রাজনীতিতে অনেক সময় যেমন বহু পরিশ্রমের পরও কোনো ফল পাওয়া যায় না, তেমনি আবার অনেক সময় কিছু না করেই জেতা সম্ভব হয়। যেমন জিতেছিল কংগ্রেস, ২০০৪ সালে। তারা ভাবতেই পারেনি, প্রবল জনপ্রিয় ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দুই নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আদভানিকে এমন এক নেত্রী হারিয়ে দেবেন, ভারতীয় রাজনীতিতে যাঁকে বিদেশি চিহ্নিত করতে উঠেপড়ে লেগেছিল বিজেপি। কংগ্রেসের কেউ আশা করেননি, সেবার তাঁরা ক্ষমতায় আসতে পারেন।
এবার আসি ২০২১ সালে। গত ২ নভেম্বর সারা ভারতের ৩০টি আসনে বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফল বেরোল। কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা তলানিতে। ধরেই নেওয়া হয়েছিল কংগ্রেস মেরেকেটে একটি কি দুটি আসন পাবে। কিন্তু পেল আটটা। আর বিজেপি সাতটা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছিলেন, ভারতে ক্ষমতাসীন দলের নেতা নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল জনপ্রিয়তার শিখরে। তাও কংগ্রেস একটি আসন বেশি পেল বিজেপির থেকে।
অবশ্য এ তর্ক করাই যায়, বিজেপির শরিকেরা অনেক আসন পেয়েছে। সে ক্ষেত্রে এ–ও বলা যায়, কংগ্রেসের শরিক ও নিরপেক্ষ দলগুলো—যেমন তৃণমূল—বেশ কিছু আসন পেয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস যে এক-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে বসবে, এটা কেউ ভাবেনি। এই উপনির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্ট (সিপিআইএম) কোনো আসন পেল না পেলেও তাক লাগিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা গত নির্বাচনে যেখানে সিপিআইএম পেয়েছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট, সেখানে নভেম্বরের উপনির্বাচনে তাদের ভোট বেড়ে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হয়ে গেল।
অথচ এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা নতুন কোনো পথের সন্ধান দিয়েছেন—এমন কথা তাঁদের অতি বড় বন্ধুও বলতে পারবেন না। তবু তাঁদের ভোট প্রায় ৩ শতাংশ বেড়ে গেল। অনেকেই উপনির্বাচনের বিশেষ গুরুত্ব নেই বলে থাকলেও এটাও ঠিক যে গত ১০ বছরে এই প্রথম নির্বাচনে সিপিআইএমের ভোট সামান্য হলেও বাড়ল। তারা ২০১১ সালে ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, এই হার ২০১৬ সালে কমে ১৯ দশমিক ৭৫ হয়ে যায়। পরে এক ধাক্কায় এই বছরে তা নেমে আসে ৪ দশমিক ৭ শতাংশে। এর প্রধান কারণ বিজেপির লাগাতার বৃদ্ধি। বিজেপি ২০১১ সালে পেয়েছিল ৪ শতাংশ ভোট। ২০১৬ সালে তা হয় ১০ দশমিক ১৬ শতাংশ। এ বছরের বিধানসভা নির্বাচনে এই হার রাতারাতি বেড়ে হয়ে যায় ৩৮ দশমিক ১৩।
উপনির্বাচনে বিজেপি একেবারে ধরাশায়ী হয়ে গেছে। তাদের ভোট ৩৮ দশমিক ১৩ থেকে কমে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ হয়ে গেছে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লাভ করতে শুরু করেছে সিপিআইএম। অর্থাৎ বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়ায় সিপিআইএমের ভোট যেমন কমেছিল, তেমনই হিন্দুত্ববাদী দলের জনপ্রিয়তা কিছুটা কমায় ভোট বাড়তে শুরু করেছে বামপন্থীদের।
এখন এটা পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, বিজেপির ভোট বাড়লে বামপন্থীদের কমে, আর বামপন্থীদের বাড়লে বিজেপির কমে। বাম ও দক্ষিণপন্থীদের এই ভোট ‘ট্রান্সফারে’ তৃণমূলের বিশেষ লাভ বা লোকসান হচ্ছে না, কারণ তাদের ভোট মোটামুটি প্রায় একই থাকছে। অল্প অল্প করে বাড়ছে।
এবারের উপনির্বাচনে বিজেপি একেবারে ধরাশায়ী হয়ে গেছে। তাদের ভোট ৩৮ দশমিক ১৩ থেকে কমে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ হয়ে গেছে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লাভ করতে শুরু করেছে সিপিআইএম। অর্থাৎ বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়ায় সিপিআইএমের ভোট যেমন কমেছিল, তেমনই হিন্দুত্ববাদী দলের জনপ্রিয়তা কিছুটা কমায় ভোট বাড়তে শুরু করেছে বামপন্থীদের। সিপিআইএমের রাজ্য নেতৃত্ব বিষয়টা কতটা আত্মস্থ করতে পেরেছে বলা মুশকিল। তারা এখনো প্রধানত আক্রমণ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এবং তারপর বিজেপিকে। ভুলে যায়, তারা এখন রাজ্যে তিন নম্বরে চলে গেছে, তৃণমূল ও বিজেপির পরে। তাদের এখন প্রথমে তিন থেকে দুই নম্বরে আসতে হবে এবং তারপর লড়তে হবে এক নম্বরে থাকা তৃণমূলের সঙ্গে।
বস্তুত সম্প্রতি সিপিআইএমের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি তাদের দলীয় নথিতে এ কথা স্বীকারও করেছে। অভ্যন্তরীণ নোটে রাজ্য কমিটি বলেছে, ‘বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস বিষয়ে পার্টির অবস্থান নিয়ে, কিছু স্লোগান নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। পার্টির কর্মসূচিগত বোঝাপড়া হলো বিজেপি আর কোনো রাজনৈতিক দল এক নয়, কারণ বিজেপিকে পরিচালনা করে ফ্যাসিবাদী আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ)। এটাই পার্টির বোঝাপড়া, কিন্তু নির্বাচনের সময় কোথাও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, বিজেপি আর তৃণমূল সমান। “বিজেমূল” (বিজেপি + তৃণমূল) জাতীয় স্লোগান বা বক্তৃতায় ব্যবহার করা বিজেপি-তৃণমূল মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠের মতো কথা কিছু বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে, আমাদের পার্টির কর্মসূচিগত বোঝাপড়াতেই পরিষ্কার, বিজেপি আর তৃণমূল কখনোই সমান নয়।’
বিষয়টি মাথায় রেখে এগোতে পারলে না চাইলেও পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএমের ভোট কিছুটা বাড়বে বলে আশা করা যায়। ১৯ ডিসেম্বর কলকাতায় পৌরসভা নির্বাচন। এরপর ২০২২ সালে রাজ্যে শতাধিক পৌরসভায় নির্বাচন। এসব নির্বাচন প্রমাণ করতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম আবার একটি শক্তি হিসেবে সামনে আসছে।
এর প্রধান কারণ গোড়াতেই বলা হয়েছে। অনেক সময় একটি রাজনৈতিক দল না বুঝেই নির্বাচনে ভালো ফল করে ফেলে। এ সম্ভাবনা এখন প্রবল, কারণ প্রধান বিরোধী দল বিজেপির ধারাবাহিকভাবে শক্তিক্ষয় হচ্ছে। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে দল ধরে রাখতে পারছে না। তাদের একের পর এক নেতা তৃণমূল কংগ্রেসে যাচ্ছেন, অনেকে যেতে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে তদবির শুরু করেছেন এবং বারবার প্রচারমাধ্যমে এসে বলছেন, বিজেপিতে থাকা যায় না। দলের জ্যেষ্ঠ নেতৃত্ব বলছে, রাজ্যে বিজেপির নেতৃত্ব নির্বাচনের টাকা নয়ছয় করেছে, নারীদের নিয়ে সময় কাটিয়েছে এবং পুরোনো নেতাদের মনোনয়ন না দিয়ে অভিনেত্রীদের দিয়েছে। এমনকি আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মনে করা হচ্ছে, নির্বাচনে বিজেপির ভোট ২০১৬ সালের হার, অর্থাৎ ১০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। অর্থাৎ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট রাজ্যের পৌরসভা নির্বাচনে খোয়াবে বিজেপি।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এটাই—এই ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট কোথায় যাবে? অনেকেই মনে করছেন, যেহেতু এটা মূলত তৃণমূলবিরোধী ভোট, তাই মূলত যাবে সিপিআইএমসহ বামফ্রন্টে। কিছুটা হয়তো বাড়বে কংগ্রেসের ভোটও। তবে বিরোধীদের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিজেপি। বিজেপির পক্ষের যুক্তিটা হচ্ছে, এখন তারা ভোট হারালেও ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিসহ গোটা বিজেপি যখন তেড়েফুঁড়ে মাঠে নামবে, তখন আবার রাজ্যজুড়ে ভোট বাড়বে বিজেপির।
বর্তমানে ভারতজুড়ে বিজেপির মনোবল নিম্নগামী। কিন্তু অবস্থাটা চিরকাল এমনটা থাকবে না। আর কয়েক মাসের মধ্যেই উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে জয় পেলেই তাদের মনোবল রাতারাতি বেড়ে যাবে, এর প্রভাবও পড়বে বিভিন্ন রাজ্যে। ফলে সিপিআইএম আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে কিছুটা লাভবান হলেও তা ধরে রাখতে পারবে কি না, সেটা বলা মুশকিল।
কিন্তু সেটা তো পরের কথা, কিছুটা দূরের ভবিষ্যতের কথা। আপাতত অযাচিতভাবেই একটা সুযোগ সিপিআইএমসহ বামফ্রন্ট নেতৃত্বের সামনে এক দশক পরে এসে গেছে। এ সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পারে, সেটাই দেখার।
শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা