ধর্ষণ প্রতিরোধে আইনশিক্ষার দায়বদ্ধতা কতটুকু

ধর্ষণ
প্রতীকী ছবি

ধর্ষণের আলোচনায় আসে বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতার প্রশ্ন। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই অন্য একটি আলাপে, যা কম আলোচিত, তা হলো নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইনশিক্ষার ভূমিকা ও কার্যকারিতা।

অপরাধ মানুষ করে, মানুষই আইন তৈরি করে, মামলা চালায়, মানুষই রায় দেয়। যে সমাজে ধর্ষকামী চিন্তা লালিত হয়, সেখানে আইনজীবী ও বিচারকেরাও আছেন। পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখি, যুবসমাজের একাংশ প্রতিবাদী, আরেকাংশের মন্তব্য ‘যৌন আক্রমণ এবং ধর্ষকামী’ মানসিকতার পরিচায়ক। তাই প্রশ্ন ওঠে, এমন সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ আইনজীবী, আইনপ্রণেতা এবং বিচারক গড়ে তুলতে বিদ্যমান আইন শিক্ষার প্রভাব কী?

দেশের আইনশিক্ষা মূলত ওকালতিকেন্দ্রিক। বার কাউন্সিলের আইনজীবী সনদপ্রাপ্তির পরীক্ষা মাথায় রেখেই ইউজিসির অনুমতিক্রমে পাঠ্যক্রম প্রণীত হয়। কিছু বিভাগে বিশেষ কোর্স পড়ানো হলেও মোটাদাগে আইন বিভাগের দুটি কোর্স ডিজাইনে খুব বেশি বৈচিত্র্যের সুযোগ নেই, বিশেষত স্নাতক পর্যায়ে। শিক্ষার্থীরা চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত মূলত শেখেন দেশের প্রচলিত বিভিন্ন আইন, আইন ব্যাখ্যার নীতি এবং আদালতের নজির। চুক্তি আইন, দেওয়ানি ও ফৌজদারি, ভূমি, বাণিজ্য, পরিবেশ, আন্তর্জাতিক প্রভৃতি আদালতের আইন পড়া হচ্ছে, কিন্তু আদালতের বাইরে যে সমাজের জন্য আইন, সেই সমাজ নিয়ে পড়াশোনা হয় কি? কোনো শিক্ষার্থী ১৮–১৯ বছর বয়স পর্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশে বেড়ে উঠলে শুধু আইনের তাত্ত্বিক পাঠ তাঁর মনে কতটা দাগ কাটতে পারে?

একজন উকিল আইনের কেমন ব্যাখ্যা দেবেন, বিচারকের কাছে কোন ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হবে, তা তাঁদের ব্যক্তিগত মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত; ধর্ম, রাজনীতি, জেন্ডার, ঔপনিবেশিকতা প্রভৃতি দ্বারা প্রভাবিত। বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, জাতিসত্তা, নারী, পুরুষ, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ প্রভৃতির সমন্বয়ে গড়া মিশ্র সমাজে আইনের মিথস্ক্রিয়া জটিল। আমাদের আইনশিক্ষা আজও অস্টিন, হার্ট, কেলসেনকেন্দ্রিক, যেখানে আইনকে বিভিন্ন সামাজিক ক্ষমতার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভাবা হয়। ফুকো, ম্যাককিনন, স্যালি মেরি, গ্যালান্টার প্রমুখ সোশিওলিগ্যাল ও ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকেরা ১৯৭০-২০০০ সময়ে সামাজিক বাস্তবতায় আইনের হেজেমনিক, ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও নারীবাদী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা পাঠ্যক্রমে নেই। সমাজের ট্যাবু, কুসংস্কার, বৈষম্য কীভাবে আইনের প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা বদলায়, সে পড়াশোনা ছাড়া আইনের তাত্ত্বিক ধারার বাস্তব প্রয়োগ দুর্বল হয়।

উদাহরণস্বরূপ, পারিবারিক নির্যাতন বলতে শারীরিক ছাড়াও মানসিক ও মৌখিক নির্যাতন বোঝায়। এ কথা আইনে থাকলেও আদালতে প্রয়োগ নেই। দণ্ডবিধি ১৮৬০ শেখায় ধর্ষণ মানে বলপূর্বক পেনেট্রেশন, কিন্তু আইনের ধারা এটা শেখাবে না যে ধর্ষণ মানে একজন মানুষের নিজ শরীরের আত্মনিয়ন্ত্রণ অন্যায়ভাবে হরণ করা। ফলে যৌনাঙ্গে কোনো বস্তুর পেনেট্রেশন হলে আদালত ভাবতে বসেন তা ধর্ষণ হবে কি না? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা আমাদের এক সহকর্মীকে বলেছেন, পুরুষদের যৌনকাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, তাই ধর্ষণের দায় নারীর। মামলা পরিচালনার কৌশল শেখাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বাল্যবিবাহ যে নারীর অবদমনের হাতিয়ার, সেই যুক্তি ক্লাসরুমে শেখার সুযোগ বা দরকার কতটা? আজও ধর্ষণ প্রমাণের জন্য আদালতে নারীর সম্মতির চেয়ে পেনেট্রেশন বেশি গুরুত্ব পায়। সম্মতির স্বরূপ বুঝতে মানুষের সামাজিক অবস্থান ও ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ বুঝতে হয়। আইনের ধারাপাঠে এ আলাপ হয় না যে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ধ্যানধারণা মানুষের ব্যবহার কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। যে সমাজে নারীরা নিজের মতামত জাহিরে অভ্যস্ত নন, তাঁদের সম্মতির ধরন কেমন? যৌনকর্মীকে ধর্ষণ কীভাবে প্রমাণিত হবে? বিবাহিত স্ত্রীর সম্মতি নেওয়া কি নিষ্প্রয়োজন? শহুরে নারী আর গ্রামীণ নারীর সম্মতি জ্ঞাপন বা প্রতিরোধের বহিঃপ্রকাশ কি এক হবে? এসব যুক্তিতর্ক আদালতে খুব বেশি দূর যায় না।

আইন বিভাগে মেডিকেল জুরিস্প্রুডেন্স নিয়ে কোর্স বাধ্যতামূলক নয়। আদালতে এখনো মেডিকেল রিপোর্টে ডিফেন্সিভ মার্ক না থাকলে উকিল যুক্তি দেন সম্মতির ভিত্তিতে যৌনতা হয়েছিল। আধুনিক অপরাধ মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী ভিকটিম ট্রমায় অসাড় হয়ে ধর্ষককে বাধা দেওয়ার অবস্থায় থাকেন না। আধুনিক আইনবিজ্ঞানে রেপ সার্ভাইভারদের বারবার বিবৃতি নেওয়া নিষেধ। একজন ট্রমাটাইজড মানুষ বারবার আক্রমণের বিবৃতি দিলে মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করে না। শিক্ষার্থী এসব ‘অ-আইনি’ সাইকোসোশ্যাল তত্ত্ব না জানলে উকিল হিসেবে বাদীর বক্তব্যের অসামঞ্জস্যকে মিথ্যা অভিযোগ হিসেবে দেখাবেন, বিচারকও স্বতন্ত্রভাবে মেডিকেল রিপোর্ট যাচাই করতে পারবেন না। ক্রিটিক্যাল রেস থিওরি, ইন্টারসেকশনালিটি না জানলে মুসলিম বাঙালি নারী ও অমুসলিম অবাঙালি নারীর ধর্ষণের পার্থক্য আদালতকে বোঝাতে কষ্ট হবে।

এখনো ব্রিটিশ আমলের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা পড়ানো হচ্ছে (ধর্ষণের মামলায় বাদীর চরিত্র নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে)। আইনের শিক্ষার্থীরা যদি সাবজুগেশন বা এজেন্সি না বোঝেন, তাহলে তাঁরা ওই ধারার উপর্যুপরি প্রয়োগে বাদীকে নাস্তানাবুদ করবেন এটাই স্বাভাবিক, কারণ প্রচলিত আইনশিক্ষা বলে উকিলের কাজ মক্কেলকে জেতানো। পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গের ধর্ষণ নিয়ে তো পড়াশোনাই হয় না। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে হাল আমলের বইপত্র নেই। পারিবারিক আইনের রেফারেন্স হিসেবে এখনো ৭০-৮০ দশকের বই পড়ানো হয়।

এই সেকেলে বিদ্যা আর প্রতিক্রিয়াশীল মনন নিয়ে আইনশিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা আইনজীবী, বিচারক, এমনকি আইনের শিক্ষক হচ্ছেন। অনেক সময় আমরা নারী আইন শিক্ষার্থীদের অনুযোগ শুনি যে তাঁরা পোশাকের কারণে, ক্লাসে কোনো বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে পুরুষ সহপাঠীদের যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। শিক্ষাসফরে ‘ও টুনির মা’ ‘চুমকি চলেছে’ প্রভৃতি চটুল গান জনপ্রিয়। আইনের শিক্ষার্থী যদি ধরতে না পারেন এই গানগুলো নারীদের ‘যৌনবস্তুতে পরিণত’ করাকে স্বাভাবিকীকরণ করেছে, তবে তা উদ্বেগের বিষয়। পুরুষতান্ত্রিক গোঁড়া মতাদর্শ পোষণের দায় অনেকখানি বর্তায় আইনশিক্ষা কাঠামোর ওপরে।

নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে আচরণগত ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের জন্য বিদ্যমান আইনশিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদের (সিডও) পূর্ণ বাস্তবায়ন জরুরি। দরকার নতুনভাবে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত আইনজীবী, বিচারক ও শিক্ষক।

ড. মিজানুর রহমান: আইন বিভাগের অধ্যাপক ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান।

অর্পিতা শামস মিজান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক