
‘যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়’। আমার ছেলে পুচি, যার ভালো নাম ইসলাম তমোহর, গিটার বাজানো ছিল তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় কাজ। ডিসেম্বর মাসের ৩ আর ৪ তারিখ, আমার জীবনের দুঃসহ দুটি দিন। ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর তারিখে আমার ছেলে পুচি আর ৪ ডিসেম্বর পুচির বাবা নূরুল ইসলাম এই পৃথিবীর বিশাল আনন্দযজ্ঞের মায়া কাটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। পুচিকে ছুঁয়ে দেখব মনে করে গিটারটা ধরতে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই ধুলো জমেছে গিটারের তারগুলোতে। পুচির বাবা মাঠে-ময়দানে বিস্তর বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন। লোকে তাঁর বক্তৃতার প্রশংসা করত। তিনি গান গাইতেন, বিশেষ করে ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’, আর ‘ভালো যদি বাস, সখী, কী দিব গো আর’ রবীন্দ্রসংগীত দুটি গাইতেন মার্চ সংগীতের ঢঙে ও লয়ে।
ভেদাভেদলাঞ্ছিত এ সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আর অঙ্গীকার নিয়ে গত শতাব্দী থেকে এই শতাব্দী পর্যন্ত যাঁরা লড়াই করছিলেন, তাঁদের জীবনের পরতে পরতে বোধ করি এই রণস্পৃহা মিশে গিয়েছিল। কয়েক দিন আগে নূরুল ইসলামের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগের একটি ভিডিওচিত্র দেখে মনে হলো জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই রণস্পৃহা, সেই বজ্র নির্ঘোষ, সেই লড়াকু সৈনিকের সাহস নিয়েই তিনি যুদ্ধ করে গেছেন। পুচি আর পুচির বাবা অনেক দূরে চলে যাওয়ার আগে আমি ওদের থেকে অনেক দূরে ছিলাম। একটু পানিও দিতে পারিনি কারও মুখে। জানি না ওরা কিছু বলতে চেয়েছিল কি না। যুদ্ধের মাঠ থেকে কি ঘরে ফিরেছিল বাবা আর ছেলে!
৪ ডিসেম্বর আমার স্বামী গণতন্ত্রী পার্টি ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি, রাজনীতিবিদ ও শ্রমিকনেতা মোহাম্মদ নূরুল ইসলামের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ছয় বছর অতিবাহিত হলো। নবম জাতীয় নির্বাচনের আগের নির্বাচনের মাত্র ২৬ দিন আগে, ৩ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে নূরুল ইসলাম ও আমাদের একমাত্র ছেলে ইসলাম তমোহর লালমাটিয়ার ফ্ল্যাটে রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় এক রহস্যজনক দহনের শিকার হন। দগ্ধ হয়ে তমোহর ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে। গুরুতর আহত অবস্থায় নূরুল ইসলাম সাময়িকভাবে জ্ঞান ফিরে পেলেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর অপরাহ্ণে মৃত্যুবরণ করেন।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, কোনো তদন্ত ছাড়াই পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, বৈদ্যুতিক সংযোগে শর্টসার্কিট-জনিত দুর্ঘটনায় ফ্রিজের কম্প্রেসর বিস্ফোরণে নূরুল ইসলাম ও তমোহরের মৃত্যু হয়েছে। অথচ টেলিভিশন সংবাদে স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে ঘরে থাকা ওই ফ্রিজটির কম্প্রেসর সম্পূর্ণ অক্ষত রয়েছে। তা ছাড়া, বিকল থাকায় দীর্ঘদিন ধরে ফ্রিজটির বৈদ্যুতিক সংযোগ খুলে রাখা হয়েছিল। শুরু থেকেই বিষয়টিকে শর্টসার্কিট-জনিত দুর্ঘটনা বলে প্রচার করায় তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সন্দেহের উদ্রেক হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই হত্যাকাণ্ডটিকে যথাযথ তদন্ত ছাড়া অযৌক্তিকভাবে দুর্ঘটনা হিসেবে প্রচার করে ও তদন্ত-প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার তদন্তকার্য পুনরায় শুরু করেছে। এরই মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের শর্টসার্কিটের তথ্যকে নাকচ করে দিয়ে সরকারি সংস্থা পিডিবি রিপোর্ট দিয়েছে যে ওই ফ্ল্যাটে বিদ্যুতের শর্টসার্কিটের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তদন্তে প্রকাশ পায়, সেখানে আগুনের কোনো শিখা কেউ দেখেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের তদন্তকারী দলও ওখানে শর্টসার্কিট হয়নি বলে মন্তব্য করেছে। উপরন্তু, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের (বিসিএসআইআর) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে হত্যাকাণ্ডের স্থানে (স্বপ্নপুরী হাউজিং কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাটে) অসমিয়াম, আর্সেনিক ও লেড নামে ভয়ংকর রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সরকারের নির্দেশে সেই সময় মামলার তদন্ত কার্যক্রমটি চাঞ্চল্যকর মামলার তালিকায় স্থান পেয়েছিল।
