‘মাকে এই অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য আমি কখনো সঞ্জয়কে ক্ষমা করতে পারব না।’
উক্তিটি ছিল রাজীব গান্ধীর। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ইন্দিরা ও সঞ্জয় দুজনই বিশাল ভোটে হেরে যান কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত উত্তর প্রদেশের রায়বেরিলি ও আমেথি আসনে। রাজীব তখনো রাজনীতিতে আসেননি। কিন্তু মায়ের পরাজয়ের জন্য তিনি ছোট ভাইকেই দায়ী করলেন। ইন্দিরার বন্ধু পিপুল জয়াকারের উদ্ধৃতি দিয়ে নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনা এভাবেই বয়ান করেছেন ইন্দিরা গান্ধীর জীবনীকার ক্যাথেরিন ফ্রাংক। পিপুলও ইন্দিরাকে নিয়ে বই লিখেছেন।
ক্যাথেরিন ফ্রাংকের বর্ণনায় আমরা আরও দেখতে পাই, কংগ্রেসের পরাজয়ে রাস্তায় বিজয়ী দলের নেতা-কর্মীরা উল্লাস করছিলেন। আর সব সময় গমগম করা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনটি একেবারে ফাঁকা। তাঁর মতে, ৫৯ বছর বয়সী ইন্দিরা এই প্রথম দেখলেন তাঁর কোনো কাজ নেই, উপার্জন নেই, এমনকি মাথার ওপর ছাদও নেই।
লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর আমলে তথ্যমন্ত্রী থাকাকালে ইন্দিরা এই বাড়িতে উঠেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও এ বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলে তাঁকে বাড়িটিও ছেড়ে দিতে হবে। দিল্লিতে ইন্দিরার কোনো বাড়ি নেই। এলাহাবাদে বাবা জওহরলাল নেহরুর ‘আনন্দভবন’ আছে। কিন্তু তাঁকে দিল্লিতেই থাকতে হবে। এ সময় পারিবারিক বন্ধু মোহাম্মদ ইউনূস এগিয়ে এলেন। তিনি তাঁর ১২ উইলিংডন ক্রিসেন্টের বাড়িটি ইন্দিরা পরিবারের জন্য ছেড়ে দিলেন।
ক্যাথেরিন ফ্রাংকের মতে, মোরারজি দেশাই ইন্দিরার বাড়ির দখল নিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর যে নিরাপত্তা পাওয়ার কথা, সেটাও ছাঁটাই করে দিলেন। ইন্দিরার সচিব পি এন ধর তখনো পদত্যাগ করেননি। তাঁকে ডেকে দেশাই বললেন, ‘তাঁর (ইন্দিরা) ভয় কিসের? চারপাশে অনেক পুলিশ নিয়ে ঘোরা তাঁর জন্য ভালো নয়।’ একই সঙ্গে তিনি ক্লিওপেট্রা, ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট থেকে সমসাময়িক নারী শাসকদের কথা উল্লেখ করে বলেন, তাঁরা কেবল ব্যর্থ নন, বিপর্যয়করও বটে।
দেশাইয়ের এই ত্বরিত পদক্ষেপ আমাদের দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের প্রতি সরকারের আচরণের কথাও মনে করিয়ে দেয়। কোনো সরকারই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি।
নির্বাচনে পরাজয়ের পর ২০ মার্চের রাতে ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকে সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন এবং তাঁকে জরুরি অবস্থা তুলে নিতে বলেন। কিন্তু ২১ মাস আগে ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন মধ্যরাতে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করানোর আগে ইন্দিরা মন্ত্রিসভার কারও সঙ্গে আলোচনা করেননি। সঞ্জয়সহ ঘনিষ্ঠ কয়েকজন জানতেন। তাঁদের মধ্যে সম্ভবত প্রণব ছিলেন না। তিনি মিডনাইট ড্রামা: ডিক্লারেশন অব ইমার্জেন্সি অধ্যায়ে লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের ২৫ জুনের মধ্যরাতের কয়েক মিনিট আগে রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দীন আলী আহমেদ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন। প্রণব তখন রাজ্যসভা নির্বাচন উপলক্ষে কলকাতায় ছিলেন। ইন্দিরা জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে দিল্লিতে তলব করলেন।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্ষমতার রাজনীতির চরিত্র প্রায় অভিন্ন। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে বিরোধীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, জরুরি অবস্থার সময় সংবাদপত্র ও নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। এ জন্য তাঁকে এবং দলকে কাফফারাও দিতে হয়েছে। তাঁর লোকসভা সদস্যপদ খারিজ করা হয়েছে, ছেলে সঞ্জয়কে জেলে পাঠানো হয়েছে।
ক্যাথেরিন ফ্রাংক লিখেছেন, দেশাই, চরণ সিং, জগজীবনরাম, অটল বিহারি বাজপেয়ি একটি বিষয়েই একমত ছিলেন যে ইন্দিরা ও সঞ্জয়কে নাজেহাল করতে হবে। কিন্তু জনগণের কাছে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁরা ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেসব পূরণ করতে পারেননি।
ফলে ১৯৭৭ সালে ক্ষমতাচ্যুত ইন্দিরা গান্ধী তিন বছর পর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার ক্ষমতায় আসেন। ১৯৮০ ও ১৯৮৪ সালে কংগ্রেস আসন পায় যথাক্রমে ৩৫১ ও ৪০৪।
পাঁচ বছর পর ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস আবার বিরোধী দলে। ভি পি সিংয়ের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয় বিজেপি ও বামপন্থীদের সমর্থন নিয়ে। কিন্তু তিনিও মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। প্রণব লিখেছেন, ‘লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয় তাঁদের (রাজীব ও প্রণব) আরও কাছে আনে। ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও বেদনা সত্ত্বেও তিনি রাজীবের উদ্যমী নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। রাজীব দুর্নীতিবাজদের কবল থেকে কংগ্রেসকে মুক্ত করে রাজনীতি ও সরকারে নতুন প্রতিভার সন্ধান করেছিলেন বলে প্রণব মনে করেন। কিন্তু তাঁর বড় ভুল ছিল শাহবানু ঘটনায় মৌলবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ ও রাম জন্মভূমির মন্দির খুলে দেওয়া এবং বোফোর্স কেলেঙ্কারিতে জড়ানো। তৃতীয়টি আজও কংগ্রেসকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
এর আগে ইন্দিরা ক্ষমতায় থাকতে এলাহাবাদ হাইকোর্ট ইন্দিরা গান্ধীর আসনকে শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচনে অনিয়ম ও হস্তক্ষেপের অভিযোগে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ নারায়ণ আদালতে এই বলে রিট করেন যে, ১৯৭১ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী জয়ের জন্য যশপাল কাপুর নামের একজন সরকারি কর্মকর্তাকে ব্যবহার করেন; তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ৭ জানুয়ারি থেকে ওই কর্মকর্তা ইন্দিরার পক্ষে নির্বাচনী কাজ করেন, ১৩ জানুয়ারি তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিলেও তা কার্যকর হয় ২৫ জানুয়ারি। দ্বিতীয় অনিয়ম হলো ইন্দিরার নির্বাচনী জনসভার জন্য যেই মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল, তা তৈরি করে দিয়েছিলেন সরকারি কর্মকর্তারা। এ ছাড়া তাঁরা জনসভাস্থলে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিলেন।
এলাহাবাদ হাইকোর্ট ইন্দিরা গান্ধীর সদস্যপদ বাতিল ঘোষণা করেন, যেকোনো নির্বাচনী পদে তাঁকে ছয় বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেন। তখন সুপ্রিম কোর্ট বন্ধ ছিল। চেম্বার জজ হাইকোর্টের রায় সংশোধন করে বললেন, ইন্দিরার সদস্যপদ বাতিল হবে না; তিনি সংসদে যোগ দিতে পারবেন। কিন্তু ভোটাভুটিতে অংশ নিতে পারবেন না। পরে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এলাহাবাদ হাইকোর্ট ও চেম্বার জজের রায় বাতিল করে ইন্দিরার সদস্যপদ বহাল রাখেন। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।
প্রবীণ সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার, যিনি জরুরি অবস্থার সময়ে জেলে ছিলেন, তাঁর আত্মজীবনী বিয়ন্ড দ্য লাইন-এ লিখেছেন, ‘এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় ছিল ‘মাছি মারতে হাতুড়ি চালানো।’
আগামীকাল: ইন্দিরা পরিবারে অন্তঃকলহ
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।