শেখ সাহেবকে এর পরে দেখি ১৯৫৭ সালেই। তিনি তখন পূর্ব বাংলার শিল্প, শ্রম ও দুর্নীতি দমন বিভাগের মন্ত্রী। সে সময়ে আওয়ামী লীগ অফিস ছিল সদরঘাটে—রূপমহল সিনেমা হলের বিপরীত দিকে একটু ভেতরে একটা পুরোনো বিশাল দোতলা হলুদ বাড়িতে। রাস্তাটার নাম ছিল সিমসন রোড। অফিসে তখন লোকজন গমগম করত। মন্ত্রী ও নেতারা আসতেন। আমরাও মাঝেমধ্যে যেতাম কৌতূহল আর ঔৎসুক্য নিয়ে।

মন্ত্রী হওয়ার পর শেখ সাহেব যেদিন প্রথম অফিসে আসেন, সেদিন আমি সদরঘাটের লাগোয়া বইয়ের দোকান মল্লিক ব্রাদার্সের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শেখ সাহেব মন্ত্রীর গাড়িতে এসে ওইখানেই নামেন। ওখান থেকে বুড়িগঙ্গার নদীর পাড় পর্যন্ত টানা রাস্তায় হকারদের দোকানপাট ছিল। শেখ সাহেব আসায় বেশ একটা ভিড় জমে। তিনি গাড়ি থেকে নামলেন এবং হেঁটে এগোতে থাকলেন। পুলিশ দৌড়াদৌড়ি করে তাঁর জন্য নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করছিল। তিনি হাত উঁচু করে বললেন, গরিব হকারদের রাস্তা থেকে তুলো না। তোমরা সরো, আমার নিরাপত্তার দরকার হয় না। তিনি হেঁটে অফিসের দিকে চললেন,¾সঙ্গে অনেক লোক তাঁর সঙ্গে গেল। সেদিন তিনি ধবধবে সাদা শেরওয়ানি পরেছিলেন। দীর্ঘকায়, ছিপছিপে সুন্দর মানুষটিকে বড় আকর্ষণীয় দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, নেতা এমন না হলে মানায় না।

১৯৬২ সালে শেখ সাহেবকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখার ও কাছে পাওয়ার সুযোগ ঘটে। আমি তখন কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার প্রধান সংগঠক। আমরা ওই বছরে কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার উদ্যোগে ও দাদা ভাইয়ের নেতৃত্বে ঢাকায় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে এক শিশু-কিশোর আনন্দমেলার আয়োজন করি। সেই মেলায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি আগ্রহসহকারে আসেন এবং মেলার প্রদর্শনী ও স্টল পরিদর্শন করেন।

আনন্দমেলার নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয় দেখাশোনার জন্য কচি-কাঁচার মেলার সদস্যদেরই নিয়োগ করা হয়। পুলিশ বা শান্তি বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী—সবই ছিল কচি-কাঁচার মেলার শিশুরা। শেখ সাহেব যখন প্রদর্শনী দেখছিলেন, তখন সেখানকার শিশু গোয়েন্দারা তাঁকে সন্দেহ করে। শেখ সাহেবের পিছু নিয়ে সে আনন্দমেলায় ঢুকেছে। শেখ সাহেব সরকারি গোয়েন্দাকে বললেন, ‘চান্দু, এখানেও আমার পিছু নিয়েছ? শিশুদের সঙ্গে একটু আনন্দ করব, তাতেও ফেউ লাগিয়ে রেখেছে সরকার। যা, মাফ করে দিলাম।’ পরে দাদাভাইয়ের দিকে ঘুরে বললেন, দাদাভাই, আপনার গোয়েন্দারা সরকারি গোয়েন্দাদের ওপর টেক্কা দিয়েছে, শাবাশ! লুলু অর্থাৎ এখনকার মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা সুলতানা কামাল ছিলেন সেই খুদে গোয়েন্দাদের প্রধান।

