ডা. এ কে এম ফারুক

শহীদ বুদ্ধিজীবী, সেনা চিকিৎসক, বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ ঢাকা

কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে বিএসসি পড়াকালে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীতে পরীক্ষা দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন এ কে এম ফারুক।কিন্তু মায়ের স্নেহ ও আপত্তির কারণে বিমানবাহিনীতে যোগ দেননি।

পরে ডাক্তারি পাস করার পর পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) হেলথ সার্ভিসে চাকরি পেয়েছিলেন।

কিন্তু তাঁকে ফরিদপুরে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল বলে সেখানে যাননি। পরে তিনি যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে।


এ কে এম ফারুক একাত্তরে কর্মরত ছিলেন কুমিল্লা (ময়নামতি) সেনানিবাসে ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সে। ২৫ মার্চের পর থেকে সুযোগ খুঁজছিলেন যুদ্ধে যোগ দেওয়ার।

কিন্তু সে সুযোগ তাঁর আর হয়নি। কুমিল্লা সেনানিবাসে বিভিন্ন পদমর্যাদার বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা ২৫ মার্চ রাত থেকেই হয় গৃহবন্দী অথবা বন্দী হন।

এর আগ থেকেই বাঙালি অন্য সেনা কর্মকর্তাদের মতো ফারুকের বাসার দিকে সারাক্ষণ নজর রাখত পাকিস্তানি সেনারা।


২৭ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসে খবর আসে চট্টগ্রামের কুমিরায় বিদ্রোহী বাঙালি সেনাদের হাতে পাকিস্তানি কর্নেল শাহানুর নিহত হয়েছেন।

এই খবর কুমিল্লা সেনানিবাসের পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। ৩০ মার্চ সকালে একটি জলপাই রঙের জিপ ফারুকের বাসার সামনে আসে।

ওই জিপে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে দুপুরের দিকে বাসায় টেলিফোনে একবার কথা বলেছিলেন তিনি।

এরপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। শোনা যায়, ওই দিনই বিকেলে আরও কয়েকজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁকেও ব্রাশফায়ারে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয় সেনানিবাসের ভেতরেই।


সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা ফারুকের রচনা থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘৩০ মার্চ ১৯৭১ সাল।

ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের আমাদের বাসায় আমি, আমার স্বামী ও আমাদের ছয় মাসের ছেলে এ কে এম তারেক। শখ করে তার নাম রেখেছিল সোহাগ।

সকালের নাশতা টেবিলে দেওয়া। হঠাৎ একটি জলপাই রঙের জিপ এসে অন্যান্য বাঙালি অফিসারের সঙ্গে তাঁকেও তুলে নিয়ে গেল।

দুপুরের দিকে আমার সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয় টেলিফোনে। বললেন, “ভালো থেকো, আমরা ভালো।” মনে হলো তাঁদের বাক্স্বাধীনতা শেষ।

কিন্তু অসহায়ত্বের নির্মম কশাঘাতে আমরাও সেদিন বাক্রুদ্ধ, নির্বিকার। আমাদের বাসার চারদিকে পাঞ্জাবি সেনারা প্রতিনিয়ত নজর রাখছে।

কোথাও বেরোনোর উপায় নেই। পরে জানলাম, ওই দিনই কর্নেল ডা. জাহাঙ্গীর, মেজর খালেকসহ আরও অনেক বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে আমার স্বামী ডা. ক্যাপ্টেন এ কে এম ফারুককেও ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় এবং নিকটস্থ এক গণকবরে মাটিচাপা দেওয়া হয়।


‘এই হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর আমাকে, আমার ছয় মাসের শিশুপুত্র সোহাগকে বাঙালি অন্য অফিসারদের পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে ময়নামতির ইস্পাহানী স্কুলে আটক রাখা হয়।

পরবর্তীকালে মুক্তিসংগ্রামের তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে গেল। জুলাই মাসে অন্যান্য বাঙালি পরিবারের সঙ্গে আমাকেও ছেড়ে দেওয়া হয়।


‘তাঁর মৃত্যুসংবাদ দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি জানতাম না। তাই প্রতিনিয়ত অপেক্ষায় থেকেছি তাঁর প্রত্যাশিত প্রত্যাগমনের আকাঙ্ক্ষায়।

তিনি আর আসেননি।’ (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ, বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ, প্রকাশ ২০০৯)।


এ কে এম ফারুকের জন্ম ১৯৪৪ সালের ১৭ মে, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর পৌরসভার অন্তর্গত বসন্তপুর গ্রামে। বাবা আবু তালেব ভুঁইয়া, মা নূরুননেছা।

তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। স্থানীয় স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন।

কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএসসি ও বিএসসি পাস করেন। বিএসসি পাস করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন।

১৯৬৯ সালে এমবিবিএস পাস করে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে (এএমসি)।

কলেজের ছাত্র থাকাকালে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও রাজনীতিসচেতন ছিলেন তিনি।

খেলাধুলার প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ আগ্রহ। স্কুল-কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাসহ নানা খেলাধুলায় অংশ নিতেন।

তিনি দুই ছেলে এ কে এম তারেক (সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত) ও এ কে এম আরিফের (সেনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত) জনক।


কুমিল্লা সেনানিবাসের ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স ইউনিট, ঢাকা সেনানিবাসে স্টাফ রোড তোরণ ও সরকারি মেডিকেল কলেজের স্মৃতিফলকে তাঁর নাম রয়েছে।


প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৩) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
[email protected]