ব্যাংক থেকে ঋণের তিন লাখ টাকা তুলে বাড়ি ফিরছিলেন এক ভদ্রলোক। পথে মোটরসাইকেল থেকে তাঁর টাকাসমেত ব্যাগটি পড়ে যায়। পথের ধুলায় টাকা গড়ালে কেউ কুড়িয়ে এনে ফিরিয়ে দেবেন, এ কথা ভাবা বাতুলতা। টাকার মালিকও নিশ্চয়ই আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশটা একেবারে উচ্ছন্নে গেছে বলে যারা হাহুতাশ করেন, তাঁরা শুনে বিস্মিত হবেন, সত্যিই টাকাটা ফেরত পেয়েছেন মূল মালিক। কীভাবে পেলেন? সিএনজিচালিত অটোরিকশার একজন চালক টাকাসমেত ব্যাগটি পেয়েছিলেন পথে, সেই ব্যাগেই অন্য কাগজপত্রের সঙ্গে মালিকের ফোন নম্বরটিও পাওয়া গেলে তাঁকে ফোন করে টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নেন তিনি। ঘটনাটি ঘটেছে সিলেটে। (প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট)।
অটোরিকশাচালকের এই সততায় মুগ্ধ হয়ে মানুষের প্রতি বিশ্বাসের ব্যাপারটা যখন একটু জোর পাচ্ছিল মনে, ঠিক তখন একই দিনের সংবাদপত্রের একই পৃষ্ঠায় আরেকটি সংবাদে চোখ আটকে গেল। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা ও এক কর্মচারীর ঘুষ নেওয়ার দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর গুনে গুনে ঘুষ গ্রহণের ভিডিওটি আমাদের দেশের উন্নয়নকাজে সংশ্লিষ্ট সরকারি চাকরিজীবীদের লোভ, ঠিকাদারদের অসহায়ত্ব এবং পরিণামে নিম্নমানের কাজ কীভাবে ভালো উদ্যোগকেও নস্যাৎ করছে, তা-ই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমাদের।
দুটি সাধারণ ঘটনা থেকে এ দেশের ভালো ও মন্দ মানুষের সংখ্যা সমান দুভাগে বিভক্ত, এ রকম কোনো মীমাংসায় আসার সুযোগ নেই। বরং কিছুটা গভীর বিশ্লেষণে গেলে বোধ হয় একটি ব্যাপার অনুমান করা যেতে পারে—অটোরিকশাচালকের মতো দরিদ্রদের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকা মানুষের লোভ ও দুর্নীতির দিকে ঝোঁক বেশি। এটি জরিপভিত্তিক কোনো অনুমান নয়, এর হেরফের হতে পারে। আবার এ প্রশ্নও উঠতে পারে, দরিদ্রদের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার সুযোগই-বা কোথায়? তাই অটোরিকশাচালকের সততার ব্যাপারটি হয়তো নেহাত ব্যতিক্রম।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বর্তমান সরকারের আমলে ‘উন্নয়ন’ যেমন একটি বহুল উচ্চারিত শব্দ, তেমনি দেশজুড়ে পরিচালিত ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড রীতিমতো দৃশ্যমান। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারটি থাকে বলেই এখানে অনিয়ম বা দুর্নীতির প্রসঙ্গ আসে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যেই ‘ক্ষীণ কণ্ঠে’ দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয় সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। ক্ষীণ কণ্ঠে বলছি, কারণ, এ ধরনের বক্তব্য স্রেফ উচ্চারিত হয় কয়েকজন সাংবাদিকের সামনে। এর চেয়ে বড় পরিসরে কথা বলার বা বক্তব্য-বিবৃতিকে প্রতিবাদের ভাষা করে তোলার সামর্থ্য ইতিমধ্যেই তাঁরা প্রায় হারিয়ে বসেছেন।
কিন্তু সেই ক্ষীণ কণ্ঠের বক্তব্যকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন সরকারি দলের অনলবর্ষী বক্তারা। যেমন দুর্নীতি নিয়ে এ রকম কিছু অভিযোগের উত্তরে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘যাদের আমলে দেশ পরপর চারবার এককভাবে ও একবার যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, তাদের মুখে দুর্নীতি নিয়ে মন্তব্য হাস্যকর।’ (প্রথম আলো, ৩০ জানুয়ারি)। বুঝলাম, যে সরকারের আমলে দেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিল, তারা এ বিষয়ে কথা বলার যোগ্যতা হারিয়েছে। কিন্তু আমরা দেশের আমজনতা কি প্রশ্ন করতে পারি ২০১৭ সালে দুর্নীতিতে যে দেশের অবস্থান ছিল ১৭তম, সেই দেশটি কেন ২০২০ সালে ১২তম অবস্থানে ফিরে এল। এই উল্টোরথে যাত্রা আমাদের শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যেতে পারে?
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এতে বেসরকারি খাতের পেশাজীবীরা কিছুটা ঈর্ষাবোধ করেন না, তা নয়। তবু এই ভেবে সান্ত্বনা পান, যথেষ্ট বেতন-ভাতা পেলে তাঁরা অন্তত সেবাপ্রার্থীদের সহজে কার্যসম্পাদনে সহায়তা করবেন, দুর্নীতিতে জড়াবেন না। কিন্তু আদতে কি তা হয়েছে? হলে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে কেন তাঁর ভাষণে সরকারি কর্মীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কোনো ধরনের দুর্নীতিতে না জড়ানোর জন্য হুঁশিয়ারি উল্লেখ করতে হলো?
রাজনীতিবিদদের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কথা হয়। কথায় কথায় তাঁদের সমালোচনাও হয়। একটি সরকারের বিদায়ের পর সেই আমলের রাজনীতিবিদ অনেককেই দুষ্কর্মের জন্য কারাভোগ থেকে শুরু করে নানান ভোগান্তি সহ্য করতে হয়। কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা অনেকেই সমান বা বেশি অপরাধ করেও পার পেয়ে যান।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যাওয়ার সময় ভারতের সীমান্তরক্ষীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন এক পুলিশ পরিদর্শক। দু-চার কোটি নয়, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের। আরেকজন সিআইডির উপপরিদর্শক গ্রেপ্তার হওয়ার পর জানা গেছে, তিনি তিন বছর ধরে ডাকাতিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। ভাবা যায়, পুলিশের পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তি ডাকাতির সঙ্গে জড়িত! অর্থের লোভ মানুষকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
পত্রপত্রিকা ঘাঁটলে এ রকম অসংখ্য উদাহরণ বের করা সম্ভব। হঠাৎ নৈতিকতার এ রকম অবনমন ঘটল কেন? অসাধু-অর্থলোভীর তালিকায় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা থেকে ব্যাংকার বা সাংবাদিক—কে নেই? দু-একজন বিত্তহীন-নিম্নবিত্তের সততার দৃষ্টান্ত বোধ হয় একটি দেশের গড়পড়তা মানুষের চরিত্র নির্ধারণের মাপকাঠি হতে পারে না। যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেও কিছু মানুষ যখন আরও বেশি আয় করার জন্য অসৎ পন্থা বেছে নেন, তখন ধরে নিতে হবে দেশে সুশাসনের ঘাটতিই এর মূল কারণ।
আগে কোনো সরকারের আমলে দেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, সেই স্মৃতিচারণা বর্তমান শাসকদের তৃপ্তির বিষয় হতে পারে না। কারণ, সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ছে দুর্নীতি। মুজিব শতবর্ষে গৃহহীনদের দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর উপহার নিয়েও যখন নানা ধরনের অনিয়মের কথা শোনা যায়, তখন অসাধারণ উদ্যোগটিও এক মণ দুধের মধ্যে এক ফোঁটা গো-চনার মতো অনেকাংশে ম্লান হয়ে যায়।
রাজনীতিবিদদের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কথা হয়। কথায় কথায় তাঁদের সমালোচনাও হয়। একটি সরকারের বিদায়ের পর সেই আমলের রাজনীতিবিদ অনেককেই দুষ্কর্মের জন্য কারাভোগ থেকে শুরু করে নানান ভোগান্তি সহ্য করতে হয়।
কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা অনেকেই সমান বা বেশি অপরাধ করেও পার পেয়ে যান। অথচ তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনার ব্যাপারে শৈথিল্য দেখালে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে বাধ্য। এ প্রসঙ্গে একজন সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিবের বক্তব্য ভেবে দেখার মতো, ‘বিপুল অর্থ ছাড়া কারও রাজনীতি করা বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিকাঠামোতে সম্ভব নয়।...কিন্তু রাজনীতিবিদেরা যা আয় করেন, তা আবার জনগণের পেছনেই ব্যয় করেন। আমলাদের দুর্নীতি ভয়াবহ। আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদিতার জন্য সেবাগ্রহীতার জীবনকে তাঁরা দুর্বিষহ করে তোলেন।’ (কাজী হাবিবুল আউয়াল, বিশেষ সাক্ষাৎকার, প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট)।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কি সাবেক আমলার এই বক্তব্যের তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করবেন? সংবাদপত্রের পাতায় প্রতিদিন দেশ ও সমাজের যে ছবি ফুটে ওঠে, তার অন্তর্নিহিত অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা কি করবেন তাঁরা?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী কথাসাহিত্যিক ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক