কামানটিলার হথা কেয়াই মনত নঅ রাহে

দক্ষিণ পতেঙ্গা চৌধুরীপাড়ায় নিজ বাড়ির সামনে অনিল চন্দ্র শীল

‘বৈশাখ মাস আইলি কইলজা ফাডি যাইগুই। পরানর ভুতুরে কেয়াই যেন কামান দাগের। ও বুক! এদুগ্গা মানুষ মারি ফেলাইয়ি। ইয়ানর হনঅ চিহ্ন কিল্লাই নঅ তাইবু?’ (বৈশাখ মাস এলে কলিজা ফেটে যায়। প্রাণের মধ্যে কেউ যেন কামান দাগায়। হায় হায়! এতগুলো মানুষ মেরে ফেলল, তার কোনো স্মৃতি কেন থাকবে না)

১৯৭১ সালের কামানটিলা গণহত্যার কথা জিজ্ঞেস করতেই বুক ফাটানো আহাজারি করতে করতে কথাগুলো বললেন ৭০ বছরের অনিল চন্দ্রশীল। ১৭ এপ্রিল (৩ বৈশাখ, ১৩৯২ বঙ্গাব্দ) সংঘটিত ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞে প্রাণ হারানো ৩৭ জনের মধ্যে তাঁর বাবা উমেদ চন্দ্র শীলও ছিলেন। তিনি বলেন, আঁরা পুত–নাতি ছাড়া কামানটিলার হথা কেয়াই মনত ন রাহে। (আমরা পুত্র, নাতি ছাড়া কামানটিলার কথা কেউ মনে রাখেনি।)’

চট্টগ্রাম শাহ্‌ আমানত বিমানবন্দর থেকে আধা কিলোমিটার দূরে ৪১ নম্বর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের চৌধুরী পাড়ার রাজা পুকুর এলাকার বহু পুরোনো বাসিন্দা অনিল। এখানেই তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটা। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এই পাড়া থেকে ৩১ জনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল বিহারিরা।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে সেই বিভীষিকার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে অনিল বলেন, পুরোনো বিমানবন্দরের চৌহদ্দিতে পুরোনো মসজিদের পাশে অজিত শীল নামে আমাদের এক প্রতিবেশীর সেলুন ছিল। সেই সেলুনের পাশে একটি দোকান ছিল কসমেটিকসের। দোকানটির মালিক ছিল ওরা তিন ভাই: গোলাম, আলাউদ্দিন ও ইউসুফ। একদিন তিন বিহারি ভাই আমাদের রাজার পুকুরে এসে বলল যে নাপিতদের কোনো ভয় নেই।

মিলিটারিরা সাধারণ মানুষকে কিছু করবে না। তারা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ধরবে। আমার মামাতো ভাই পুলিন শীল উর্দু জানত। তার মাধ্যমে বিহারিদের সঙ্গে কথাবার্তা হলো। বিহারিরা বলল, নাপিত পাড়ার সবাইকে একটা করে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। সেই পরিচয়পত্র দেখালে কোনো বিপদ হবে না।
পরিচয়পত্র দেওয়ার নাম করে বিহারিরা ৩১ জন নাপিতকে সেদিন রাত আটটায় নিয়ে যায়। তারপর কী ঘটেছিল, তা জানা যায় পরের দিন সকালে ওখান থেকে প্রাণ নিয়ে অন্ধকারে পালিয়ে আসা রাজমোহন শীল, রূপচন্দ্র শীল, অনিল কুমার শীলের কাছে। এই তিনজনের কেউ এখন বেঁচে নেই।

অনিল চন্দ্র শীল বলেন, পরিচয়পত্র দেওয়ার নাম করে ওঁদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। অন্যান্য জায়গা থেকেও কিছু মানুষকে নিয়ে আসা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাংকার খননের কথা বলে তাঁদের দিয়ে বড়সড় গর্ত খনন করায়। গর্ত খোঁড়ার কাজ শেষ হলে মজুরি দেওয়ার কথা বলে সবাইকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে মেশিনগানে ব্রাশ ফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই গর্তে পড়েন এবং বাকিদের মরদেহ টেনেহিঁচড়ে গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেয় পাঞ্জাবি হায়েনারা।

