নিয়াজি পাকিস্তানের মর্যাদা ধূলিসাৎ করেছেন

এবারে বিজয় দিবস সামনে রেখে প্রথম আলোর এই ধারাবাহিক আয়োজনের বিষয় দেশি-বিদেশি লেখকদের লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হলো এসব বইয়ের নির্বাচিত অংশ থেকে। লে. জেনারেল (অব.) কামাল মতিনউদ্দিন নানা দলিলপত্র, সংবাদপত্রের নিবন্ধ ও বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ট্রাজেডি অব এরর্স: ইস্ট পাকিস্তান ক্রাইসিস ১৯৬৮-১৯৭১ গ্রন্থটি লিখেছেন। সে বই থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের চুম্বক অংশ নিচে তুলে ধরা হলো।

ট্রাজেডি অব এরর্স: ইস্ট পাকিস্তান ক্রাইসিস ১৯৬৮-১৯৭১
ট্রাজেডি অব এরর্স: ইস্ট পাকিস্তান ক্রাইসিস ১৯৬৮-১৯৭১

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ড. এ এম মালিক ৭ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার ও প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। যুদ্ধের অবস্থা পর্যালোচনা করে তাঁরা ঐকমত্যে আসেন যে পরিস্থিতি গুরুতর। রাষ্ট্রপতিকে এ ব্যাপারে জানিয়ে তাঁরা অবিলম্বে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুপারিশ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন।
ড. মালিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এ মর্মে টেলেক্স করলে তিনি উত্তরে জানান, বিশ্বের বিভিন্ন শক্তির সহায়তায় তিনি যুদ্ধবিরতি আয়োজনের চেষ্টা করছেন। তিনি আরও জানান, কোনো সামরিক কৌশল নিলে পাকিস্তানকে জমি হারাতে হবে না, সে বিষয়ে জেনারেল নিয়াজিকে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। পরদিন ৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি গভর্নরকে আরও একটি সংকেত পাঠান। এতে বলা হয়, রাজনৈতিক পর্যায়ে সব রকম প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে।
ড. মালিক বুঝে গিয়েছিলেন, পাকিস্তান সোনবাহিনী আর বেশি দিন টিকবে না। তিনি জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে জানান, জাতিসংঘ যে ঢাকাকে উন্মুক্ত শহর হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব দিয়েছে, তার সঙ্গে তিনি একমত। কিন্তু জেনারেল নিয়াজি তা মানতে নারাজ, তিনি শেষ ও শেষ গুলি পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে চান।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানও সে সময় বুঝে গেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে এ লড়াই বেশি দিন আর চালানো যাবে না। এ অবস্থায় যা কিছু পুনরুদ্ধার করা যায়, তা-ই করতে হবে, সেই লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি সেদিনই পাঠানো প্রত্যুত্তরে ড. মালিককে পূর্ব পাকিস্তানবিষয়ক যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেন। তিনি সবকিছু গভর্নরের বিবেচনা ও শুভবোধের ওপর ছেড়ে দেন। ইয়াহিয়া খান জেনারেল নিয়াজিকেও জানিয়ে দেন, তিনি যেন গভর্নরের সিদ্ধান্ত মেনে যথোচিত ব্যবস্থা নেন।
ড. মালিক সে রাতেই মুখ্য সচিবকে ডাকেন। জাতিসংঘের মহসচিবের ঢাকা প্রতিনিধিকে দেওয়ার জন্য একটি বার্তা খসড়া করা হলো। গভর্নরের প্রস্তাবের মধ্যে ছিল অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি আয়োজন, যাতে সেনাবাহিনীর সদস্য ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি অনুগত নাগরিকদের পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো সম্ভব হয়। আর পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধি অর্থাৎ আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