১৯৬৪ সালে ঢাকায় দাঙ্গা হয়। শেখ সাহেব দাঙ্গা প্রতিরোধ ও দুর্গতদের সাহায্যের জন্য একটা অফিস খোলেন তোপখানা রোডে, বর্তমান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে। তিনি একটি জিপগাড়ি নিয়ে জগন্নাথ কলেজ ও অন্য দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে ত্রাণ দিতেন এবং বিপন্ন মানুষদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসতেন। অধ্যাপক অজিত গুহ স্যার এবং রামেন্দু মজুমদারদের পরিবারকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসেন। সাংবাদিক ও জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রকে দাঙ্গাবিরোধী ভূমিকায় সক্রিয় করেন। আমি তখন তাঁর কর্মী দলে কাজ করেছি, দেখেছি তাঁর মানবিক চৈতন্য ও অসাম্প্রদায়িক দর্শনের অনন্য রূপ।

এর পরের ঘটনা ১৯৬৭ সালের। ছয় দফার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। শেখ সাহেবের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। আমি তখন জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করি। একদিন অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান সাহেব ডেকে বললেন, শামসুজ্জামান, তুমি আর রাহাত খান (তিনিও তখন ওখানে অধ্যাপক) আজ সন্ধ্যায় আমার একটা বিশেষ ডিউটি করবে। একজন বিশিষ্ট অতিথিকে নিয়ে আমরা আজ কলেজের ‘অবকাশ’ রেস্তোরাঁয় ডিনার খাব। আমি আর অজিত বাবু (অধ্যাপক অজিত গুহ) থাকব। আরও দু-একজন থাকবেন। অতিথির নাম বলব না,¾বুঝে নিতে চেষ্টা করো। কাউকে বলার দরকার নেই। শুধু পূর্ব দিকের গেটে পাহারা দেবে। অপরিচিত কাউকে ঢুকতে দিবা না। রাত আটটায় তিনি আসবেন। তখন তোমরাও সামনে থাকবা না। একটু পরে আসবে। ছুটির দিন আছে, অন্য কেউ থাকবে না।

পরে জানতে পারি, ওই রাতে শেখ সাহেবই ছিলেন বিশেষ অতিথি। তাঁকে তাঁর ফক্সওয়াগন গাড়িতে করে নিয়ে এসেছিলেন জনাব এম ইউ আহমদ নামে খুলনার এক ব্যবসায়ী। ওখানে ছয় দফা এবং রবীন্দ্রসংগীত পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ করার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কিছুদিন পরে অধ্যক্ষ সাহেব কলেজে এক বড় আকারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বলেন। এবং এ–ও বলেন, জাহেদুর রহিম, অজিত রায়কেও ওই অনুষ্ঠানে ডাকতে হবে। তবে তাঁরা যে আসবেন, এ তথ্য গোপন থাকবে। সেই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন প্রয়াত শিল্পী সুখেন্দু চক্রবর্তী। তিনি ‘ডিম পাড়ে হাঁসে/ খায় বাগডাশে...’ গানটি গান। আবদুল লতিফ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমীন, ফ্লোরা আহমেদ ওই অনুষ্ঠানে গান করেন। হঠাৎ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত শুরু হয়ে যায়। এতে গান করেন জাহেদুর রহিম, অজিত রায়, মোরাদ আলী, ফ্লোরা আহমেদ প্রমুখ। প্রায় ১০ হাজার লোকের সেই জমাট অনুষ্ঠানে পাকিস্তান সরকারের ১৯৬৭ সালের রবীন্দ্রসংগীতের নিষেধাজ্ঞা প্রথম ভঙ্গ করে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করা হয়। এভাবে জগন্নাথ কলেজ থেকেই বাঁধ ভেঙে দেওয়া হয়। পরে শুনেছি, শেখ সাহেবের ওই দিন কলেজের অবকাশ ক্যানটিনে আসার উদ্দেশ্যই ছিল রবীন্দ্রসংগীতের বিধিনিষেধের দেয়াল ভেঙে দেওয়া। তাঁর নির্দেশেই ওই বিশাল অনুষ্ঠান।

এর জন্য অবশ্য পরে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান, অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ এবং আমাদের মূল্য দিতে হয়েছে। অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানকে মোনায়েম খাঁ বদলি করেন। অজিত বাবুকে কলেজ ছাড়তে হয়। আমি চলে যাই ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং রাহাত খান ইত্তেফাকে যোগ দেন।

শামসুজ্জামান খান বাংলা একাডেমির সভাপতি।