব দেশগুলোকে
ছবি: রয়টার্স

বহু আগে থেকেই ইসরায়েলিরা জানে, মগজের জোরই আসল জোর; বিচক্ষণ মগজই পেশিশক্তিকে শাসন করে। আর এই সত্য আরব শাসকেরা সবেমাত্র বুঝতে শুরু করেছেন।

গত মাসে টানা ১১ দিন গাজায় ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞ দেখল বিশ্ব। বিমান হামলায় ধসে পড়া ভবন থেকে ফিলিস্তিনিদের রক্তাক্ত দেহ বের করা হচ্ছিল।

দুনিয়ার সবাই জানে, এই ট্র্যাজেডির এখানেই শেষ নয়। এই ঘটনা আবার ঘটবে। ইসরায়েলের বিমান থেকে বোমা মারা এবং নির্বিশেষে ফিলিস্তিনিদের নিহত হওয়ার দৃশ্য দূরের আরব দেশগুলো থেকে সেখানকার নাগরিকেরা দেখেছেন। আরব নেতারা অন্তঃসারশূন্য নিন্দা প্রস্তাব করেছেন। পাশাপাশি পাকিস্তানের মতো কিছু দেশের নাগরিকেরা এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে মিছিল করেছে এবং ইসরায়েলের পতাকা পুড়িয়েছে।

ইসরায়েলের শিশুদের যখন বড় হয়ে আইনস্টাইনের মতো বড় হওয়ার, অর্থাৎ মগজের শক্তিতে শক্তিমান হতে পরামর্শ দেওয়া হয়, তখন আরব শিশুদের এখনো সালাহ উদ্দিনের মতো পেশিশক্তিতে শক্তিমান নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয়। এই বিষয়টি যত দিন থাকবে, তত দিন ইসরায়েলকে মোকাবিলা করা তাদের জন্য কঠিন হবে

ইসরায়েলে বড়জোর ৯০ লাখ মানুষের বাস। অর্থাৎ তাদের জনসংখ্যা আমাদের করাচি শহরের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক বা তার চেয়ে কিছু বেশি। তাদের কাছে যে তেল ভান্ডার আছে, তা–ও না। তারপরও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তেল সম্পদে সমৃদ্ধ ৪২ কোটি ৭০ লাখ আরব ইসরায়েলের কাছে নতজানু হয়ে আছে। উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর নেতারা পাকিস্তানের মতো ‘মিসকিন’ দেশগুলোর নেতাদের এক মিনিটের নোটিশে রিয়াদে তলব করতে পারেন এবং আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে বস্তাভরা চাল-গম দিয়ে আবার দেশে ফেরত পাঠাতে পারেন। কিন্তু যে ইসরায়েলের হাতে প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে কিছুই নেই, তাদের সামনে কেন আরব বাদশাহ ও শেখরা মাথা নুইয়ে থাকেন?

এর জন্য আপনারা পশ্চিমাদের, বিশেষ করে আমেরিকাকে দোষারোপ করতেই পারেন। তারা ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলো (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন ও জার্মানি) ইসরায়েলের কাছে ৯৬০ কোটি ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। এই ২০ বছরে সে তুলনায় আরব দেশগুলোর কাছে তারা অস্ত্র বেচেছে আরও অনেক বেশি। এই সময়ে সৌদি আরবকে তারা ২৯৩০ কোটি ডলারের, সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ২০১০০ কোটি ডলারের, মিসরকে ১৭৫০ কোটি ডলারের, ইরাকের কাছে ৯১০ কোটি ডলারের এবং কাতারে ৬০০ কোটি ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করেছে।

বাস্তবতা হলো, ইসরায়েল যদি কখনো আবার আরব ভূমিতে আক্রমণ করে, তাহলে এই অস্ত্র আরবদের রক্ষায় খুব একটা কাজে আসবে না। ফিলিস্তিনের আজকের এই দুর্গতির জন্য যদি কাউকে দোষারোপ করতে হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি দোষ দিতে হবে আরব দেশগুলোকে। কারণ, আরবরা ভয়ানকভাবে বিভক্ত।

৬৩০ থেকে ৭৫০ সালের এই মধ্যবর্তী সময়টুকুতেই শুধু তাদের এক থাকতে দেখা গেছে। এরপর ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সুয়েজ যুদ্ধে মিসরের নেতা নাসের জয়লাভের পর অতি অল্প সময়ের জন্য আরবরা এক হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে এই ঐক্য কোনো কাজেই আসেনি। আরব দেশগুলো ওই যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং এর ফলে গোটা অঞ্চলের মানচিত্রই বদলে যায়। ফিলিস্তিনিরা বছরের পর বছর মার খেলেও তারা ফাতাহ ও হামাস—এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে আছে।

ইসরায়েলের হাতে যে ক্ষমতা আছে, তা তাদের অস্ত্রশক্তির কারণে আছে তা নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করতে যে মগজাস্ত্র ব্যবহার করেছিল, ইসরায়েলও সেই একই অস্ত্র ব্যবহার করছে।

ভেবে দেখুন, মাত্র ৫০ হাজার শ্বেতাঙ্গ সেনা ভারতবর্ষে মোতায়েন করে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষকে আড়াই শ বছর শাসন করেছিল। তাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র ও কামান থাকলেও তাদের প্রকৃত অস্ত্র ছিল ভিন্ন। সেই ভিন্ন অস্ত্র হলো যুক্তিনির্ভর সুসংগঠিত চিন্তা। এই সুসংহত চিন্তার উন্মেষ ঘটে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও জাগতিক জ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে।

কিন্তু এই মস্তিষ্ক কোথায় তৈরি হয়? অবশ্যই মাতৃগর্ভে, কিন্তু স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিদ্যায়তনে এই মস্তিষ্কের বিকাশ হয়। এসব প্রতিষ্ঠান আরব দেশগুলোতে ইসরায়েলের চেয়ে কম নেই। কোটি কোটি ডলার খরচ করে তারা ইউরোপ আমেরিকা থেকে শিক্ষকও আনছে। কিন্তু তারা এগোতে পারছে না; কারণ, শিক্ষাসম্পর্কিত মূল ধারণাতেই তাদের গলদ আছে। তাদের উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যের মধ্যে সেক্যুলার চিন্তার অভাব রয়েছে। এসব দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর অনেক স্নাতক বের হয়। কিন্তু তারা চিন্তাচেতনায় পশ্চাৎপদ রয়ে যায়।

ইহুদি শিশুরা রোল মডেল হিসেবে আইনস্টাইন, নিয়েল বোর, র‌্যালফ লরেন, জর্জ সোরোসের মতো ব্যক্তিদের মনে স্থান দেয়। অন্যদিকে আরব শিশুর রোল মডেল হয়ে থাকেন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বা এরতুগ্রুল গাজির মতো সেনানায়ক।

ইসরায়েলের শিশুদের যখন বড় হয়ে আইনস্টাইনের মতো বড় হওয়ার, অর্থাৎ মগজের শক্তিতে শক্তিমান হতে পরামর্শ দেওয়া হয়, তখন আরব শিশুদের এখনো সালাহ উদ্দিনের মতো পেশিশক্তিতে শক্তিমান নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয়। এই বিষয়টি যত দিন থাকবে, তত দিন ইসরায়েলকে মোকাবিলা করা তাদের জন্য কঠিন হবে।

ডন পত্রিকা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

পারভেজ হুদভয় ইসলামাবাদভিত্তিক লেখক