এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত কেন

গত ২৪ মে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন, ২০১০ সংশোধনের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পরিবর্তে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগে হস্তান্তরের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ থেকে একটি লিখিত নির্দেশনা সুরক্ষা বিভাগ এবং ইসির সচিব বরাবর প্রেরণ করা হয়। এ সেবা প্রদানে নিয়োজিত বিদ্যমান জনবল এবং অবকাঠামো, যাতে রয়েছে বিভিন্ন উপজেলায় অবস্থিত ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজে ব্যবহৃত ৫৯৪টি সার্ভার স্টেশন ইসি থেকে সুরক্ষা বিভাগে হস্তান্তরও এ নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত।

সরকারের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিমধ্যে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ২৯ মে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সিইসি কে এম নূরুল হুদা এ হস্তান্তরের বিরোধিতা করে বলেন যে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কোনোরূপ আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এটি কমিশনের হাতেই থাকা উচিত। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার একটি সাম্প্রতিক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইসির শুধু অঙ্গহানিই হবে না, এর মাধ্যমে কমিশনের কফিনে শেষ পেরেক যুক্ত হবে।

এ ছাড়া সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. সাখাওয়াত হোসেন, বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকসহ আরও অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে এর মাধ্যমে নির্বাচন ও ভোটার তালিকা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হবে এবং কমিশনের স্বাধীনতা পদদলিত হবে। সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন এবং এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কাজও শুরু হয়ে গেছে। মন্ত্রী আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ভোটার তালিকা তৈরি করা। জাতীয় পরিচয়পত্র করার মতো সক্ষমতা তাদের নেই। (বাংলা ট্রিবিউন, ২ জুন ২০২১)।

নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৮ (৪) অনুযায়ী, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।’ কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠার কারণ হলো যাতে প্রতিষ্ঠানটি এর ওপর সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে অর্পিত দায়িত্বগুলো প্রভাবমুক্ত হয়ে সঠিকভাবে সম্পাদন করতে পারে, যার মধ্যে ‘সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত’ অন্যতম।

ভোটার তালিকা নিয়ে বাংলাদেশে বহুদিন থেকেই বিতর্ক বিরাজমান। অনেকেরই স্মরণ আছে যে বিচারপতি আজিজের নেতৃত্বে গঠিত ইসির আমলে ভোটার তালিকায় ১ কোটি ২০ লাখ ‘ভুয়া’ ভোটার থাকার অভিযোগ উঠেছিল, যার মূল কারণ ছিল একই ব্যক্তির একাধিক এলাকায় ভোটার হওয়া। বিষয়টি নিয়ে প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটে এবং শেষ অবধি এটি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। পরে ড. শামসুল হুদা কমিশনের তত্ত্বাবধানে, দাতাদের সহায়তায় এবং সেনাবাহিনীর উদ্যোগে ২০০৭ সালে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়। ভোটার তালিকাটি ‘ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেকটোরাল সিস্টেমস’ (আইইএফএস) নামক একটি বিখ্যাত আমেরিকান সংস্থা অডিট করে অভিমত দেয় যে এটি প্রায় নির্ভুল, যার ফলে আমরা সারা পৃথিবীতে প্রশংসা কুড়িয়েছি। বস্তুত ছবিযুক্ত এ ভোটার তালিকা আমাদের পুরো জাতির জন্য একটি গর্বের ধনে পরিণত হয়।

এ তালিকা এখনো বহুলাংশেই নির্ভুল, যদিও বর্তমান হুদা কমিশন ও এর আগের রকিবউদ্দীন কমিশনের অপারগতার কারণে ইতিমধ্যে এতে কিছু ত্রুটি দেখা গেছে। যেমন, ড. হুদা কমিশনের অধীনে প্রণীত ভোটার তালিকাটিতে পুরুষের তুলনায় ১৪ লাখের বেশি নারী ভোটার ছিলেন। কিন্তু পরে ভোটার নিবন্ধনের সময় নিবন্ধনকারীদের মূলত বাড়ি বাড়ি না যাওয়ার এবং কমিশনের তত্ত্বাবধানে দুর্বলতার কারণে ভোটার তালিকায় ‘জেন্ডার গ্যাপের’ তথা নারীদের তুলনায় পুরুষ ভোটার সংখ্যার আধিক্য দেখা দেয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাবে কিছু রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তবে ভোটার তালিকার এসব দুর্বলতা একটি নিরপেক্ষ ইসির নিবিড় তত্ত্বাবধানে ভবিষ্যতে সহজেই দূর করা যাবে।