চট্টগ্রাম শাহ্‌ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রানওয়ের পাশে এয়ারপোর্ট টার্মিনাল ভবনের উত্তর–পূর্ব দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের একটি চানমারী (ফায়ারিং রেঞ্জ) ছিল। স্থানীয়ভাবে এটি কামানটিলা নামে পরিচিত। ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত ওই এলাকাটি এখন বিমানবন্দরের সংরক্ষিত এলাকা। এখানেই ঘটে এই বর্বর হত্যাকাণ্ড। চট্টগ্রামের ইতিহাস সচেতন মানুষ এই এলাকাটিকে কামানটিলা বধ্যভূমি নামে অভিহিত করেন।

এখানে শীলপাড়ার ৩১ জন ছাড়াও অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৬ জনসহ মোট ৩৭ জনকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়।

কামানটিলায় শীলপাড়ার যে ৩১ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন, তাঁরা হলেন পুলিনচন্দ্র শীল, উমেশ চন্দ্র শীল, অতুল চন্দ্র শীল, খিরোদ চন্দ্র শীল, সুনীল দাশ, শশাংক মোহন শীল, ধীরেন্দ্র মোহন শীল, সূর্য মোহন শীল, লাল মোহন শীল, যতীন্দ্র মোহন শীল, প্রফুল্ল চন্দ্র শীল, রাক মোহন শীল, লাল মোহন শীল, রূপ চন্দ্র শীল, রস মোহন শীল, মনিন্দ্র কুমার শীল, সচিন চন্দ্র শীল, হরিশ চন্দ্র শীল, ললিত মোহন শীল, নন্দীবাবু, কামিনী মোহন শীল, রবীন্দ্র কুমার শীল, ক্ষেত্র মোহন শীল, কৃষ্ণ মোহন শীল, কাশীরাম শীল, কাশীরাম শীলের বড় ভাই (নাম পাওয়া যায়নি), সুনীল কুমার শীল, কৃষ্ণ মোহন শীল, যাত্রা মোহন শীল, সুনীল কুমার শীল (২) ও লেদু শীল।

কামানটিলা বধ্যভূমির কথা প্রথম উঠে আসে ১৯৯৯ সালে শাহ্‌ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণ এবং রানওয়ের উন্নয়নকাজের সময়। অবশ্য এই বধ্যভূমি সম্পর্কে স্থানীয় অধিবাসীদের আগে থেকেই জানা ছিল।

বিমানবন্দর রানওয়ের উন্নয়নের জন্য এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি খনন করার সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম টেন্ডল এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জহির উদ্দিন বাদল বিষয়টি উন্নয়ন প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ার ভবেশ চন্দ্র সরকার এবং পিডি ইঞ্জিনিয়ার হারুনুর রশীদের নজরে আনেন এবং এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি জানান। এই দুজনের কাছে বধ্যভূমির ব্যাপারে অবগত হয়ে পিডি ইঞ্জিনিয়ার হারুনুর রশীদ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে খননের নির্দেশ দেন। ওই খননের সময় শহীদদের কঙ্কালগুলো উঠে আসে এবং সেখানে লাল বিল্ডিং নামে পরিচিত একটি ভবনে সংরক্ষণ করা হয়।

তখনকার মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি তুললে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কথা দিয়েছিল বধ্যভূমির স্মৃতি তারা সংরক্ষণ করবে। বর্তমানে এই বধ্যভূমি শাহ্‌ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সংরক্ষিত এলাকার ভেতর চলে গেছে।

বধ্যভূমি নিয়ে কোনো কাজ হয়েছে কি না, এর স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাওয়া হলে দক্ষিণ পতেঙ্গা আওয়ামী লীগ নেতা জহির উদ্দিন বাদল বলেন, ১৯৯৯ সালে শাহ্ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় যখন বধ্যভূমি এলাকাটি এক্সকাভেটর দিয়ে ওলটপালট করা হচ্ছিল, তখন আমি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম টেন্ডল ওই বধ্যভূমির স্থান চিহ্নিত করে বিমানবন্দর প্রকৌশলী ভবেশ চন্দ্র সরকার এবং পিডি ইঞ্জিনিয়ার হারুনুর রশীদকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ওই বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছিলাম।