আমি ব্যক্তিগতভাবে দেশবাসী ও সরকারের কাছে এই ছয় বছর ধরে আমার ও আমার পরিবারের পাশে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বিশেষভাবে আমার মনে পড়ছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ২০১১ সালের ১৫ জুলাই মন্তব্য করেন, ‘নূরুল ইসলাম ও তাঁর ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।’ (প্রথম আলো, ১৬ জুলাই, ২০১১)। এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বারবার কথা বলেছেন। এ হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রবিরোধী ও জঙ্গিবাদের লালন-পালনকারীরাই গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নূরুল ইসলামকে হত্যা করেছে।’ (৩০ জুলাই, ২০১০, বাংলানিউজ২৪ ডটকম)। এ বছর ৩০ নভেম্বর তিনি গণতন্ত্রী পার্টি আয়োজিত স্মরণসভায় উপস্থিত হয়ে একইভাবে তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করছেন। ‘আইনমন্ত্রী স্বয়ং সংসদে সুবিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আগের ধারা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেরিয়ে আসতে পারছে না।’ (১৯ ডিসেম্বর, ২০১০ প্রথম আলো)
সরকারের নেতাদের ও সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও তদন্তের আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় আমি হতাশাগ্রস্ত বোধ করছি। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের তদন্তকারী দল তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর প্রায় তিন বছর গত হয়েছে। সিআইডি, র্যাব হয়ে বর্তমানে ডিবি এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না। এটি রহস্যজনক।
এ অবস্থায় তদন্ত-প্রক্রিয়ার অচলাবস্থা সম্বন্ধে আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট মতামত ও প্রস্তাব সরকার ও নাগরিক সমাজের বিবেচনার জন্য তুলে ধরছি। প্রথমত, আমরা তদন্তের ধীরগতিতে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। কারা ভুয়া ঋণখেলাপির মামলাসংক্রান্ত কাগজ তৈরি করেছিল, সেটি উদ্ঘাটন করা প্রাথমিক দায়িত্ব হওয়া সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই। দ্বিতীয়ত, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান ‘অসমিয়াম’ সহজলভ্য নয়। আমরা মনে করি, এই সূত্র ধরেও অপরাধী শনাক্ত করার যথাযথ চেষ্টা হয়নি। তৃতীয়ত, কারা নূরুল ইসলামকে ঢাকা ত্যাগ করতে দেয়নি এবং কুমিল্লা পর্যন্ত গিয়েও কাদের টেলিফোন বার্তায় প্রভাবিত হয়ে তিনি ঢাকা ফিরে আসতে বাধ্য হন—এটি যথাযথভাবে তদন্ত হওয়া দরকার। চতুর্থত, টেলিফোন কললিস্টের মাধ্যমে অনুসন্ধান চালিয়ে কারা ফোনে হুমকি প্রদান করেছিল, তা এই ছয় বছরেও চিহ্নিত করা হয়নি। উল্লেখ্য, মৃত্যুর আগে দেওয়া টিভি সাক্ষাৎকারে নূরুল ইসলাম জানান, দীর্ঘ সময় ধরে তিনি ও তমোহর টেলিফোনে মৃত্যুর হুমকি পেয়ে আসছিলেন।
তদন্তকারী সংস্থাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। এক প্রতিবেদনের সঙ্গে অন্য প্রতিবেদনের স্ববিরোধিতা চোখে পড়ার মতো। কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই হত্যাকারী খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া স্তব্ধ করার চেষ্টাও হয়েছে। আবারও সরকারের উচ্চ মহলের হস্তক্ষেপে তদন্তকাজ প্রাণ ফিরে পাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই সাপ-লুডু খেলায় তদন্ত ও বিচার-প্রক্রিয়া রহস্যজনক গোলকধাঁধায় ঘুরছে ছয় বছর ধরে।
এই কঠিন সময়ে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। চার-দলীয় জোটের অন্যতম নেতা নূরুল ইসলাম ও আমাদের একমাত্র ছেলে ইসলাম তমোহরের হত্যায় জড়িত অপরাধীদের অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার এবং বিচারের প্রক্রিয়া গতিশীল করায় সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য আমি সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
রুবী রহমান: কবি ও সাবেক সাংসদ।