আফ্রিকা কিংবা বিশ্বের অন্য প্রান্তের নিম্ন আয়ের দেশগুলো ধনী দেশগুলোর প্রতি কোভিড-১৯-এর অব্যবহৃত টিকা মজুত না করার মিনতি জানিয়েছে। এ বছরের জি-৭ সম্মেলনে আমেরিকা ও ইউরোপের নেতারা আগামী বছরের মধ্যে বিশ্বের সব মানুষকে টিকা দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেটা কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে সত্যিকারের শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন বলেছে, বিশ্বের উত্তর গোলার্ধের দেশগুলো আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে পর্যাপ্তসংখ্যক টিকা সরবরাহ করতে পারবে। কিন্তু টিকাকরণের ক্ষেত্রে ধনী দেশগুলোর সঙ্গে গরিব দেশগুলোর ব্যবধান বেড়েই চলেছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ২ শতাংশের কম মানুষ এখন পর্যন্ত করোনার দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন। অন্যদিকে ধনী দেশগুলোর ৫০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এরই মধ্যে টিকা পেয়ে গেছেন। আরও খারাপ বিষয় হচ্ছে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোর লাখ লাখ ডোজ টিকা এখন নষ্ট হচ্ছে। কেননা, সেগুলো সময়মতো ব্যবহার করা হয়নি।
এ বছরের শুরুর দিকে পশ্চিমা সরকারগুলো অন্তত বলতে পেরেছিল, বৈশ্বিক চাহিদা মেটানোর মতো টিকা তাদের কাছে নেই। কিন্তু আমরা এখন মাসে ১৫০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করছি। এই লেখা আমি যখন লিখছি, তখন ৩০ কোটি ডোজ টিকা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কিন্তু টিকা ঘাটতির ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর ১০ শতাংশ মানুষকে টিকাকরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল, সেটা পূরণ হচ্ছে না। ওই সব দেশের স্বাস্থ্যকর্মী ও বয়স্কদের টিকার আওতায় আনতে এ পরিমাণ টিকা দরকার।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইয়ারফিনিটির তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে অব্যবহৃত টিকার সংখ্যা দাঁড়াবে ১০০ কোটি ডোজ। পশ্চিমারা টিকার একচেটিয়াকরণের ফলে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। হতবুদ্ধি করে দেওয়া এই তথ্য বাস্তব প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মেলানো কঠিন। এ সংখ্যক টিকা দিয়ে এ বছরের মধ্যে আফ্রিকার ৪০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব। সবচেয়ে খারাপ যে বিষয়টা ইয়ারফিনিটি জানাচ্ছে, সেটা হলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ১০ কোটি ডোজ টিকার মেয়াদ এ বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। আবার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার অন্তত দুই মাস আগে যদি প্রয়োজনীয় টিকা পাঠানো না যায়, তাহলে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ২৪ কোটি ১০ লাখ। এ অপচয় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
রাজনীতিবিদেরা খুব সহজেই অতিরঞ্জন করেন। কিন্তু দক্ষিণ গোলার্ধের বাসিন্দাদের জন্য টিকা, করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা সহজলভ্য করা না গেলে আগামী বছরে কোভিডে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। বিষয়টি অতিকথন নয়। আমরা জানি, টিকার কারণে ব্রিটেনে এক লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করা গেছে। এখন ২০ কোটি ডোজ টিকা নষ্ট করা হচ্ছে। এই সংখ্যক টিকা দিয়ে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর কত লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব?
টিকাকরণের ক্ষেত্রে ধনী দেশগুলোর সঙ্গে গরিব দেশগুলোর ব্যবধান বেড়েই চলেছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ২ শতাংশের কম মানুষ এখন পর্যন্ত করোনার দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন। অন্যদিকে ধনী দেশগুলোর ৫০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এরই মধ্যে টিকা পেয়ে গেছেন। আরও খারাপ বিষয় হচ্ছে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোর লাখ লাখ ডোজ টিকা এখন নষ্ট হচ্ছে। কেননা, সেগুলো সময়মতো ব্যবহার করা হয়নি।
এ সপ্তাহে বাইডেনের টিকা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনের ফল হিসেবে আরও অনেক বেশি মানুষের জীবন অনিশ্চয়তায় ঝুলে গেল। বাকি বিশ্বের জন্য পশ্চিম যদি এখন প্রয়োজনীয়সংখ্যক টিকা সরবরাহ করতে না পারে, তাহলে নিম্ন আয়ের দেশগুলো তাদের খুব বেশি বিশ্বাস করবে না। টিকার প্রয়োজনটা যখন খুব বেশি, তখন আমাদের হাতে থাকা উদ্বৃত্ত ডোজ টিকা তাদের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হচ্ছি। অদ্ভুতুড়ে এই ব্যর্থতা মানবীয় সংহতি ও শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে একটা বড় পরীক্ষা।
বিশ্বনেতারা এ মাসে জাতিসংঘ অধিবেশনে মিলিত হয়েছেন। আমাদের আশাটা খুব বেশিও নয়। টিকাবৈষম্যের যে দানবীয় ও ক্ষমার অযোগ্য বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, সেটাকে সহনীয় করার একটা সন্ধিক্ষণ এসেছে। অব্যবহৃত ২০ কোটি ডোজ টিকা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে কোভ্যাক্স ও আফ্রিকান টিকা অধিগ্রহণ ট্রাস্টের মাধ্যমে আফ্রিকা ও বিশ্বের অন্য নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে বিতরণ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিটি দেশের জন্য ১০ শতাংশ টিকাকরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সেটা বাস্তবায়নের জন্য এ সংখ্যক টিকা যথেষ্ট। এরপর প্রতি মাসে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলো ১০ কোটি ডোজ করে টিকা সরবরাহ করতে পারে। এতে এই বছরে আফ্রিকার যে ৫০ কোটি টিকার ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণ করা সম্ভব হবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি টিকা জাতীয়তাবাদ বৈষম্য ও অপচয়কে কেমন করে উসকে দিচ্ছে। এটা এড়ানো গেলে অনেক মৃত্যু রুখে দেওয়া যেত। এটা শুধু স্বার্থপরতা নয়, এটা আত্মপরাজয়ও। যতক্ষণ পর্যন্ত নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে করোনার বিস্তার হতে আমরা দিচ্ছি, তত দিন করোনার নতুন ধরন উদ্ভবের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। এমনকি পুরো জনগোষ্ঠীকে টিকাকরণের পরও এ থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে না।
প্রকৃত সত্যটা লুকিয়ে আছে আফ্রিকান নেতাদের একটি বিবৃতিতে। তাঁরা মহাকাব্যসম নৈতিক এই বিপর্যয় প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন। একটি উচ্চ সংক্রমণশীল অসুখ বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে সম্মিলিত বৈশ্বিক উদ্যোগের বিকল্প নেই।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● গর্ডন ব্রাউন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, জাতিসংঘের বৈশ্বিক শিক্ষা বিষয়ে বিশেষ দূত