খসড়াটি নিয়ে জেনারেল ফরমান জেনারেল নিয়াজির কাছে যান। নিয়াজি জেনারেল ফরমানের কাছে জানতে চান, তিনি কোন ক্ষমতাবলে এই বার্তা অনুমোদন করতে পারেন। তাঁকে বলা হয়, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে তাঁকে এ কাজ করতে হবে। এরপর নিয়াজি অ্যাডমিরাল শরিফ ও জেনারেল জামশেদের উপস্থিতিতে এই টেলেক্স জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিবের কাছে পাঠাতে রাজি হন।
এরপর পল মার্ক হেনরিকে গভর্নমেন্ট হাউসে ডেকে পাঠানো হয়, গভর্নর তাঁর হাতে বার্তাটি পৌঁছে দেন। জেনারেল ফরমানকে বলা হয়, তিনি যেন রাষ্ট্রপতিকে তা পাঠিয়ে দেন, তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন। আর সেনা-সংকেতে সই করেন জেনারেল ফরমান।
প্রেসিডেন্ট অবশ্য এ বার্তা পড়ে খুশি হতে পারেননি। তিনি আওয়ামী লীগের ছয় দফা মেনে নিতে আগ্রহী ছিলেন না। সে কারণে তিনি ১০ ডিসেম্বর গভর্নরকে মৃদু ভর্ৎসনা করে বলেন, গভর্নর তাঁর ক্ষমতাবহির্ভূত কাজ করেছেন।
এরপর ড. মালিক জাতিসংঘের কাছে কী প্রস্তাব পেশ করবেন, তার খসড়া প্রস্তুত করে দেন জেনারেল ইয়াহিয়া। সেই প্রস্তাবের মধ্যে ছিল: ১) তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি, ২) পূর্ব পাকিস্তানে থাকা ব্যক্তিদের ওপর প্রত্যাঘাত না হওয়ার নিশ্চয়তা, ৩) আত্মসমর্পণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
প্রেসিডেন্ট সামরিক সহায়তা লাভের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন বলে মনে হয়। ফলে ১১ ডিসেম্বর তিনি গভর্নর মালিককে জানান, ১০ তারিখের বার্তার ভিত্তিতে যেন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হয়। তিনি কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তার ভিত্তিতে আরও ৩৬ ঘণ্টা যেকোনো মূল্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকায় গভর্নর হাউসসহ বিভিন্ন স্থাপনায় বোমাবর্ষণ করে। এমনকি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেতার চ্যানেল ব্যবহার করে ভারতীয়রা গুজব ছড়ায়। ড. মালিক ধারণা করেন, পূর্ব পাকিস্তান শিগগিরই বাংলাদেশ হবে। ফলে তিনি আর গভর্নর হাউসে থাকা নিরাপদ বোধ করলেন না। তিনি পরের দিনই পদত্যাগ করে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আশ্রয় নেন। এ হোটেলটি নিরপেক্ষ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
জেনারেল ইয়াহিয়া শেষ পর্যন্ত ১৪ ডিসেম্বর পরাজয় মেনে নেন। সেদিন তিনি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার ও গভর্নরকে এক অশ্রেণীকৃত সংকেতে নির্দেশনা দেন, তাঁরা যেন যুদ্ধ বন্ধ এবং সেনা ও পাকিস্তানের প্রতি অনুগত মানুষের জীবন রক্ষার্থে যথাযথ ব্যবস্থা নেন। তিনি আরও জানান, ভারত যেন পূর্ব পাকিস্তানে সব রকম বৈরীভাব বন্ধ করে, সে মর্মে পাকিস্তান জাতিসংঘে প্রস্তাব পেশ করেছে।
পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দপ্তরে এ সংকেত এসে পৌঁছায় ১৪ ডিসেম্বর বেলা দুইটায়। এয়ার কমোডর ইনামুল হক, রিয়ার অ্যাডমিরাল মুহাম্মদ শরিফ ও মেজর জেনারেল ফরমান এ সংকেতটির নানা রকম ব্যাখ্যা দেন। অর্থাৎ যুদ্ধ বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় সব রকম ব্যবস্থা নিতে কী বোঝায়, সে বিষয়ে তাঁরা আলোচনা করেন। এই প্রথম ঢাকায় সেনাবাহিনীর উচ্চমহলে আত্মসমর্পণ নিয়ে কথা হয়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মনে আসলে কী আছে, সেটা বোঝার জন্য নিয়াজি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সক্ষম হননি। চিফ অব স্টাফ জেনারেল গুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি নাকি বলেন, ‘কিসের সংকেত, কিসের আত্মসমর্পণের কথা বলছেন আপনি।’
শেষমেশ উপর্যুক্ত সংকেত পাওয়ার ১৮ ঘণ্টা পর নিয়াজি ঢাকার মার্কিন কনসাল জেনারেল হারবার্ট ডি. স্পিয়ার্কের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন ফরমান। নিয়াজি তাঁকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন ভারতীয় সেনাপ্রধানকে জানান, যেন ১) পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হয়, ২) সব সামরিক ও আধা সামরিক সেনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, ৩) সব অবাঙালি জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, ৪) অবাঙালিদের ওপর কোনো প্রত্যাঘাত করা না হয়।
তাঁরা নিশ্চিতভাবেই আত্মসমর্পণ শব্দটি ব্যবহার করেননি। ওদিকে জেনারেল অরোরা ১৫ ডিসেম্বর সকাল নয়টায় নিয়াজিকে পাঠানো এক বার্তায় জানিয়ে দেন, ভারতীয় হাইকমান্ড আত্মসমর্পণ চায়, নিছক যুদ্ধবিরতি নয়। নয়াদিল্লির মার্কিন দূতাবাস থেকে মানেকশকে এই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের ব্যাপারটি জানানো হয়। কিন্তু মানেকশকে সেদিন রাত ১১টা ৩০ মিনিটে সাফ জানিয়ে দেন, নিয়াজিকে যেন তাঁর সেনাদের অগ্রসরমাণ ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান, যেখানেই তারা মুখোমুখি হোক না কেন। আর আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সেনাদের মর্যাদা দেওয়া হবে। সঙ্গে তিনি আরও জানিয়ে দেন, নিয়াজি যদি তাঁর কথা না মানেন, তাহলে ১৬ ডিসেম্বর সকাল নয়টায় ভারতীয় বাহিনী চূড়ান্ত আঘাত হানবে।
নিয়াজি যখন কী করবেন বলে ভাবছিলেন, তখন টাঙ্গাইলে অবতরণ করা ভারতীয় ছত্রীসেনারা দ্রুত ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণের দলিলসহ একটি ছোট দল নিয়ে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় পৌঁছান। দলিলে লেখা ছিল, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করছে।’ কিন্তু মুক্তিবাহিনীর ভয়ে নিয়াজি এতে আপত্তি জানান। জ্যাকব সাফ জানিয়ে দেন, এটা দিল্লি থেকে এসেছে, তিনি এর এক বর্ণও পরিবর্তন করতে পারবেন না।
উপায়ন্তর না দেখে নিয়াজি রাজি হয়ে যান। জেনারেল অরোরার উপস্থিতিতে নিয়াজি বিকেল চারটা ৩১ মিনিটে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন। নিয়াজি তাঁর রিভলবার ও র্যাংক ব্যাজ অরোরার হাতে তুলে দেন। এমনকি নিয়াজি তাঁর আত্মসমর্পণের মুহূর্তের ছবির কপিও চেয়ে নেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি পাকিস্তানের মর্যাদা ধূলিসাৎ করেছেন।
নিয়াজি এতেই থামেননি, তিনি সেই ছবিতে সই করে অরোরাকে উপহার দেন। অরোরা তাঁর বাড়ির পাঠ ও খাবারকক্ষে সেই ছবি ও আত্মসমর্পণের দলিল গর্বভরে টাঙিয়ে রেখেছিলেন।
ট্র্যাজেডি অব এরর্স: ইস্ট পাকিস্তান ক্রাইসিস ১৯৬৮–৭১, লে. জেনারেল (অব.) কামাল মতিনউদ্দিন।