ডিজিটাল বিশ্ব এখন এমন এক বাস্তবতা, যাকে আঁকড়ে ধরা বা পরিত্যাগ করা—কোনোটাই আর ইচ্ছাধীন নয় কারও, মেনে নেওয়াই যেন শেষ কথা। এই ‘বিরাট’ বাস্তবের ছোট্ট এক উদাহরণ বুঝি মানুষের হাতের মুঠোয় থাকা কয়েক ইঞ্চির স্ক্রিন, ঠিকঠাক যাতে এঁটে গেছে গোটা বিশ্বময় মহাবিশ্ব! দুনিয়া আজ হাতের মুঠোয়—এ কথায় বাগড়া দেয় সাধ্য কার! মানুষে মানুষে শব্দ-ছবি-চলচ্ছবিতে যোগাযোগ, আর্থিক লেনদেন, সংবাদ-বিসংবাদ, তত্ত্বতালাশ থেকে গান শোনা, সিনেমা দেখা—সব কিসিমের বিনোদনে আছে স্মার্টফোন।
করোনার অতিমারি লেখাপড়াকেও ‘পুরোপুরি’ পুরে দিয়েছে ‘একের মধ্যে অনেক’ এই যন্ত্রে। ট্যাব, ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার একইভাবে করোনাকালে বাস্তবে ‘বিযুক্ত’ বিশ্বকে অনলাইনে যুক্ত রাখতে হয়ে উঠেছে বিকল্পহীন অনুষঙ্গ।
প্রযুক্তি জীবনকে কতটা সহজ-সাবলীল, গতিশীল বা ছন্দময় করেছে, তা নিক্তিতে পরিমাপযোগ্য নয় হয়তো। তবে হোম অফিস, অনলাইন ক্লাস, জুম মিটিং ইত্যাদি যেন এই বৈরী সময়কে ‘জয়ী’ হতে দেয়নি, জীবনের প্রবহমানতাকেও ‘থমকে’ যেতে দেয়নি। ফলে প্রযুক্তির ব্যাপকতায় এ কথা বলাই চলে—প্রাত্যহিকতায় প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়েইনি শুধু, তা জীবনকে নির্ভারও করেছে অনেকখানি। তাই বলে শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়ার ভারও কি গ্যাজেটের ওপর ছেড়ে দেওয়া চলে?
সমাজ যেন সেই কাজটিই করে চলছে; শৈশব সাজানো-গোছানোর দায়িত্ব ক্রমে গছিয়ে দিচ্ছে প্রযুক্তির কাঁধে। করোনাকাল সমাজের এই প্রবণতার পালে দিয়েছে, বলা চলে দমকা হাওয়া; না চাইলেও শিশু-কিশোরদের হাতে তুলে দিতে হয়েছে মুঠোফোন বা ট্যাপ। ফলে অন্য অনেক ক্ষতির সঙ্গে গেজেটে আসক্তিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে করোনা অতিমারি।
২.
রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়া দুই ভাই করোনাকালের পুরো সময় অনলাইনে ক্লাস করেছে। এ বছর যথাক্রমে দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে তারা। অনলাইনে ক্লাসের কারণে তাদের আলাদা দুটি মুঠোফোন দেওয়া হয়। কিন্তু মা-বাবা একপর্যায়ে দেখতে পেলেন, তাদের দুই ছেলেই ক্লাসের ফাঁকে অনলাইন গেম খেলে, চ্যাট করে। নানাভাবে বোঝানোসহ নজরদারি করায় তাতে কিছুটা ভাটা পড়ে। পরে দেখা গেল, বড় ছেলেটি দিনে কয়েক দফা বাথরুমে গিয়ে লম্বা একটা সময় কাটায়।
জিজ্ঞেস করলে বলে, পেট খারাপ। কিন্তু সে বাথরুমে মোবাইল নিয়ে গিয়ে গেম খেলে। এ নিয়ে বকাঝকা করায় তার মধ্যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সে তার বন্ধুদের গ্রুপে লিখে বসে ‘লাইফ ইজ আ বিচ!’; আরেক বন্ধুকে বলে আরও ভয়ংকর কথা, ‘মনে হয় নিজেকে শেষ করে দিই’! মা-বাবা ঘাবড়ে যান। নানাভাবে বুঝিয়ে-সুজিয়ে শেষ পর্যন্ত দিনে এক ঘণ্টা গেম খেলার জন্য সময় নির্ধারণ করে দেন সন্তানদের। বলা বাহুল্য, করোনায় পড়ালেখায় ছেদ না পড়লে দুই ভাই-ই পড়ালেখায় অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে।
৩.
প্রযুক্তিময় বিশ্বে—এ বলা বেঠিক হয় না—চোখ ফোটার পর থেকেই শিশুরা আসক্ত হচ্ছে গ্যাজেটে। তা সে অক্ষর চেনার জন্যই হোক, ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখার জন্য বা খাবার খাওয়ানোর জন্যই হোক—ভাবনা কী, আছে নির্ভাবনার গ্যাজেট! কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই মুশকিল-আসানের সহজ তরিকা কি জটিল মুসিবত ডেকে আনছে না?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যা বলছে, তাতে শঙ্কিত হওয়ার কারণ ষোলো আনা ছাড়িয়ে আঠারো আনা। করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে সংস্থাটি তাদের হালনাগাদ পর্যালোচনায় সাফ বলেছিল, দুই থেকে চার বছরের শিশুদের দিনে এক ঘণ্টার বেশি ডিজিটাল স্ক্রিনের সামনে থাকতে দেওয়া চলবে না; কোনো অজুহাতেই না। স্ক্রিন আছে এমন যেকোনো ধরনের বৈদ্যুতিন যন্ত্রের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না আরও কম বয়সীদের, হাতে তুলে দেওয়া তো দূরের কথা।
ডব্লিউএইচও তাদের গবেষণায় বলেছে, বিশ্বের একটি বড় অংশের শিশুদের হাতে স্মার্টফোনের মতো সহজলভ্য গ্যাজেট পৌঁছে যাচ্ছে কোনো না কোনোভাবে। কোনো সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে সমাধানের পথে তো হাঁটছেই না, উল্টো মনোযোগ দিচ্ছে হাতে থাকা স্ক্রিনে। ফলে শৈশব থেকে বিদায়ঘণ্টা বাজছে আবেগের, শিশুদের সুবিশাল মনোজগতের দুয়ার থাকছে বন্ধই।
শিশুর মানসিক বিকাশের এই পর্বে বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। উপরন্তু, স্ক্রিনের সামনে টানা বসে থাকার প্রবণতায় বাড়ছে স্থূলতা। কে না জানে, অতিরিক্ত ওজন ডেকে আনে বহু শারীরিক সমস্যা। অনিদ্রার মতো সমস্যাও বাড়ছে সমানতালে, যা একই সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে শহরগুলোতে ২৪ ঘণ্টাই কৃত্রিম আলো জ্বেলে রাখাসহ কম্পিউটার-মুঠোফোন ব্যবহারে প্রাপ্ত বয়স্কদের বড় একটা অংশ ঘুমের সমস্যায় আক্রান্ত। অর্থাৎ চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, এমন ভাবনা হবে আত্মঘাতী। আমাদের উপেক্ষার মাশুল গুনবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। অনেকেই মনে করেন, তার আলামত স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
৪.
মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা বা শারীরিক সমস্যার ক্ষেত্রে স্মার্টফোনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে তবু কিছু আলাপ-আলোচনা হয় বিভিন্ন মহলে। কিন্তু সমাজবিচ্ছিন্নতায় স্মার্টফোনের ‘অবদান’ নিয়ে তেমন কোনো আওয়াজ কালে ভদ্রেও শোনা যায় না। অথচ দীর্ঘ মেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে।
এমনিতেই প্রযুক্তির রমরমা এই ‘আধুনিক-প্লাস’ বিশ্বে শিশুরা বড়ই একা। যৌথ পরিবারের ধারণা আমাদের মনোজগৎ থেকে বহু আগেই ‘মাইনাস’ হয়েছে। ছোট হতে হতে পরিবার এখন স্রেফ মা-বাবায় সীমাবদ্ধ।
এর ওপর তাদের উভয়ের কর্মজীবন, উদায়স্ত ব্যস্ততা, ক্যারিয়ার গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা; ফলে মা-বাবাকেও কতটুকু সময় কাছে পাচ্ছে সন্তান? যে নিরাপদ পারিবারিক বেষ্টনী শিশুকে এযাবৎকাল ঘিরে রাখত পরম যত্নে-আদরে, ক্রমে তা বিলীন হচ্ছে। এমন ‘অরক্ষিত’ শিশুই গেজেটের বড় টার্গেট। অর্থাৎ গ্যাজেটে মগ্ন শিশু আরও বেশি সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, নিঃসঙ্গ হচ্ছে। তার মধ্যে অন্যের সঙ্গে কোনো কিছু ভাগাভাগি করে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে না, তার মনে গড়ে উঠছে না অন্যের প্রতি সংবেদনশীলতা।
৫.
দুটি কারণ পাশাপাশি একটি অন্যটিকে পুষ্টি জুগিয়ে চলেছে। তথাকথিত ‘সাহচর্য’, বিনোদন, শিক্ষা—সবকিছুই স্ক্রিনে পেয়ে পারস্পরিক মেলামেশা ও লেনাদেনার তাগিদ বোধ করছে না শিশু। অন্যদিকে তার বৌদ্ধিক বিকাশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। সঙ্গে, মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘার মতো শারীরিক ক্ষতি তো আছেই।
স্ক্রিনসর্বস্ব জীবনে শিশু নিজের কল্পনাশক্তি ঝালিয়ে নেওয়ার অবসর পায় না, সুযোগও ঘটে না। স্ক্রিনটিই নানা রঙিন মোড়কে তার কল্পনাটিকে সামনে হাজির করে। ফলে স্ক্রিনে দেখা গল্পকে, ভাবনাকে সে নিজস্ব কল্পনার প্রকাশ হিসেবে দেখে। এ যেন দিগন্তের সামনে কৃত্রিম পর্দা টাঙিয়ে দেওয়া। বছর কয়েক আগেও ঠাকুমার ঝুলি, দৈত্যদানো বা লালকমল-নীলকমলের গল্পসহ নানা রূপকথা শুনে সে নিজের মনে সেগুলোর অবয়ব রচনা করত, মনের পটে দৃশ্যকল্প সাজাত। যেকোনো গল্পের সার্থকতাও সেখানে।
কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমে গল্পের বাহারি ভিডিও শিশুর নিজস্ব কল্পনার ভুবনটিকে স্রেফ গুম করে ফেলছে। সেই জায়গায় বসিয়ে দিচ্ছে অন্যের ভাবনাকে। শিশুমন কল্পনা আর বাস্তবের ফারাকই করতে পারছে না। কাগুজে ধারণা হয়ে থাকছে শিশুর কল্পনাশক্তির উন্মেষ, মনোজগতের বিস্তার তথা মানসিক বিকাশ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের একটা বড় অংশকে এমন ‘জড়ভরত’ হিসেবে দেখতে না চাই না কেউই, এ ব্যাপারে দায়িত্বও তাই আমাদের সবার।
হাসান ইমাম সাংবাদিক
[email protected]