উপমহাদেশে আম কূটনীতির ‘ফলন’ ভালো নয়

৫ জুলাইয়ের কাগজগুলোয় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য উপহার হিসেবে আম পাঠানোর খবর। ডেইলি স্টার-এর খবরে অবশ্য বলা হয়েছে, সীমান্তবর্তী রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রীরাও আম প্রাপকদের তালিকায় আছেন। সব মিলিয়ে আড়াই টনের বেশি (২৬০০ কেজি) আম ভারতে পাঠানো হয়েছে। এবার পাঠানো আমের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এসব আম রংপুরের হাঁড়িভাঙা জাতের। বলা হচ্ছে, এ জাতের আম ভারতে হয় না।

ঘনিষ্ঠতম মিত্র প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের একান্ত নিজস্ব রসনা ফল ভাগাভাগি করে নেওয়ার উদ্যোগ আপাতদৃশ্যে মহত্ত্বের পরিচায়ক। তবে ডেইলি স্টার-এর খবর অনুযায়ী আম যে শুধু ভারতেই গেছে, তা নয়, ভুটান এবং মধ্যপ্রাচ্যের ওমানের মতো দেশেও গেছে। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও কুয়েতেও শিগগিরই যাবে। স্বভাবতই ইঙ্গিত মিলছে যে এটি একটি কূটনৈতিক উদ্যোগ। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের এ খবরে উপমহাদেশে আম কূটনীতির ইতিহাসের কোনো উল্লেখ নেই। তবে ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজের মতো পোর্টালগুলোয় পাকিস্তানের দুই সাবেক সেনাশাসক জিয়াউল হক ও পারভেজ মোশাররফ এবং নওয়াজ শরিফের আম কূটনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

হাঁড়িভাঙা অথবা অন্য কোনো জাতের আম আমাদের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য দেশ, যেমন চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ইউরোপের দেশগুলোয় পাঠানো হচ্ছে কি না, তার কোনো উল্লেখ অবশ্য খবরে নেই। দুই বছর আগে বরিস জনসন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন ফজলি আম পাঠিয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। চাইলেই যে সব দেশে উপহার হিসেবে ফল পাঠানো যাবে, বিষয়টা অবশ্য এমন নয়। ধরা যাক, অস্ট্রেলিয়ায় আমরা উপহার পাঠাতে চাই। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হবে অস্ট্রেলিয়ার উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ সঙ্গনিরোধ আইন। দেশটিতে গাছপালা, ফলমূল ও প্রাণী আমদানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণ থাকায় এ ধরনের উপহার পাঠানো সহজ নয়।

কূটনীতির অংশ হিসেবে আমকে কাজে লাগানো সব সময় সহজ নয়। কলম্বো টেলিগ্রাফ-এ রাঙ্গা কালানসুরিয়ার এক নিবন্ধ থেকে জানা যায়, পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৭ সালে শ্রীলঙ্কায় শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের কাছে যে আম পাঠিয়েছিলেন, তিনি তা ফেরত দিয়েছিলেন। পত্রিকাটি চিঠির যে ভাষ্য উদ্ধৃত করেছে, তাতে লেখা হয়েছে, পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর রক্ত যে ব্যক্তির হাতে লেগে আছে, তাঁর কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করতে পারছি না বলে আমি দুঃখিত। ফাঁসিতে ঝোলানোর কারণে শ্রীমাভো ওই আমের চালান ফেরত দেন এবং শেষ পর্যন্ত কলম্বোয় পাকিস্তান দূতাবাসের কূটনীতিকদের সেগুলো হজম করতে হয়েছিল।

উপমহাদেশের আমের সুনাম আছে বিশ্বজুড়ে। এ কারণে উপহার হিসেবে আমের ব্যবহারও পুরোনো। ভারতবর্ষে মোগল আমল থেকে এই আমের সঙ্গে ক্ষমতা, কূটনীতি ও আনুগত্যের যোগসূত্রের নানা নজির রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে তাঁর পুত্র আওরঙ্গজেবের বিরোধ। দাক্ষিণাত্যের শাসক হিসেবে আওরঙ্গজেব সম্রাট শাহজাহানের দরবারে আম না পাঠানোর কারণে তাঁকে বন্দী করেছিলেন। পরে আওরঙ্গজেব যখন মসনদ দখল করেন, তখন পারস্যের সম্রাট শাহ আব্বাসের সমর্থন আদায়ের জন্য তাঁকে উপহার হিসেবে আম পাঠিয়েছিলেন। আম কূটনীতির সূচনা সম্ভবত তখন থেকেই।

ভারতে আম কূটনীতির সূচনা হলেও তার চর্চা সবচেয়ে বেশি করেছে পাকিস্তান। প্রায় প্রতিবছরই পাকিস্তানের নেতারা ভারতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী নেতাদের জন্য আম পাঠিয়ে থাকেন। তবে ভারত থেকে আম পাঠানোর কথা শোনা যায় না। অথচ আমের উৎপাদন ও বৈচিত্র্যে পাকিস্তান থেকে ভারত অনেক এগিয়ে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু চীনের মাও সে তুংকে একবার আম উপহার পাঠিয়েছিলেন—ট্রিবিউন ইন্ডিয়ার সাংবাদিক কে আর এন স্বামীর লেখায় উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া তাঁর আম কূটনীতির আর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ভারতের অন্য কোনো প্রধানমন্ত্রী ওই পথে হাঁটেননি। এমনকি পাকিস্তানের উপহারের আম ভারতের কূটনীতিতে যে কোনো প্রভাব ফেলেছে, তা-ও মনে হয় না। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা ও সালমান খুরশিদের জীবনীগ্রন্থ ও লেখনীতে আম কূটনীতির কোনো উল্লেখই পাওয়া যায় না।