প্রকল্প পরিচালক এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এই দাবির প্রতি একমত প্রদর্শন করে প্রকল্পের মাটি খননকাজে নিয়োজিত এক্সকাভেটর দিয়ে অতি সতর্কতার সঙ্গে খনন করে শহীদদের কঙ্কাল, মাথার খুলি, তাঁদের পরিধানের ক্যারোলিনের জামাকাপড়, বাঁধনযুক্ত রশি, বাটা কোম্পানি রাবারের কয়েকটি নাগরা জুতা এবং কিছু জং ধরা বুলেট উদ্ধার করে সংরক্ষণের জন্য ক্যাব (CAAB সিভিল এভিয়েশন অথরিটি) বিল্ডিংয়ের পাশের লাল বিল্ডিংয়ে নিয়ে আসে। তখন প্রথম আলোসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশের পর ঢাকা থেকে বিমানযোগে এসে শহীদদের কঙ্কাল, মাথার খুলি, চুল ইত্যাদি সারা দিনব্যাপী পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেন ওয়ার ক্রাইম গবেষক ডা. হাসান (মিরপুর যুদ্ধে নিহত শহীদ লেফটেন্যান্ট এস এম কামরুল হাসানের ভাই)।

তিনি মোট ৩৭ জন শহীদের কঙ্কাল চিহ্নিত করেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সশরীরে উপস্থিত থেকে বধ্যভূমির একই গর্ত থেকে শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধারের কাজ প্রত্যক্ষ করেন।
তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগ নেতা (পরর্তী সময়ে সিটি করপোরেশনের প্রশাসক) খোরশেদ আলম সুজন এবং সাবেক ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু বধ্যভূমি এবং লাল বিল্ডিংয়ে সংরক্ষিত শহীদদের দেহাবশেষ পরিদর্শন করেন।

মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী শহীদদের দেহাবশেষগুলো সে বছর বিজয় মেলায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন বলে সিটি করপোরেশন ও বিভিন্ন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। বিমানবন্দরের সংরক্ষিত এলাকার ভেতরে বধ্যভূমিটির অবস্থান হওয়ায় সেটির স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য কাছাকাছি সুবিধাজনক স্থানে স্মৃতিফলক করার ব্যাপারে কথাও বলেছিলেন। তিনি শহীদদের দেহাবশেষ, কঙ্কাল, পরিধানের জামাকাপড় (ক্যারোলিনের), তাঁদের হত্যায় ব্যবহৃত বুলেট ইত্যাদি সিটি করপোরেশনের জাদুঘরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন।

তখনকার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রকৌশলী ভবেশ চন্দ্র সরকার, প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান এবং প্রকৌশলী আবদুল মালেক, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জহির উদ্দিন বাদল, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম টেন্ডলের উপস্থিতিতে সিটি করপোরেশনের প্রধান কর্মকর্তা শওকত মোস্তফা সেগুলো গ্রহণ করেন। পরে অবশ্য সিটি করপোরেশনের জাদুঘরে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা যাচ্ছিল না বলে তাঁরা সেগুলো ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘরে হস্তান্তর করেন। এরপর সিটি করপোরেশন কামানটিলা বধ্যভূমি স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যাোগ নেয়নি।

সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক ও আওয়ামী লীগ নেতা খোরশেদ আলম সুজন বলেন, নগরে যেখানে যেখানে একাত্তরের স্মৃতি আছে, সবখানে স্মৃতিস্তম্ভ হওয়া উচিত। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের দেশের ইতিহাস জানতে পারে। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনকে উদ্যোগ নিতে হবে।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জহির উদ্দিন বাদল বলেন, এত বড় একটা গণহত্যার কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে কত উৎসব, কত আয়োজন হয়েছে, অথচ ’৭১–এর স্মৃতি ধরে রাখার আয়োজন হচ্ছে না। এ বড় দুঃখের বিষয়। কামানটিলা বধ্যভূমি এখন বিমানবন্দরের সংরক্ষিত এলাকার অন্তর্ভুক্ত। সেখানে কিছু করা যাবে না। তবে এর বাইরে সুবিধাজনক কোনো এলাকায় অন্তত একটা স্মৃতিস্তম্ভ তো করা যায়।

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক।