এম এন লারমার সংগ্রাম শেষ হয়নি

এমএন লারমার সংগ্রাম ও সাধনা বৃথা যায়নি। যে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন, তাদের কিছুটা হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলেছে।
ছবি: প্রথম আলো

আজ ১০ নভেম্বর। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা। সাবেক পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ এবং বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের পার্বত্য চট্টগ্রাম-১ আসন থেকে নির্বাচিত সদস্য। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গেল শতকের ষাটের দশকে এম এন লারমা ও সন্তু লারমা (জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা) প্রমুখ রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরুর আগে পাহাড়ে শিক্ষা আন্দোলন করেছিলেন। এর অংশ হিসেবে চাকমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী প্রায় সবাই পেশা হিসেবে শিক্ষকতা বেছে নেন। তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন, কোনো জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। এ কারণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সার্বিকভাবে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকলেও চাকমা সম্প্রদায় এগিয়েছিল। এখনো এগিয়ে আছে।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের গণপরিষদে যে সংবিধান পাস হয়, তাতে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছিল না।

সংবিধানের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’

এর প্রতিবাদে ওয়াকআউট করেছিলেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এম এন লারমা। এর আগে খসড়া সংবিধানের ওপর গণপরিষদে যে বিতর্ক হয়, তাতে অংশ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সংবিধান হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা, যা অনগ্রসর জাতিকে, পিছিয়ে পড়া ও নির্যাতিত জাতিকে অগ্রসর জাতির সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে নিয়ে আসার পথনির্দেশ করবে। কিন্তু বস্তুতপক্ষে এই পেশকৃত সংবিধানে সেই রাস্তার সন্ধান পাচ্ছি না।’

এম এন লারমা ছিলেন এমন এক নেতা, যিনি শুধু তাঁর জাতিগোষ্ঠীর জন্য সংগ্রাম করেননি, লড়াই করেছেন বাংলাদেশের সব জাতির নিপীড়িত মানুষের জন্য।

এম এন লারমার জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়ারচরের বুড়িঘাট ইউনিয়নের মহাপুরম গ্রামে। তাঁর ডাকনাম ছিল মঞ্জু। জনসংহতি সমিতির নেতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র লারমা ওরফে সন্তু লারমা তাঁর ছোট ভাই। এম এন লারমার শিক্ষাজীবন শুরু মহাপুরম জুনিয়র হাইস্কুল থেকে। তিনি ১৯৫৮ সালে রাঙামাটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, ১৯৬৫ সালে বিএ, ১৯৬৮ সালে বিএড ও ১৯৬৯ সালে এলএলবি পাস করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদানের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এম এন লারমার রাজনীতিতে হাতেখড়ি গেল শতকের পঞ্চাশের দশকে, যখন তিনি স্কুলের ছাত্র। ১৯৫৭ সালে তিনি গড়ে তোলেন পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন এবং ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন।

এম এন লারমা বরাবর ছিলেন গণমানুষের মুক্তির পক্ষে। সমাজতন্ত্র, তথা শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর লক্ষ্য। ১৯৭০ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্তুঙ্গ জোয়ারেও তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ থেকে ব্যক্তি ও নেতা এম এন লারমার জনপ্রিয়তা অনুমান করা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অপর জনপ্রতিনিধি রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে হাত মেলালেও এম এন লারমা থেকে যান তাঁর জনগোষ্ঠীর একজন হয়ে, দেশ ও জনগণের মুক্তির জন্য সংগ্রামে অংশ নেন।

১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এম এন লারমার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, যার পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয় পাহাড়ের ১১টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। পঁচাত্তরের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান হাজার হাজার বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে গিয়ে সেখানকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করেন। বহু বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব বাঙালি ছিলেন, পাহাড়িদের সঙ্গে তাঁরা মিলেমিশেই বসবাস করছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান যাঁদের পাঠালেন, তাঁদের একাংশ জবরদখল শুরু করেন।

বাংলাদেশ সংবিধান পাহাড়িদের পৃথক জাতিসত্তার কথা স্বীকার করেনি। এ নিয়ে এম এন লারমার মনে ক্ষোভ ছিল। তারপরও তিনি ভেবেছিলেন গণতান্ত্রিক উপায়ে পাহাড়িদের পক্ষে লড়াই করবেন। এই বিবেচনায় তিনি বাকশালেও যোগ দেন। কিন্তু পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এম এন লারমা ও তাঁর সহযোগীরা আত্মগোপনে চলে যান। গড়ে তোলেন শান্তি বাহিনী—জনসংহতির সশস্ত্র শাখা।
পরের ইতিহাস সবার জানা। কর্ণফুলীর স্রোতে মিশে গেছে অসংখ্য পাহাড়ি ও বাঙালির রক্ত। রাষ্ট্রের ভুল সিদ্ধান্তে রক্তাক্ত হয়েছে পাহাড়ের সবুজ ভূমি, চিরকাল পাশাপাশি বাস করা পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যকার সম্প্রীতির বন্ধন টুটে যায়। বেড়ে যায় হিংসা ও হানাহানি। কোনো জাতিগোষ্ঠীর ক্ষতি শুধু সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে থাকে অপূরণীয় বেদনা, অপরিসীম কষ্ট ও হাহাকার।

অন্যান্য আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিতে যেমন অন্তর্দলীয় বিরোধ দেখা দেয়, জনসংহতি সমিতিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। একদিকে এম এন লারমা গ্রুপ, অন্যদিকে প্রীতি গ্রুপ। শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষ গ্রুপের হাতে জীবন দিতে হয় এম এন লারমাকে, ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর।

কিন্তু তাঁর সংগ্রাম ও সাধনা বৃথা যায়নি। যে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন, তাদের কিছুটা হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলেছে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার পাহাড়িদের দাবি স্বীকার করে নিয়ে সই করে পার্বত্য চুক্তি, যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু সেই চুক্তির অনেক ধারাই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষ করে পাহাড়িদের ভূমি সমস্যার সমাধান হয়নি। পার্বত্য চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলেই বলা যাবে এম এন লারমার সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ সার্থক হয়েছে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি