ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের চার বছর ধরে ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং রিপাবলিকান পার্টি—উভয় দলভুক্ত ট্রাম্পবিরোধীরা তাঁকে ‘হবু ফ্যাসিবাদী একনায়ক’ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। তবে হোয়াইট হাউস থেকে ছিটকে পড়ার সুবাদে এখন ট্রাম্পকে সেসব বলা বন্ধ হয়েছে। ফ্যাসিস্ট একনায়ক বলতে ইতালির স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনিকে বোঝানো হলেও আদতে তাঁর সঙ্গে ট্রাম্পের যতটা মিল ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি মিল ছিল সেই ইতালিরই সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বেরলুসকোনির।
পশ্চিমা গণতন্ত্রে বড় ব্যবসায়ী ও কিংবা মিডিয়া সেলিব্রিটিদের হঠাৎ রাজনীতিতে এসে গদিতে বসে প্রতিষ্ঠানবিরোধী জনতুষ্টিবাদী কথা বলে জনমতকে নিজের দিকে টানার ঘটনা দুর্লভ নয়।
ইউরোপের দিকে তাকালে দেখব, সেখানে চেক প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে ধনীদের একজন ছিলেন আঁদ্রেজ বাবি, যিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পত্রো পোরোশেঙ্কো রাজনীতিতে আসার আগে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চকলেট ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ‘চকলেট কিং’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পোরোশেঙ্কোর উত্তরসূরি ভোলোদিমির জোলোনস্কি রাজনীতিতে আসার আগে কৌতুক অভিনেতা ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বহু সেলিব্রিটি তাঁদের তারকা খ্যাতি কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে এসে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসীন হয়েছেন। তবে তঁাদের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রথম সত্যিকারের বক্তৃতাবাজ হিসেবে ধরা যেতে পারে, যিনি প্রেসিডেন্টের পদে উঠে এসেছেন।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩০–এর দশকের রেডিওর জনপ্রিয় লোকসংগীতশিল্পী উইলবার্ট লি পাপ্পি ও ড্যানিয়্যাল তারকাখ্যাতি দিয়ে টেক্সাসের গভর্নর ও পরে সিনেটর হয়েছিলেন। ১৯৬০ থেকে ৮০–এর দশকে হলিউডের অভিনেতা রোনাল্ড রিগ্যান তারকাখ্যাতির ওপর ভর করে প্রথমে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর এবং পরে প্রেসিডেন্ট হন। একইভাবে নর্থ ক্যারোলাইনার সাবেক সিনেটর জেসি হেমস তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন রেডিওর সংগীতশিল্পী হিসেবে। হলিউডের বিশ্বখ্যাত অভিনেতা আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগার অতীতের কোনো ধরনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর হয়েছেন।
এই ধরনের নেতাদের জনপ্রিয়তার মূলভিত্তি থাকে তারকাখ্যাতি। তারকা হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের একধরনের আবেদন থাকে। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাহীন এসব নেতার মূল পুঁজি হলো বক্তৃতাবাজি। সেই বক্তৃতায় যুক্তি কিংবা বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণী দিকনির্দেশনা থাকল কি থাকল না, সেটি মুখ্য বিষয় নয়। তারা গদিতে বসলে সাধারণত তাদের মধ্যে পুলিশি রাষ্ট্র কায়েমের প্রবণতা থাকে না। যেখানে ফ্যাসিস্ট একনায়কদের মূল শক্তি থাকে সেনাবাহিনী, পুলিশ, আমলা এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, সেখানে এই বক্তৃতাসর্বস্ব জনতুষ্টিবাদীদের মূল শক্তি থাকে অনভিজাত শ্রেণি। তারকাখ্যাতি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের শক্তির ওপর ভর করে নেতৃত্বে আসা এই নেতাদের প্রতি সাধারণত সেনাবাহিনী, পুলিশ, আমলা ও ব্যবসায়ীদের ততটা আনুগত্য থাকে না যতটা থাকে ফ্যাসিবাদী একনায়কদের ওপর। অনেক সময় এই বাক্সর্বস্ব নেতারাই বঞ্চিত ও অবমানিতের কাছে ভরসাযোগ্য উদ্ধারকর্তা হিসেবে বিবেচিত হন। যেমন লুইজিয়ানার গভর্নর (পরে সিনেটর হয়েছিলেন) হুই পি লং কিংবা টেক্সাসের জনতুষ্টিবাদী গভর্নর দম্পতি জেমস পা এবং মারিয়াম মা ফার্গুসন দরিদ্র অশ্বেতাঙ্গ খামারি এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
কিছু বাক্চতুর নেতা অনেক সময় ক্ষমতা ও সম্পদের হিস্যা থেকে বঞ্চিত হওয়া মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। এই কায়দায় বোস্টনের মেয়র পদে এসেছিলেন জেমস মাইকেল কার্লি।
ফ্যাসিবাদী একনায়কদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁরা সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আমলাদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়ানোর চেয়ে তাঁরা নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সংহত ও নিরঙ্কুশ করার দিকে বেশি মনোযোগী হন।
ট্রাম্পের নেতৃত্বের অনন্য দিক হলো, দেশটির সেনাবাহিনী, পুলিশ বা আমলারা তাঁর প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয়নি এবং জনগণের একটি বিরাট অংশ তাঁর অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপে রুষ্ট হয়েছে; কিন্তু একটি বিরাট অংশ তাঁকে ত্রাতা হিসেবে দেখেছে। এই সমর্থকেরা তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদে রাখতে ক্যাপিটল ভবনে হামলা পর্যন্ত করেছে। এই ধরনের বাক্চতুর নেতা সবচেয়ে ভয়ানক হয়; কারণ, তাঁরা জাতিকে বিভক্ত করে ফেলেন। সেই দিক থেকে তাঁরা একনায়কদের চেয়েও ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
মাইকেল লিন্ড: ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের অধ্যাপক