যুদ্ধের দামামা তুঙ্গে উঠে গেছে। এ অবস্থায় রাশিয়া শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনে যদি অভিযান চালিয়েই বসে, তাহলে তা কীভাবে মোকাবিলা করা যেতে পারে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। বেশির ভাগ পশ্চিমা নেতা রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের অবরোধ আরোপের পক্ষে মত দিচ্ছেন। বিশেষ করে তাঁরা রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে দেশটিকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে যে বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে, তা হলো প্রায় একচেটিয়াভাবে পুনরুত্থিত একটি রাশিয়া এবং একটি ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষামূলক পশ্চিমের মধ্যে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বেঁধে গেছে।
২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ক্রিমিয়া ও পূর্ব ইউক্রেনে অভিযান চালিয়েছিল, তখন সবাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে খাকি পোশাকবিহীন সেনাদের বেআইনিভাবে সীমান্তের ওপারে পাঠানোর অভিযোগ তুলেছিল। সে সময় রাশিয়া সেই অভিযোগ এড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার রাশিয়া প্রকাশ্যে ইউক্রেন সীমান্তে তার সামরিক সংস্থান বাড়িয়েছে। রাশিয়া দাবি করছে, তারা যদি ইউক্রেনের ভূখণ্ডে অভিযান চালায়, তা হবে এ অঞ্চলে ন্যাটোর অসহনীয় সম্প্রসারণের একটি ন্যায্য প্রতিক্রিয়া।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন যে বেআইনি হবে এবং এর সব পরিণতির দায় একটি রাষ্ট্র হিসেবে যে রাশিয়াকেই নিতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আসলে এ ধরনের আগ্রাসন হলে তা শুধু ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করবে না, বরং এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শান্তি ও নিরাপত্তার ওপরও আঘাত হানবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো সংঘর্ষ বেঁধে গেলে উভয় পক্ষের অগণিত মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উচ্চপদস্থ সামরিক কিংবা বেসামরিক কর্মকর্তাদের যেকোনো আগ্রাসনকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। নুরেমবার্গ ট্রায়ালে ২৪ আসামির মধ্যে ১২ জনকে আগ্রাসনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। ওই সময় এটিকে ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’ বলে গণ্য করা হতো। এ অপরাধের সর্বনিম্ন সাজা ছিল ১০ বছরের জেল এবং সর্বোচ্চ সাজা ছিল মৃত্যুদণ্ড। অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) ১২৩টি সদস্যরাষ্ট্র রোম সংবিধিতে একাধিক সংশোধনী গ্রহণ করে আগ্রাসনকে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং এ অপরাধের ওপর আদালতের এখতিয়ার সক্রিয় করেছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন যে বেআইনি হবে এবং এর সব পরিণতির দায় একটি রাষ্ট্র হিসেবে যে রাশিয়াকেই নিতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আসলে এ ধরনের আগ্রাসন হলে তা শুধু ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করবে না, বরং এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শান্তি ও নিরাপত্তার ওপরও আঘাত হানবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো সংঘর্ষ বেঁধে গেলে উভয় পক্ষের অগণিত মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে।
আমরা অবশ্যই সেই নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা সম্পর্কে উদাসীন নই। আমরা জানি, ওই রোম সংবিধিতে আগ্রাসনের অপরাধকে একটি বিতর্কিত প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সেখানে এ অপরাধ আইসিসিতে যোগদান করেনি, এমন দেশগুলোর দ্বারা সংঘটিত আগ্রাসনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য রাখা হয়নি। যেহেতু রাশিয়া আইসিসির সদস্যদেশ নয়, সেহেতু রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালালে এ আদালত তার বিচার করতে সক্ষম হবে না। তবে এ আদালত ধারণাযোগ্যভাবে সেখানে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পারেন। কারণ, কিয়েভ ইতিমধ্যে আইসিসির এখতিয়ার স্বীকার করেছে এবং তারা ক্রিমিয়া ও পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়া যে অভিযান চালিয়েছিল, সে বিষয়ে তারা আইসিসিতে নালিশ জানিয়ে রেখেছে।
শুধু আইসিসি নয়, তার বাইরে আরও বিষয় আছে। ৪০টির বেশি দেশ অভ্যন্তরীণভাবে আগ্রাসনকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব দেশের কয়েকটি আছে, যারা আগ্রাসনকে সর্বজনীন অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এবং তারা মনে করে আগ্রাসন সব সময়ই বিচারযোগ্য অপরাধ, সে যে-ই ঘটাক না কেন, যেখানেই তা ঘটুক না কেন। ইউক্রেন নিজেই এ পর্যায়ভুক্ত একটি দেশ। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া ও পূর্ব ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর ইউক্রেন এ বিধানটি প্রয়োগ করেছিল। রাশিয়ার আগ্রাসনে সহায়তা করার জন্য ইউক্রেনের আদালত ওই বিধানমতে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের অনুপস্থিতিতে তাঁকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়ার অবৈধ অভিযানে যোগ দেওয়ায় তারা দুজন রুশ সেনাকে ১৪ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছিল।
এটি ঠিক যে ইউক্রেন বা তৃতীয় কোনো দেশে রাশিয়া হামলা চালালে রাশিয়ার সামরিক কিংবা সরকারি কর্মকর্তাদের আগ্রাসনের অপরাধে বিচারের মুখোমুখি করা হবে—এমন হুঁশিয়ারি রাশিয়াকে ইউক্রেনে অভিযান চালানো থেকে বিরত রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। তারপরও এ ধরনের অপরাধের জন্য বিচারের মুখে পড়তে হতে পারে—এমন একটি সম্ভাবনার বিষয়ে সতর্কতা দিয়ে রাখলে তা রাশিয়াকে কিছুটা হলেও ভাবাবে এবং যুদ্ধের সামনে ক্ষুদ্র হলেও একটি প্রতিবন্ধক প্রভাব ফেলতে পারে।
শুধু অপরাধীর বিচার করাই আন্তর্জাতিক আইনের তাৎপর্য নয়, সহিংসতাকে প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধ করায় ভূমিকা রাখাও এর একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিক। ইউক্রেনে হামলার সম্ভাব্য অপরাধের বিষয়টি এখন জোরালোভাবে সামনে তুলে ধরা দরকার। কারণ, এটি বাকি রাষ্ট্রগুলোকে ইউক্রেনকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করার জন্য আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে উৎসাহিত করতে পারে।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ফ্রেডরিক মেগরেট ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির আইন বিষয়ের অধ্যাপক
কেভিন জন হেলার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিষয়ের অধ্যাপক