সরকারকে অনুধাবন করতে হবে যে এনআইডির সঙ্গে ভোটার তালিকা এবং ভোট প্রদান গভীরভাবে সম্পর্কিত। বস্তুত ভোটার তালিকা থেকেই এনআইডি উৎসারিত ভোটার তালিকার ডেটাবেইস থেকেই ভোটার পরিচয়পত্র এবং পরে এনআইডির উদ্ভব, যা অন্য দেশ থেকে ভিন্ন। ফলে নির্দেশিত হস্তান্তর কার্যকর হলে ভোটার তালিকা সংরক্ষণের ও হালনাগাদের কোনোরূপ অবকাঠামো এবং জনবল নির্বাচন কমিশনে থাকবে না এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই ভোটার ডেটাবেইসের সংরক্ষণকারীতে পরিণত হবে, যা নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে বাধ্য।

জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগ নির্বাচন কমিশনের প্রায় পাঁচ হাজার জনবলের অংশ এবং তাঁদের দেশব্যাপী কমিশনের অন্য কাজও করতে হয়। তাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তরযোগ্য কোনো অতিরিক্ত জনবল কমিশনের থাকার কথা নয়। অর্থাৎ সরকারকে এনআইডি সেবা প্রদান করতে হলে নতুন জনবল নিয়োগ করতে এবং একটি সমান্তরাল অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তৃণমূল থেকে জন্মনিবন্ধনের যে কার্যক্রম চলমান আছে, তার ডেটাবেইস তৈরি করেই সরকার তা করতে পারে।

মন্ত্রী দাবি করেছেন যে এনআইডি তৈরি করার মতো ইসির সক্ষমতা নেই। তাঁর এ বক্তব্যের কোনো ভিত্তি নেই, কারণ ইতিমধ্যে কোনোরূপ উল্লেখযোগ্য সমস্যা ছাড়াই ১৩ বছরে কমিশন ১১ কোটির বেশি নাম তাদের ভোটার ডেটাবেইসে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং এদের অনেকের জন্য এনআইডি ইস্যু করেছে। আর এর অতিরিক্ত ব্যয়ও শুধু কাগজ ও প্রিন্টিংয়ের খরচ মাত্র। অর্থাৎ ভোটার তালিকা তৈরির কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই উল্লেখযোগ্য অতিরিক্ত ব্যয় ছাড়াই আমরা এখন এনআইডি পাচ্ছি।

মন্ত্রী আরও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এনআইডি তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন, যা তিনি করতেই পারেন। তবে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে, তাদের অজ্ঞাতে, ভোটার তালিকার ডেটাবেইস বিদ্যমান অবকাঠামো ও জনবল সরকারের কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেন না, কারণ এটি হবে আমাদের সংবিধানের ওপর একটি ‘এসল্ট’ বা আঘাত। এ ছাড়া অনেকেরই স্মরণ আছে যে ২০০৯ সালে ইসির স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এবং সুজন ও আরও অনেকের অব্যাহত অ্যাডভোকেসির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে স্থানান্তর করে স্বাধীন ইসির জন্য একটি স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।

এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন: সরকার কেন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে? এর পেছনে কি কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িত রয়েছে? এ হস্তান্তরের মাধ্যমে ১১ কোটির বেশি নাগরিকের বিভিন্ন তথ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে, যা রাজনৈতিকভাবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে অপব্যবহারের সুযোগ থাকবে। এ ছাড়া এনআইডি প্রদানের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের শর্ত জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি ও নানা ধরনের কারসাজি করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সর্বোপরি, মন্ত্রণালয় এ দায়িত্ব পেলে, সরকার তা ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নানা অজুহাতে এনআইডি থেকে বঞ্চিত করতে পারবে, যেমনিভাবে ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কারণে পাকিস্তান আমলে বর্তমান লেখককে পাসপোর্ট দেওয়া হয়নি। পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অজুহাতে অনেককে বর্তমান সরকারের আমলেই চাকরি থেকে বঞ্চিত, এমনকি নির্বাচনী দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়েছে।

সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো যেহেতু এনআইডি ভোটার-আইডি হিসেবে ইভিএমে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তাই এটিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে ভোটের ফলাফলকে প্রভাবিত করার সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নূরুল হুদা কমিশনের সহায়তায় আগের রাতের ভোটে ‘নির্বাচিত’ সরকারের পক্ষে তা করা কোনোভাবেই অসম্ভব নয়। এ ছাড়া ‘ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিআইটি) বিহীন ইভিএম ব্যবহার করে যা নূরুল হুদা কমিশনের আরেকটি ‘অবদান’ ‘ডিজিটাল টেম্পারিং’-এর মাধ্যমে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার সম্ভাবনা তো রয়েই গেছে, চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে যা আমরা দেখেছি!

ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)