চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন সহজ কোনো কাজ যে নয়, তা সবাই বোঝে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাই বারবার ‘সময়সাপেক্ষ’ কথাটার পুনরুক্তি করেছেন। কিন্তু কত সময় লাগবে, তা কখনো নির্দিষ্ট করে বলেননি। নগরবাসী প্রতিবছর ভেসেছেন, ডুবেছেন আবার ভেসেছেন। একবারই শুধু একজন বলেছিলেন, এক বছরের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তিনি তৎকালীন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। তাঁর এই আত্মবিশ্বাসের কারণেই কি না কে জানে, জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজের একটি বড় অংশ সিডিএর ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর ‘দীর্ঘ’ দায়িত্বকাল শেষ হয়েছে, আমরা এখনো ভাসছি। এবার মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিপাতের পর বরং জলমগ্ন অঞ্চলের পরিধি আরও বেড়েছে।
২০১০ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী হেরে গিয়েছিলেন তাঁরই এককালের শিষ্য হিসেবে পরিচিত এম মনজুর আলমের কাছে। এই বিস্ময়কর ফলাফল নিয়ে তখন অনেক রকম পর্যালোচনা হয়েছে। ওই নির্বাচনের মাত্র দুদিন আগে প্রবল বৃষ্টিপাতে শহরের অধিকাংশ অঞ্চল জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল। মানুষের এই সীমাহীন দুর্ভোগের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জনরায়ে প্রতিফলিত হয়েছে বলেও মত প্রকাশ করেছিলেন তখন অনেক বিশ্লেষক। এই বিশ্লেষণকে শতভাগ নির্ভুল ধরে না নিলেও জলাবদ্ধতার সমস্যা যে মহিউদ্দিনের ভাগ্য-বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এরপর মনজুরুল আলমের পাঁচ বছর। তিনিও খাল খননের নানা রকম উদ্যোগ-আয়োজন করে শেষ পর্যন্ত তল খুঁজে পেলেন না। আমরা যথারীতি ভাসলাম, ডুবলাম আবার ভাসলাম।
এরপর ২০১৫ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচিত হন আ জ ম নাছির উদ্দীন। নির্বাচিত হওয়ার পর খুব বাস্তবানুগ একটা কথা বলেছিলেন তিনি, অকপটে জানিয়েছিলেন, জলাবদ্ধতা নিয়ে সামনের মৌসুমের জন্য কোনো আশার বাণী শোনাতে পারবেন না। ভালো কথা, সামনের মৌসুমে না হোক, তাঁর কার্যকালের আরও কয়েকটা বছর তো হাতে আছে। মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না, বরং জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য বড় বরাদ্দ সিটি করপোরেশনের পরিবর্তে দেওয়া হলো সিডিএকে। সেই যে তৎকালীন সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেছিলেন এক বছরের মধ্যেই সম্ভব (পরে অবশ্য তিনি জানিয়েছেন, এক বছর নয়, ধাপে ধাপে সমস্যা সমাধানের কথা বলেছিলেন), তাঁর হাতে যখন এর দায়িত্ব পড়ল, তখন তো নাগরিকদের কিছুটা নিশ্চিত হওয়ার কথা। তিনি মেগা প্রকল্প তৈরি করে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিলেন সেনাবাহিনীর হাতে। ইতিমধ্যে কয়েক দফা বাড়তি মেয়াদের দায়িত্ব পালন শেষে আবদুচ ছালাম যখন বিদায় নিলেন, তখনো নগরবাসীকে এ ক্ষেত্রে কোনো সুসংবাদ দিয়ে যেতে পারলেন না তিনি। বরং জলাবদ্ধতা নিয়ে সিডিএ ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে টানাপোড়েন যেন বেড়ে গেল আরও।
বর্তমান মৌসুমের প্রথমবারের ভারী বর্ষণেই তলিয়ে গেছে চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সব মহলেই নাগরিকদের ক্ষোভ ও হতাশার মুখে সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সিডিএর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে সরাসরি দায়ী করে বলেছেন, নগরের বিভিন্ন খাল থেকে বাঁধ অপসারণ না করায় জলাবদ্ধতা তীব্র হয়েছে। অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার (সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্রিগেড) পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ শাহ আলী জানিয়েছেন, বাঁধ কেটে দেওয়া হয়েছে, কোথাও বড় বাঁধ নেই। তিনি বরং দ্রুত পানি না নামার কারণ হিসেবে নালা-নর্দমা অপরিষ্কার থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। এ দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।
অর্থাৎ, সমস্যা শনাক্ত করার ক্ষেত্রেও দুটি সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গি দুরকম, সমাধান তো দূর অস্ত। অথচ পেশাদার স্থপতি ও নগর–পরিকল্পনাবিদেরা ‘সমন্বয় সমন্বয়’ বলে গলা ফাটাচ্ছেন সেই কতকাল আগে থেকে। নগর উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকলে যে উদ্যোগ-আয়োজন করেও সাফল্য পাওয়া যায় না, এটা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন চট্টগ্রামের তিনবারের নির্বাচিত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। বারবার নগর সরকার বা সিটি গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছিলে তিনি। কিন্তু সে দাবি উপেক্ষিত হয়েছে নীতিনির্ধারক মহলে। ফলে বিভিন্ন সংস্থার কাজের ওপর তদারক করা বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়নি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির।
এ বছর প্রথম ভারী বর্ষণের দিনেই যে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন অঞ্চল ডুবে গেল এবং আগে প্লাবিত হতো না এমন অঞ্চলও এর আওতায় এল, তার কারণ প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের জন্য অন্তত ১২টি খালে দেওয়া অস্থায়ী বাঁধ। এর মধ্যে কিছু বাঁধ ব্যবহার করা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়ার রাস্তা হিসেবেও। এখনো খালের ভেতরে বিভিন্ন অংশ মাটি দিয়ে ভরাট করে রাখা হয়েছে। পানিপ্রবাহের জন্য এক পাশ খোলা রাখা হলেও তা খুবই সরু। প্রয়োজনীয় প্রশস্ততা না থাকায় পানিনিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ সিডিএর প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে নগরবাসী রেহাই পেল না এ কথা যেমন সত্য, তেমনি বর্ষা মৌসুমের আগেই অন্তত খালের অস্থায়ী বাঁধগুলো অপসারণ করা হলে দুর্ভোগ এতটা তীব্র হতো না এটাও সত্য।
স্থপতি ও নগর–পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান বলেছেন, ‘সিটি করপোরেশন, সিডিএ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো মিলে সমন্বিতভাবে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করতে হবে। যাতে খাল ভরাট না হয়, খালে যাতে পলিথিন না পড়ে, পাহাড় যাতে কাটতে না পারে ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।’ সেই তো সমন্বয়ের কথাই আসছে ঘুরেফিরে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটি বাঁধবে কে? সিটি করপোরেশনের মেয়র এ রকম সমন্বয় সভা আহ্বান করলে প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন সংস্থার নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ব্যক্তিরা সেখানে উপস্থিত থাকেন না। সংস্থার পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে দায় সারেন। এতে আর যাই হোক সমন্বয় সাধন যে হয় না তা তো বলাই বাহুল্য।
৬ জুন জলমগ্ন ষোল শহর মোড়ে আধডোবা একটি রিকশায় বসে একজন সুকণ্ঠী রিকশাচালক গলা ছেড়ে গাইছিল, ‘জলে ভাসা পদ্ম আমি, শুধু পেলাম ছলনা, আমার নাই তো কোথাও কোনো ঠাঁই...।’ পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে এত অর্থবহ ও সময়োপযোগী গান বহুকাল শুনিনি!
● বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক