শিশুটির দেহ পড়ে আছে একটি ধানখেতে। নিথর। প্রাণের কোনো চিহ্ন তাতে নেই। থাকবে কী করে? তাকে যে হত্যা করা হয়েছে? হত্যাকারীরা তাকে খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি। উপড়ে নিয়েছে তার ডান চোখটি। কী নির্মম!
নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার ভাটচান্দা গ্রামে। হতভাগা এই শিশুর নাম জুয়েল। বয়স হয়েছিল মাত্র ছয় বছর। এত ছোট শিশুর সঙ্গে কার কী এমন শত্রুতা ছিল যে তাকে হত্যা করা হলো? উপড়ে নেওয়া হলো তার চোখ? কার কী ক্ষতি করেছিল সে? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন জুয়েলের মা-বাবাও। কারও সঙ্গে তো তাঁদের কোনো শত্রুতা নেই। তাহলে তাঁদের সন্তানকে কেন এমনভাবে মেরে ফেলা হলো।
গতকাল রোববার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় জুয়েল হত্যাকাণ্ডের খবরটি ছাপা হয়। খবরটি পড়ে শিউরে উঠি। মানুষ এতটাই পাষণ্ড হয়ে গেছে যে ছয় বছরের একটি শিশুকে হত্যা করতে পারে? উপড়ে তুলে নিতে পারে তার চোখ?
শিশুদের নৃশংসভাবে হত্যার নজির শুধু এটাই নয়। অতীতে আরও অনেক ঘটেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় এক ব্যক্তি একটি ঘরের ভেতরে দুই ভাতিজা ও এক ভাগনের হাত-পা বেঁধে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেন। তার আগে তিনি ওই তিন শিশুকে হাতুড়িপেটা করেন। এদের বয়স ছিল ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। পত্রিকার খবরে জানা গেছে, টাকাপয়সা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা পারিবারিক কলহের জেরে তিনি এই হত্যাকাণ্ড ঘটান।
গত ২০ আগস্ট সুনামগঞ্জে এক শিশুশ্রমিককে খুন করেন একটি রুটি ও বিস্কুট তৈরির কারখানার মালিক ও তাঁর এক সহযোগী। তাঁরা ওই শিশুশ্রমিককে শৌচাগারে নিয়ে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে ব্যাপক মারধর করেন। এরপর ইটের টুকরা দিয়ে তার মাথা থেঁতলে দেন। এতে শিশুটির প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর শিশুটি মারা যায়। শিশুটির অপরাধ ছিল, সে তার পাওনা বেতন চেয়েছিল।
ধিক এসব শিশু হত্যাকারীকে। যে শিশুরা নিষ্পাপ, জীবনের জটিলতা যাদের এখনো স্পর্শ করতে পারেনি, তারা কিনা হচ্ছে খুনের শিকার? একটা ছোট শিশু কী এমন অপরাধ করতে পারে যে তাকে খুন করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে হয়? জমি নিয়ে বিরোধ? শিক্ষা দেওয়ার জন্য খুন করো প্রতিপক্ষের শিশুসন্তানকে। পারিবারিক কলহ? দুই জায়ের মধ্যে চুলোচুলি? খুন করে ফেলো এক জায়ের সন্তানকে।
কোনো বিষয়ে একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে আরেকজন বয়স্ক মানুষের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। থাকতে পারে শত্রুতা। তাই বলে সে জন্য শিশুদের হত্যা করতে হবে? এ কেমন প্রতিশোধ। মাদক নিয়ে বিরোধের জেরে গত মাসে সিরাজগঞ্জে এক ব্যক্তির চার বছরের এক মেয়েকে খুন করে প্রতিপক্ষের লোকজন। স্ত্রী রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ায় কক্সবাজারের চকরিয়ায় এক ব্যক্তি তাঁর তিন কন্যাসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করেন। তাদের বয়স ছিল দেড় থেকে এগারো বছর।
শিশু অধিকার রক্ষায় ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ প্রণয়ন করেছে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ অনুসমর্থন করেছে এই সনদ। ২০১৩ সালে প্রণয়ন করেছে শিশু আইন। এসব সনদ ও আইনে শিশুদের সুরক্ষায় অনেক ধারা-উপধারা আছে। কিন্তু বাস্তবে সেগুলোর কোনো প্রয়োগ নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এসব আইন হিসেবে থেকে যাচ্ছে। ফলে, অপরাধীরা নির্বিঘ্নে পার পেয়ে যাচ্ছে এবং শিশুদের ওপর সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এসব বন্ধ করতে হবে। এ জন্য শিশু হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
আসুন, আমরা সবাই মিলে এ প্রতিরোধ গড়ে তুলি।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক