মনে পড়ে, স্বাধীনতার পর রাজনীতিক ও কূটনীতিক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গির কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা বলেননি, কিন্তু দেশের ভেতরে মুসলমানদের স্বশাসনের কথা বলেছিলেন। তখন কেউ তাঁর কথা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি; এমনকি মুসলমানরাও নয়। কারণ, দেশভাগ তখন হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জন্য দুর্গতি বয়ে এনেছিল।

এখন অল-ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের প্রেসিডেন্ট আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বলছেন, সশস্ত্র বাহিনীর চাকরিতে মুসলমানদের জন্য আলাদা কোটা থাকা উচিত। ওয়াইসির এই দাবি সংগত; কারণ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মুসলমানদের সংখ্যা কমে এসেছে। তবে এটাই বোধ হয় অবশ্যম্ভাবী ছিল, কারণ ভারত ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে এবং মুসলিম সেনারা পাকিস্তানি অংশে চলে গিয়েছিলেন।

আমার মনে আছে, কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে এ নিয়ে আলোচনার সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার প্যাটেল মুসলমানদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন মুসলমান নেতারাই বলেছিলেন, তাঁরা কোনো ধরনের কোটা চান না। কারণ, এ ধরনের উদ্যোগের ফলেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।

ওয়াইসির দুঃখ এটা যে প্রধানমন্ত্রীর ১৫ দফা কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে সংখ্যালঘুদের অংশ বাড়ানোর কথা বলা হলেও এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। সম্প্রতি এক জনসভায় এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে অনেকে তাঁকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলেন। তখন তিনি বলেন, এরা অজ্ঞ, উদ্ধত, এরা এ সম্পর্কে কিছু পড়েনি। ওয়াইসি বলেন, ১৫ দফা কর্মসূচির ১০ নম্বর দফায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিগুলোতে মুসলমানদের নিয়োগ দিতে হবে। তিনি বলেন, শুধু তা-ই নয়, নিয়োগ কমিটিতে মুসলমান ও দলিত সম্প্রদায়ের সদস্যদেরও রাখতে হবে।

ওয়াইসি উল্লেখ করেছেন, সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নাকভি ভুলভাবে দাবি করেছিলেন যে সরকারি চাকরিতে সংখ্যালঘুদের হার বেড়েছে। আমি সরকারের ভুল দাবি সবার সামনে তুলে ধরেছি। ওয়াইসির মতে, ‘সিআইএসএফে মুসলিম নিয়োগের হার মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। সিআরপিএফে তারা মাত্র ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং র‍্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সে মাত্র ৬ দশমিক ৯ শতাংশ।’ তিনি এমনকি নরেন্দ্র মোদির সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের সব সংস্থার নিয়োগের তথ্য প্রকাশের চ্যালেঞ্জও নেন।

হায়দরাবাদের এই সাংসদ আরও বলেন, সরকারের উচিত ব্যাংক, রেলওয়ে ও অন্যান্য সরকারি সংস্থায় নিয়োগের তথ্য প্রকাশ করা, যাতে বোঝা যায় যে কত শতাংশ সংখ্যালঘুকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিজেপি সংখ্যালঘুদের প্রতি সুবিচার করছে না।

কংগ্রেস হচ্ছে একমাত্র দল, মুসলমানদের প্রতি যার সমর্থন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি জনসমক্ষে মুসলমানদের সমর্থন করার জন্য কংগ্রেসকে দোষারোপ করেন। আজমগড়ে দেওয়া বক্তৃতায় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী মুসলমানদের তিন তালাক পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করায় মোদি এর নিন্দা করেন।

মোদি বলেন, ‘গত দুই দিনে আমি শুনেছি যে একজন নামদার নেতা বলছেন যে কংগ্রেস হচ্ছে মুসলমানদের দল। না, আমি এতে বিস্মিত হইনি।’ এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও একবার বলেছিলেন, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে মুসলমানদের অধিকার আছে। ২০০৬ সালে জাতীয় উন্নয়ন কাউন্সিলের এক বৈঠকে মনমোহন সিং বলেছিলেন: সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলমানদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমাদের উদ্ভাবনী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে তাদের অধিকার সবার আগে।

যাহোক, সরকারি বিষয়ে মুসলমানরা সব সময় উপেক্ষিতই থেকেছে। ওয়াইসি বলেন, যদি দেশের উন্নয়নে মুসলমানরা ভূমিকা রাখতে পারত, তাহলে বাকি বিশ্বের জন্য ভারত হতো একটি উদাহরণ। আমি দেখেছি, বেশির ভাগ মুসলিম নেতা এমনভাবে কথা বলেন, যেন তাঁরা দুই দেশের মানুষ। তাঁদের এটা বুঝতে হবে যে এখানে কেবল একটি দেশই আছে আর তা হচ্ছে ভারত এবং ধর্ম রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। আমার উপলব্ধি হচ্ছে, আমরা প্রথমে ভারতীয় এবং এরপর আমরা হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান। এমনকি আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সেক্যুলার’ বা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্যকেই প্রকাশ করে।

ওয়াইসি হয়তো আসন্ন নির্বাচনে ভোট পাওয়ার জন্য এসব কথা বলছেন। কিন্তু তিনি এর মধ্য দিয়ে ঘৃণার বীজ বপন করছেন, যা এখনই উপড়ে ফেলতে হবে। আমি এ-ও লক্ষ করেছি, আরএসএস তখনই বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে, যখন তারা দেখে যে সরকার হিন্দুত্ববাদকে সমর্থন দেওয়ার জন্য তাদের কার্যকলাপ মেনে নিচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমুন্নত রাখার জন্য যাদের দাঁড়ানোর কথা, তারা দেখি এখন নীরব। আর ওয়াইসির কণ্ঠস্বর খুবই উচ্চ।


কুলদীপ নায়ার ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট