বজ্রপাত কি বাড়ছে?

.
.

বজ্রপাত অত্যন্ত শক্তিশালী একটি বায়ুমণ্ডলীয় দুর্যোগ, যা সাধারণত বায়ুমণ্ডলের তাপীয় পরিচালনের নির্দেশক। বায়ুমণ্ডলীয় পরিচলন বা convection এমন একটি প্রপঞ্চ, যা সাধারণত দুটি কারণে হয়—বায়ুমণ্ডলে ভিন্ন ঘনত্বের বায়ুভর সংমিশ্রণের ফলে; অথবা দিবাভাগে সৌরতাপের কারণে সীমানা স্তর অত্যধিক উত্তপ্ত হয়ে ওঠার কারণে। ফলে একধরনের বায়ুমণ্ডলীয় অস্থিরতা থেকে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। প্রতিবছর সারা বিশ্বে বজ্রপাতের কারণে গড়ে ২৪ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে এবং আহত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত উন্নত বিশ্বে (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া) বজ্রপাত ছিল একটি ভয়াবহ দুর্যোগ, কিন্তু বিংশ শতাব্দী থেকে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে মূলত নগর জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং কৃষিজ জনসংখ্যার হ্রাসের কারণে (Holle, ২০১৬)।
বিশ্বে মোট বজ্রপাতের ৭৮ শতাংশ সংঘটিত হয় ক্রান্তীয় অঞ্চলে। দক্ষিণ এশিয়া, তথা বাংলাদেশ যেহেতু ক্রান্তীয় অঞ্চলের খুব কাছাকাছি অবস্থিত, প্রাক্‌-মৌসুম (মার্চ-জুন) থেকে শুরু করে মৌসুমি (জুলাই-অক্টোবর) সময় পর্যন্ত বজ্রপাতসহ বজ্রঝড় একটা নিয়মিত প্রপঞ্চ। যদিও প্রতিবছর বজ্রঝড়, কালবৈশাখী, টর্নেডোতে প্রাণহানিসহ ফসলাদির ক্ষতি কিছু না কিছু হয়েই থাকে, বজ্রপাতে নিহত বা আহত ব্যক্তিদের কোনো পরিসংখ্যান বা ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ এখন পর্যন্ত কোথাও নিয়মানুগ বিধৃত নেই। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরেও এ–সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। অথচ ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের বেশ কিছু গবেষণামূলক কাজ রয়েছে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার বজ্রপাত সম্পর্কে। ওই প্রবন্ধগুলোতে দেখা যায়, বাংলাদেশের কিছু অংশ বিশেষ করে সিলেট, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের বেশ কিছু জেলায় বজ্রপাতের কার্যকলাপ খুব বেশি (Tinmaker et al. 2013)। বজ্রপাত সম্পর্কে বাংলাদেশের গবেষকদের বেশি একাগ্রতা লক্ষ করা যায় ২০১৬ থেকে, মধ্য মে-তে ২৬ জেলায় ৮১ জন মারা যাওয়ার পর সরকার যখন বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে ঘোষণা করে। যেহেতু বজ্রপাত একটা স্থানীয় (localised) প্রপঞ্চ, ভারতীয় প্রবন্ধগুলোতে বাংলাদেশে বজ্রপাতের স্থানিক-কালিক পরিসংখ্যান খুব বেশি একটা পরিষ্কার তথ্য দেয় না, এই লেখায় তাই সারা দেশের বজ্রপাতের ঐকাহিক, ঋতুগত ও বার্ষিক তারতম্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা দরকার, এই লেখায় Lightning Imaging Sensor-র (LIS) ১৬ বছরের বজ্রপাত–সম্পর্কিত উপাত্ত ব্যবহৃত হয়েছে এবং এই রিমোট সেন্সর তিন ধরনের—আন্তক্লাউড, ক্লাউড-টু-ক্লাউড ও ক্লাউড-টু-গ্রাউন্ড—বজ্রপাত রেকর্ড করে থাকে। ছয় হাজারেরও বেশি LIS অরবিট ফাইল ব্যবহার করে সারা দেশের মোট তথ্যপ্রক্রিয়া করা হয়েছে। বজ্রপাতেরর উপাত্ত মূলত দুটি উপায়ে উপস্থাপন করা হয়—১. মোট বজ্র ফ্ল্যাশ বা ২. বজ্র ঘনত্ব/বর্গ কি.মি. (FRD)। যা হোক, এই লেখাটি ১৬ বছরের মোট বজ্র ফ্ল্যাশের ওপর ভিত্তি করে করা। 

বজ্রপাতের ঐকাহিক ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় যে ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের এলাকায় মোট ৮৩ হাজার ৬৪১টি বজ্র ফ্ল্যাশ (বঙ্গোপসাগরে ১২ হাজার ১০৬টি আর ভূমিতে ৭১ হাজার ৫৩৫টি) হয়েছে, যার মধ্যে ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ হয়েছে স্থানীয় সময় রাত ১২টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যে, সকাল ৮টা থেকে বেলা ৩টার মধ্যে হয়েছে ৪০ দশমিক শূন্য ৬ এবং বিকেল ৪টা থেকে রাত ১১টার মধ্যে সংঘটিত হয়েছে মোট ৪১ দশমিক ১৪ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় বেলা ১টায় (৬ দশমিক ৯২ শতাংশ) আর সবচেয়ে কম হয় রাত ১২টায় (শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশ), যদিও সারা দিনের যেকোনো সময়ই বজ্রপাত হতে পারে। ১৬ বছরের মাসিক ফলাফলে দেখা যায়, সর্বোচ্চ ৩২ দশমিক ৮৪ শতাংশ বজ্রপাত হয়ে থাকে মে মাসে, যা কিনা প্রাক্‌-মৌসুম সময় বলে পরিচিত। এরপর রয়েছে এপ্রিলের অবস্থান (২৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ)। অন্যদিকে, ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ বজ্রপাত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর সময়ে হয়ে থাকে, আর বাকি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ সংঘটিত হয় বছরের অন্যান্য মাসে। গত ১৬ বছরে একমাত্র ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে মাত্র ৮টি বজ্রপাত সংঘটিত হয় আর জানুয়ারিতে হয়েছিল মোট ৯৬টি (শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ)।
ঋতুগত তারতম্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৫৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ বজ্রপাত সংঘটিত হয় প্রাক্‌-মৌসুমে (মার্চ-মে), ১২ দশমিক ৪১ শতাংশ মৌসুমি ঋতুতে (জুন-সেপ্টেম্বর), ১২ দশমিক ৮৮ শতাংশ পোস্ট-মৌসুমি সময়ে (অক্টোবর-নভেম্বর) এবং ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ হয় শীতকালে (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি)। প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজার ২৭৭টি বজ্র ফ্ল্যাশ সারা দেশে হয়, তবে এর সবই যে প্রাণঘাতী, তা নয়। এই গবেষণায় একটা বিষয় উঠে এসেছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আর তা হচ্ছে বাংলাদেশে বজ্রপাত সংঘটনের আন্তবার্ষিক তারতম্য বা ট্রেন্ড খুব একটা নেই। অর্থাৎ, ১৯৯৮-২০১৪ পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতের প্রবণতা এমন নয় যে আমরা বলতে পারি সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং, সাম্প্রতিক বজ্রপাতজনিত প্রাণহানির ঘটনার অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে, এর মধ্যে অতিরিক্ত জনসংখ্যার ঘনত্ব, ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন, গ্রামীণ জনসংখ্যার আধিক্য, নিম্ন শিক্ষার হার সম্ভবত অন্যতম।
বিভাগভিত্তিক ভৌগোলিক বিস্তার দেখা যায়, দেশের ৬৪ জেলাতেই বজ্রপাতের কার্যকলাপ বিদ্যমান (টেবিল–১)। ১৯৯৮-২০১৬ পর্যন্ত সারা দেশের মোট বজ্রপাতের ১৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগে, ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ সিলেট, ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ রংপুর, ১৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ ঢাকা, ১১ দশমিক ১১ শতাংশ রাজশাহী, খুলনা ১০ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ সংঘটিত হয়। সবচেয়ে কম হয়েছে বরিশাল বিভাগে (৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ)। মজার ব্যাপার হচ্ছে, একমাত্র সিলেট বিভাগের সব জেলাতেই বজ্রপাত হয়ে থাকে। ফলে প্রাণহানির সংখ্যাও এই বিভাগে বেশি অন্যান্য বিভাগের তুলনায় বেশি। বাংলাদেশের শীর্ষ পাঁচটি বজ্রপাত আক্রান্ত জেলা হচ্ছে সুনামগঞ্জ (গত ১৬ বছরে মোট বজ্রপাতের ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ), সিলেট (৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ), রাঙামাটি (৩ দশমিক ৬০ শতাংশ), নেত্রকোনা (৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ) এবং দিনাজপুর (২ দশমিক ৬৬ শতাংশ)। আর সবচেয়ে কম আক্রান্ত পাঁচটি জেলা হচ্ছে বরগুনা (শূন্য দশমিক ৩১ শতাংশ), মেহেরপুর (শূন্য ৩২ শতাংশ), ঝালকাঠি (শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ), জয়পুরহাট (শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ) ও চুয়াডাঙ্গা (শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ)।
বাংলাদেশে বজ্রপাতের কারণগুলোর মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে প্রথম ও প্রধান কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি; যদিও অনেক জলবায়ুবিজ্ঞানী এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। বজ্রপাতের ঋতুগত তারতম্য থেকে দেখা যায় প্রাক্‌-মৌসুম সময়ে দেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। যেহেতু এ সময় সারা দেশের তাপমাত্রা অন্যান্য ঋতুর তুলনায় বেশি থাকে, সেহেতু ট্রপোস্ফিয়ারের তাপীয় গঠন তীব্র পরিচলনের সহায়ক বিধায় প্রাক্‌-মৌসুমি সময়টা বজ্রপাত সংঘটনের জন্য খুবই উপযোগী। এর সঙ্গে যোগ হয় বাতাসের ধারাবাহিকহীনতা অথবা কেন্দ্রীয় ভারত থেকে দক্ষিণ উপদ্বীপ পর্যন্ত trough-এর সম্প্রসারণ। আর উপরিউক্ত কারণে প্রাক্‌-মৌসুমে, বিশেষ করে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে বজ্রপাত সবচেয়ে বেশি হয়। এর সঙ্গে বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি সম্ভবত একটা সহায়ক গুণকের ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে, মৌসুমি ঋতুতে ভূমির উচ্চতা, orographic lifting, উচ্চ convective available potential energy (CAPE) নিয়ামকসমূহ রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, পঞ্চগড়, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, রাজবাড়ী, সাতক্ষীরা, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বজ্রপাত সংঘটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তা ছাড়া এই ঋতুতে বায়ুমণ্ডলীয় পরিচলন দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে স্থানান্তর করে the Madden Julian দোলনের প্রভাবে, ফলে মধ্য বাংলাদেশে বজ্রপাত বেশি হয়। পোস্ট-মৌসুমি সময়ে আন্তক্রান্তীয় অভিসৃতি জোনের (ITCZ) পশ্চাদপসরণ এবং বৃহদায়তন প্রচলন (large scale circulation) সংশ্লিষ্ট বায়ুমণ্ডলীয় পরিচলনের কারণে পার্বত্য জেলায়, বিশেষ করে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে বেশি বজ্রপাত হয়ে থাকে। শীতকালে পশ্চিমা গোলযোগের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর থেকে তাজা আর্দ্রতার সরবরাহ এবং স্থানীয় বায়ুমণ্ডলীয় পরিচলনের প্রভাবে বাগেরহাট, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, সিলেট, খুলনা, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ জেলায় বজ্রপাত হয়। তবে অন্যান্য ঋতুর তুলনায় এর প্রকোপ কম। আবার সৌরতাপের তীব্রতা শীতকালে কম থাকায় বায়ুমণ্ডলীয় অস্থিরতা হ্রাস পায় বলে বজ্রপাতের সংখ্যাও অনেক কম।

সুতরাং, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে আবহাওয়াজনিত দুর্যোগ বৃদ্ধির যে পূর্বাভাস জলবায়ুবিজ্ঞানীরা দিয়েছেন, তার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ সংঘটনের ভৌগোলিক বিস্তার ও পরিবর্তন হতে পারে।

ড. আশরাফ দেওয়ান: সাবেক অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ই-মেইল: [email protected]
তথ্যসূত্র
Tinmaker, M. R. and Chate, D.M., 2013. Lightning activity over India: a study of east-west contrast, International Journal of Remote Sensing, 34(16), 5641-5650.
Holle, R. L., 2016. The number of documented global lightning fatalities, 24th International Lightning Detection Conference, 18-21 April, San Diego, USA.