বছর চারেক আগের কথা। তিন দিন বাদেই রোজার ঈদ। বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে যে যেভাবে পারছেন, ঈদযাত্রায় শামিল হচ্ছেন। মুখে মুখে কেবল ‘বাড়ি যাবেন কবে’। আমাদের এক সহকর্মী, যাবেন রংপুর শহরে তাঁর বাড়িতে। রাত ১১টায় গাবতলী থেকে বাস ছাড়ল। রাস্তায় জ্যাম, এ খবর তাঁর জানা। তবু খুব বেশি আমলে নিতে চাননি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে উঠেই চাদর মুড়িয়ে, গুটিসুটি মেরে বেশ আচ্ছা করে একটা ঘুম দিলেন। ধারণা ছিল, ভোরে ঘুম ভাঙা চোখে দেখবেন যমুনা সেতু পার হচ্ছেন। ঠিক সুবহে সাদিকের লগ্নেই তাঁর ঘুম ভাঙে। আশপাশের একজন, দুজন যাত্রী বিরক্ত মুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে! তাঁরা বলতে চান, এই বৈরী পরিস্থিতিতে কীভাবে পারে লোকটা ঘুমিয়ে থাকতে! আমাদের সহকর্মী জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে চোখ রাখলেন। না, আশপাশে কোথাও যমুনা নদীর চিহ্ন নেই। সামনে, পেছনে কেবল গাড়ির সারি। চোখ কচলে ঝাপসা দৃষ্টিতে তিনি দেখেন, একটি মিষ্টির দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা ‘সাভার বাসস্ট্যান্ড!’
ঈদযাত্রার সময় এ আর কোনো নতুন গল্প নয়। আমাদের সহকর্মী তো একটি ‘আরাম বাসে’ উঠে বসতে পেরেছিলেন। কিন্তু কজনের এমন সৌভাগ্য হয়! এ দেশের সাধারণ মানুষ অতি সাধারণ গল্প হয়ে, বাসের সিটে কিংবা সিট না পেলে টুলের ওপর বসে বাড়ি যান। ট্রেনের ছাদে উঠে, হাতল ধরে, পাদানিতে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে পাড়ি দেন মাইলের পর মাইল। ১০০ জনের লঞ্চে ২০০ জন, ৩০০ জনের ১ জন হয়ে ওঠেন। অল্প টাকা দিয়ে দারাপুত্রপরিবার নিয়ে লঞ্চের ডেকে বসে বরিশাল, বরগুনা, ভোলা যান। আবার অনেকেই আছেন, যাঁদের বাস, ট্রেন বা লঞ্চ কিছুই জোটে না। তাঁরা রাতের বেলা সবজির ট্রাকচালকের সঙ্গে চুক্তি করেন। চতুষ্পদ প্রাণীও যতটা কদর পায়, এই দুই পেয়ে প্রাণীরা তা–ও পান না।
রক্তে স্নান করে ঈদযাত্রার সড়কপথ। নৌপথে তলিয়ে যান মানুষ। ভেসে ওঠেন, আবার ওঠেন না। গণমাধ্যমের খবরে জায়গা করে নেওয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না।তবু বাড়ি যান মানুষ। যেতে হয়, কারণ, গ্রামে কেবল মা, বাবা, আত্মীয়পরিজন থাকেন না, থাকে কারও শৈশব, কারও কৈশোরের টক–মিষ্টি–ঝাল স্মৃতি। আর মানুষ বরাবরই স্মৃতির মুখোমুখি হতে চান। তাই বাড়ি যান, স্মৃতির কাছে যান। স্মৃতির ছবিগুলোকে একপাশে রেখে, পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখেন। চাওয়া–পাওয়ার হিসাব কষেন। বাড়ি না গিয়ে তাই উপায় থাকে না।
ঈদের সময় ‘দ্যাশে’ যাওয়ার অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। ঢাকা বা অন্যান্য শহর থেকে সঞ্চিত অর্থ নিয়ে মানুষ গ্রামে যান, তার পরিমাণ যা–ই হোক না কেন। গ্রামে গিয়ে উপজেলা সদরে কিংবা গঞ্জের বাজার থেকে সদাইপাতি কেনেন। এতে সেসব বাজারে ঈদের আগে ও পরে বেচাবিক্রি বেড়ে যায়। এভাবে শহরে উপার্জিত অর্থ গ্রামে খরচ হয়। গ্রামের রুগ্ণ অর্থনীতিতে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব তো পড়েই। অর্থনীতিবিদেরা এ বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।
আমাদের বিত্তবানদের মধ্যে অনেকেই আছেন শহর থেকে জাকাতের শাড়ি, লুঙ্গি কিনে গ্রামে গিয়ে দান করেন। এটা খুবই ভালো কাজ। তবে জাকাতের কাপড়ের একটি অংশ যদি গ্রামে গিয়ে সেখানকার বাজার থেকে কেনা হয়, তাহলে প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাও দুটো পয়সার মুখ দেখতে পারেন। এভাবে একটু একটু পদক্ষেপে শহর ও গ্রামের পর্বতসমান আয় বৈষম্য সামান্য হলেও কমতে পারে।
করোনার আগে ২০১৯ সালে পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সরকারকে বলে তাদের জন্য বিআরটিসি বাসের ব্যবস্থা করেছিল। যদিও সেই সেবা নিয়ে হযবরল কম হয়নি। কিন্তু এবার কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কেন নিজস্ব উদ্যোগে তাদের কর্মীদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে না, সেটাই প্রশ্ন। এমন ভাবনা নিশ্চয় বাড়াবাড়ি বা অন্যায্য নয়। একেবারে বাড়ি পৌঁছে দিতে না পারলেও গন্তব্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় না?
২.
কেমন হবে এবারের ঈদযাত্রা, এরই মধ্যে তার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে গণমাধ্যমগুলো। ঈদযাত্রায় শামিল হতে যাওয়া প্রতিটি মানুষেরই তথ্যগুলো জানা প্রয়োজন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য বলছে, ঈদের আগের ৪ দিনে ঢাকা ছাড়তে পারেন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। ওই ৪ দিনের প্রতিদিন গড়ে ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা থেকে গ্রামে যেতে পারেন। ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা প্রায় দুই কোটি ধরলে অর্ধেকের বেশি মানুষ ঈদের সময় ‘দ্যাশে’ যান। ঈদের সময় শহর খালি হয়ে যাওয়ার এমন দৃশ্য ঢাকার পরে আর দেখা যায় ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায়। সেখানেও নৌপথে লাখো মানুষ শহর ছাড়েন। নৌ-দুর্ঘটনাও ঘটে।
এআরআই বলছে, বাস, ট্রেন, লঞ্চ, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলে ঈদের সময় প্রতিদিন ১৭ থেকে ১৮ লাখ মানুষের ঢাকা ছাড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি ১২ থেকে ১৩ লাখ মানুষকে ঢাকা ছাড়তে হবে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্রেনের ছাদ ও লঞ্চের অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে। এই মানুষেরা কারা? যাঁদের অর্থবল নেই তাঁরাই। ওই প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, গত ঈদে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এবার করোনা–পরবর্তী স্বাভাবিক অবস্থায় দ্বিগুণ মানুষের গ্রামে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় এবং সড়ক ও যানবাহনের সেই সক্ষমতা না থাকায় দুর্ঘটনা আরও বেশি হতে পারে। তাহলে দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে কারা বেশি, তা আর বলার প্রয়োজন হয় না।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের তথ্যমতে, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট—তিন মহাসড়কেই তীব্র দুর্ভোগের ঝুঁকি চোখ রাঙাচ্ছে। কোথাও মহাসড়ক সংকুচিত, কোথাও চলছে সংস্কারকাজ। কোথাও খানাখন্দের বাড়বাড়ন্ত। কোথাও মহাসড়ক দখল করে গড়ে উঠেছে যানবাহনের স্ট্যান্ড ও অবৈধ পার্কিং। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, যাত্রীদের কষ্ট লাঘবে তারা সম্ভব সবকিছুই করছে। যেখানে সড়ক সংস্কার দরকার, সেখানে তা করছে। গাড়ি পারাপারে অনেক স্থানে উন্নয়নকাজ সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হচ্ছে। তাদের বিশ্বাস, এবারের ঈদযাত্রা আনন্দদায়ক হবে।
এবারের ঈদ হচ্ছে বৈশাখের তীব্র গরমে। গরমের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে পড়ে থাকলে কীভাবে মানুষের ভ্রমণ আনন্দদায়ক হবে, বোধগম্য নয়।
নৌপথে চোখ রাখা যাক। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়াসহ বিভিন্ন ফেরিঘাটে যানবাহন চলাচল প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়লেও ফেরির সংখ্যা কমেছে। ফলে এই ঈদে এখানে শত শত যানবাহন উভয় পাড়ে আটকা পড়তে পারে। পাশাপাশি ঈদে কালবৈশাখীর আশঙ্কা থাকায় নৌপথ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দক্ষিণবঙ্গের যাত্রীরা এবার দূর থেকে পদ্মা সেতু দেখেই তৃপ্ত থাকবেন। অনেকটা ঘ্রাণে অর্ধভোজনের মতো! সামনে কোরবানির ঈদ কিংবা আগামী রোজার ঈদে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে পারাপারের ইচ্ছাপূরণ হবে তাঁদের।
৩.
বাংলাদেশে পোশাকশ্রমিকদের সংখ্যা ৪০ লাখের মতো। তাঁরা ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পরিশ্রম করেন, সেই তুলনায় মজুরি কম। প্রতি ঈদের আগেই বেতন–ভাতার জন্য কিছু কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলন করতে হয়। প্রতিবছর অনেক কষ্ট করে, আগেই উল্লেখ করেছি, বাসের টুলে বসে, ট্রেনের হাতল ধরে, ছাদে বসে, লঞ্চের ডেকে বসে তাঁরা গ্রামের বাড়ি যান। গ্রামে তাঁদের জন্য স্বজনেরা অপেক্ষা করে থাকেন।কিন্তু পোশাকশ্রমিকদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য অদ্যাবধি কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। তাঁদের জন্য বিশেষ বাস, ট্রেন, কোনো কিছুর বন্দোবস্ত নেই।
করোনার আগে ২০১৯ সালে পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সরকারকে বলে তাদের জন্য বিআরটিসি বাসের ব্যবস্থা করেছিল। যদিও সেই সেবা নিয়ে হযবরল কম হয়নি। কিন্তু এবার কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কেন নিজস্ব উদ্যোগে তাদের কর্মীদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে না, সেটাই প্রশ্ন। এমন ভাবনা নিশ্চয় বাড়াবাড়ি বা অন্যায্য নয়। একেবারে বাড়ি পৌঁছে দিতে না পারলেও গন্তব্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় না?
আমাদের পোশাকমালিকদের অনেকেই ঈদের অবকাশ কাটান দেশের বাইরের কোনো রিসোর্টে বা তারকা হোটেলে। তা তাঁরা করতেই পারেন। এতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু নিজের কর্মীদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থার কথা কেন তারা ভাবতে পারেন না? ব্যবসায়ীদের বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর মতো এত বড় বড় সংগঠন থাকতে এমন উদ্যোগ কেন তারা নিতে পারে না? এত বড় বড় ব্যবসায়ী নেতাকে আমরা দেখি, বিষয়টি কেন তাঁদের নজরে পড়ে না? নাকি, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা ভাবতে চান না বা ইচ্ছুক নন। তাঁরা যতই এড়িয়ে যেতে চান তবে জেনে রাখুন, আমরা আবার এ দাবি তুলব। বারবার তুলব, তুলতেই থাকব।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]