বিপরীতে পাকিস্তান মাও সে তুংয়ের জন্য আম পাঠিয়েই থেমে যায়নি, দেশটির সরকারপ্রধানেরা ধারাবাহিকভাবে আম কূটনীতি চালিয়ে আসছেন। ভুট্টো ১৯৭২ সালেই ইন্দিরা গান্ধীকে আম পাঠিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন মি. কালানসুরিয়া। তবে গোল বাধে ১৯৮১ সালে যখন জেনারেল জিয়াউল হক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব রেড্ডিকে আম পাঠান। আমের সঙ্গে পাঠানো বার্তায় তিনি জানিয়েছিলেন যে এটি তাঁর দেশের সেরা আম। ‘রাতাউল’ নামের ওই আমের প্রশংসা করে স্বদেশে বিপত্তির মুখে পড়েন ইন্দিরা গান্ধী। রাতাউল নামের ওই আম পাকিস্তানের নিজস্ব কোনো জাত নয় বলে প্রতিবাদ জানান ভারতের রাতাউল জেলার আমচাষিরা। তাঁরা দাবি করেন, দেশভাগের সময়ে রাতাউল থেকেই আমগাছের কিছু চারা নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানে ওই জাতের চাষ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত রাতাউল আম দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বিরোধের জন্ম দেয়।

২০১৫ সালের জুলাই মাসে যখন সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষী ও সেনারা মুখোমুখি অবস্থানে এবং ড্রোন ভূপাতিত করা নিয়েও চলছে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ, তখন নওয়াজ শরিফও ভারতের নেতাদের জন্য আম উপহার পাঠিয়েছিলেন। তিনি পাঠিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি ও কংগ্রেস দলের প্রধান সোনিয়া গান্ধীর জন্য। এর আগে জেনারেল পারভেজ মোশাররফও প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির জন্য আম পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেবারও তাঁর দিল্লি সফরে কোনো সুফল আসেনি।

বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে আমার সাবেক সহকর্মী উর্দু বিভাগের সাবেক সম্পাদক বিশিষ্ট লেখক মোহাম্মদ হানিফ তাঁর ২০০৮ সালের উপন্যাস আ কেস অব এক্সপ্লোডিং ম্যাঙ্গোজ-এর কারণে দেশটির সামরিক বাহিনীর কোপানলে পড়েন। ওই বইয়ে তিনি লিখেছেন, জেনারেল জিয়া যে সামরিক বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার কারণে নিহত হয়েছিলেন, সেই বিমানে বিস্ফোরণের উৎস ছিল দুটি আমের ঝুড়ি। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর এক জুনিয়র অফিসার আলী শিগরি তাঁর বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে সি ১৩০ বিমানটিতে আমের ঝুড়িতে বিস্ফোরক তুলে দিয়েছিলেন। ভিন্ন এক সূত্র উদ্ধৃত করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছিল যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো বাংলাদেশ সফরের সময় বগুড়ায় এক পীরের দরগাহ সফরে গিয়ে তাঁর বাবার হত্যার বিচার পাবেন কি না, জানতে চেয়েছিলেন। কথিত সেই পীর মজিবুর রহমান চিশতি (পরে ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিজ বাসায় খুন হন) নাকি বেনজিরকে বলেছিলেন যে উড়ন্ত আমেই তাঁর পরিসমাপ্তি হবে।

আম এবং আম কূটনীতি নিয়ে উপমহাদেশের এসব চমকপ্রদ কাহিনির কোনোটিতেই অবশ্য কূটনৈতিক কোনো সাফল্যের প্রমাণ মেলে না। হিন্দুস্তান টাইমস-এর প্রতিবেদনে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সুসময়েও যেসব বিরোধ বজায় আছে, সেগুলোর কথাও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে চলমান কোভিড মহামারি মোকাবিলায় টিকার চুক্তিমতো প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ার কথা। ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ রাখায় প্রথম ডোজ নিয়ে দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় আছেন ১৫ লাখ মানুষ। এ কারণে অস্বস্তি বাড়ছে এবং বাংলাদেশ টিকার বিকল্প উৎসের সন্ধানে চীন, রাশিয়াসহ নানা দেশের শরণাপন্ন হচ্ছে।

অস্বস্তি যে শুধু টিকার জন্য, তা-ই নয়; যেদিন রংপুরের আম উপহারের খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, সেদিনই রংপুর তিস্তার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ছবি নানা নিউজ পোর্টালে প্রকাশ পেয়েছে। রংপুরের এই দুঃখের উৎস যে নদী, সেই তিস্তার আলোচনা নিয়ে অনিশ্চয়তা শুধুই বাড়ছে। ইলিশ পাঠিয়েও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মন গলানো যায়নি।

জানিয়ে রাখা ভালো, আম কূটনীতি নিয়ে অবশ্য এবারও বিপত্তি বেধেছে এবং তা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেই। গত জুন মাসে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বড় শিরোনাম হয় যে পাকিস্তানের পাঠানো উপহারের আম ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ কয়েকটি দেশ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি গত মাসের শুরুতে ৩২টি দেশে আম পাঠানোর উদ্যোগ নেন। গত ১৩ জুন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এসব খবর তথ্যভিত্তিক নয় এবং বিভ্রান্তিকর বলে বিবৃতি দেয়। স্পষ্টতই পাকিস্তানের আম কূটনীতি গত কয়েক দশকে তার প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরিতা কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের আম কূটনীতিতে কি ব্যতিক্রম কিছু মিলবে?

কামাল আহমেদ সাংবাদিক