নিয়োগের আগেই প্রশিক্ষণ দিতে হবে শিক্ষকদের

শিক্ষা অর্জন একটি চলমান প্রক্রিয়া। শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষের জীবনকে অর্থবহ করার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সহায়তা করা এবং জীবিকা অর্জনের উপযোগী একজন দক্ষ মানবিক মানুষ হয়ে উঠতে সহযোগিতা করা। বর্তমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকালে দাঁড়িয়ে জ্ঞান, দক্ষতা, দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন, সংবেদনশীল, অভিযোজন-সক্ষম, মানবিক ও যোগ্য বিশ্ব–নাগরিক দরকার। একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা অনুযায়ী তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি-নির্ভর দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হিমশিম খাচ্ছে প্রচলিত আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা। তাই সময়ের প্রয়োজনে এবং নতুন বিশ্বপরিস্থিতিতে টিকে থাকার মতো যোগ্য নাগরিক গড়ে তুলতে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে।

বাংলাদেশের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে এটি সময়োপযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ, এতে কোনো সন্দেহ নেই।  কিন্তু এর বাস্তবায়নের রোডম্যাপ এবং আরও কিছু বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৩ সালে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ এবং পরের বছর থেকে দেশব্যাপী শুরু হবে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় যে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য যে রকম উপকরণ প্রণয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ ও দক্ষ মানবসম্পদের (শিক্ষকসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা) প্রয়োজন, এগুলোর সরবরাহ কি উল্লিখিত সময়ের মধ্যে সম্ভব? ইতিমধ্যে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ এই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন।

শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আসল রূপকার মূলত শিক্ষক। সেই শিক্ষকদের যদি যথাযথভাবে দক্ষতা বৃদ্ধি ও দীর্ঘদিনের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো না যায়, তাহলে এই শিক্ষাক্রমের সুফল ঘরে আসবে না। আসন্ন শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য অর্জন যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে আসল ক্ষতি হবে দেশের, দেশের জনগণের। নতুন এই শিক্ষাক্রমে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় গঠনবাদ বা জ্ঞানীয় বিকাশ তত্ত্বের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

এককথায় গঠনবাদ হলো অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা জীবনের প্রয়োজনে ব্যবহারের দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা। শুধু গঠনবাদই নয়, এই শিক্ষাক্রমে রুশ দার্শনিক লেভ ভাইগটস্কির সামাজিক গঠনবাদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এই মতবাদ অনুযায়ী শিশু জ্ঞান মুখস্থ করার বদলে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর জন্য সমস্যা সমাধান করার চেষ্টার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকে। শিক্ষক এখানে সহায়কের ভূমিকায় থাকেন।

বাংলাদেশের মতো দেশে চাকরিপ্রাপ্তিই প্রধান লক্ষ্য থাকে। একবার চাকরি (সরকারি) হলে তা আর হারানোর ভয় থাকে না; তাই তাঁদের কাছে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অনেকাংশে কমে যায়। এ কারণে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব থেকে যাচ্ছে সব সময়।

এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি প্রজেক্টভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিখবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা, পছন্দ, ইচ্ছা, আগ্রহ ও চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে কী, কীভাবে, কখন, কোথায় ও কেন শিখবে, তা নির্ধারিত হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, নতুন শিক্ষাক্রমের শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া অনেক বেশি নমনীয় এবং এর মূল্যায়নও লিখিত মুখস্থনির্ভর, পরীক্ষাভিত্তিক নয়। আলোচ্য শিক্ষাক্রমে আরও যেসব শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্রুনফ্রেনব্রেনারের ইকোলজিক্যাল সিস্টেম থিওরি। অন্যদিকে, শিখন শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যবহারের ফলে মানুষের শিখনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিনির্ভর স্বাধীনতা (শিক্ষার্থীর প্রবণতা ও প্রেষণা অনুযায়ী শিখনের সময়, বিষয়বস্তু, শিখনের স্থান, উদ্দেশ্য ও শিখনের প্রক্রিয়ায় বহুমাত্রিক নমনীয়তা নিশ্চিত করা) এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে আন্তযোগাযোগ স্থাপন করার ভিত্তিতে এক নতুন শিখন ধারণার উদ্ভব ঘটেছে, যা সংযোগবাদ নামে পরিচিত।

নতুন এই শিক্ষাক্রমে সামাজিক গঠনবাদভিত্তিক শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া এবং সংযোগবাদকে প্রধান শিখন ধারণা ও প্রায়োগিক কৌশল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মূল ভিত্তি অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন। নতুন এই শিক্ষাক্রমের শিখন-শেখানো কৌশল অংশটুকু পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে প্রচলিত বর্তমান শিক্ষাক্রমের শিখন-শেখানো কৌশলের তুলনায় নতুন শিক্ষাক্রমে উল্লিখিত শিখন-শেখানো কৌশলে নতুন নতুন কৌশল যুক্ত করা হয়েছে। এগুলো আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। প্রশ্ন হচ্ছে, যে শিক্ষকেরা নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের প্রধান গুরুদায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর কোনো প্রস্তাব নেই বললেই চলে । শুধু শিক্ষাক্রম বিস্তরণ অংশে উল্লেখ রয়েছে, মাঠপর্যায়ে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আগেই সব শিক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট স্টাফকে অনলাইন ও অফলাইন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানোই কি যথেষ্ট এর বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে? নতুন এই শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ অংশের (খ)-তে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা অংশে বলা হয়েছে, ‘সমন্বিত ও ধারাবাহিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ আয়োজন করা জরুরি’। ‘শিক্ষকদের প্রাক্‌-চাকরি ও দক্ষতা নির্ধারণ করে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে তোলা প্রয়োজন’। কিন্তু একটি নতুন শিক্ষাক্রম যাঁরা বাস্তবায়নের কান্ডারি, তাঁদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ আয়োজন জরুরি কিংবা প্রয়োজন, এ-জাতীয় কথা উল্লেখ করেই কি এর সফল বাস্তবায়ন সম্ভব? শিক্ষক প্রশিক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক ছাড়া কোনো শিক্ষাক্রমই সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

নতুন এই শিক্ষাক্রমের অন্যতম দুর্বল দিক হচ্ছে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা বা প্রস্তাবনার অভাব। পড়তে পারলেই পড়াতে পারব—এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। পড়ানো একটি বিশেষ আর্ট বা যোগ্যতা, যা অর্জন করতে হয়। যেমন মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পরীক্ষায় পাস করলেই ডাক্তার হওয়া যায় না। পরিপূর্ণভাবে ডাক্তার হতে হলে ইন্টার্নশিপ করে উত্তীর্ণ হতে হয়। তেমনি আইন বিষয়ে ডিগ্রি নিলেও গাউন পরে কোর্টে দাঁড়ানো যায় না। এর জন্য বার কাউন্সিল থেকে পেশাগত পরীক্ষায় পাস করতে হয়। তেমনি শ্রেণিকক্ষে পাঠ পরিচালনা করতে হলে আগে পাঠ পরিচালনার কলাকৌশল বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ কিংবা এ-বিষয়ক ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক তৈরিতে সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে।

যোগ্য ও দক্ষ জনবল তথা শিক্ষক তৈরির একটি ধারণা নিচে উপস্থাপন করা হলো। প্রথমত, শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হওয়ার আগেই শিক্ষাবিজ্ঞানে প্রাতিষ্ঠানিক সনদ কিংবা শিখন-শেখানো কলাকৌশল বিষয়ে তিন থেকে ছয় মাসের বিশেষ প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। বাংলাদেশে উল্টোটা হয়ে থাকে। আগে শিক্ষক হন, পরে প্রশিক্ষণ নেন। শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হওয়ার পরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বলে অংশগ্রহণকারীদের কাছে প্রশিক্ষণের তেমন গুরুত্ব থাকে না।

বাংলাদেশের মতো দেশে চাকরিপ্রাপ্তিই প্রধান লক্ষ্য থাকে। একবার চাকরি (সরকারি) হলে তা আর হারানোর ভয় থাকে না; তাই তাঁদের কাছে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অনেকাংশে কমে যায়। এ কারণে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব থেকে যাচ্ছে সব সময়।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষাবিজ্ঞানের সনদ কিংবা তিন থেকে ছয় মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষক, প্রশাসক, ব্যবস্থাপকসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সব ধরনের কর্মকর্তা নির্বাচন বা নিয়োগের জন্য পৃথক একটি শিক্ষক নিয়োগ একাডেমি গঠন করতে হবে। এই একাডেমি শিক্ষক হতে আগ্রহী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় বাছাই করে শিখন-শেখানো বিষয়ে তিন থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ আয়োজন করবে। একাডেমি থেকে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরাই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবেন। চতুর্থত, শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই পরবর্তী সময়ে শিক্ষা প্রশাসনসহ শিক্ষা ব্যবস্থাপনার অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজের জন্য উপযুক্ত হবেন। পঞ্চমত, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য শিক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে এবং স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ একাডেমি স্থাপন করে শিক্ষক নিয়োগসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

মো. সাইফুজ্জামান শিক্ষাবিষয়ক উন্নয়নকর্মী

ই-মেইল: [email protected]