আজ ৭ ফ্রেব্রুয়ারি, বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে ‘বাংলা ইশারা ভাষা দিবস’। বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলে ইংরেজি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের বাংলা পরিভাষা হিসেবে ‘সংকেত ভাষা’-কে গ্রহণ করা হয়েছে। সেদিক থেকে আজকের দিনটি ‘বাংলা সংকেত ভাষা দিবস’ নামেও পরিচিত। আমাদের সমাজে যে সকল মানুষের বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হলো এই সংকেত ভাষা।
মানব সভ্যতার শুরুতে মানুষ বিভিন্ন সংকেত বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যোগাযোগের সূচনা করে। আনুমানিক পঞ্চাশ থেকে দেড় লাখ বছর আগে মানুষ মৌখিক ভাষার ব্যবহার শেখে আর লিখিত ভাষার বয়স আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার বছর। যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ভাষার আবির্ভাব এই হিসাবে বেশ নবীন। তারপরও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মানব মস্তিষ্ক উন্নত হয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে ভাষার প্রকাশ মাধ্যম, যোগাযোগ পেয়েছে তার অন্যতম মাধ্যম। আর বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নে সেই যোগাযোগ হয়েছে আরও সহজতর। যোগাযোগের উৎকর্ষসাধন হয়েছে ঠিকই কিন্তু আমাদের মধ্যে কিছু কিছু মানুষ রয়ে গেছেন যারা শ্রবণ ও বাক্ সীমাবদ্ধতা নিয়ে জন্মেছেন। তারা আমাদের মতো বাচনিক ভাষায় তাদের মনের ভাব প্রকাশ করেন না। তবে তারা ভাষাহীনও নন। তাদেরও আমাদের আমাদের মতো ভাষা রয়েছে। তারা আমাদের মতো বাচনিক ভাষায় তাদের মনের ভাব প্রকাশ না করে বরং সংকেত ভাষায় যোগাযোগ করে থাকে।
সারা বিশ্বে সংকেত ভাষা বহুল ব্যবহৃত একটি ভাষিক যোগাযোগ মাধ্যম। ন্যাশনাল সেনসাস অব দ্য ডিফ পপুলেশন- এনসিডিপির তথ্য মতে, ইংরেজি ছাড়া আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যে ১৩টি ভাষা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত তার মধ্যে স্প্যানিশ ও চীনা ভাষার পরই রয়েছে আমেরিকান সংকেত ভাষা। যেখানে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ এই ভাষায় পারস্পরিক ভাব বিনিময় করে থাকেন।
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ দ্য ডেফ-এর তথ্য মতে, সারা বিশ্বে প্রায় সাত কোটি বাক্ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী রয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশেই আছে প্রায় ৩০ লাখ। তবে দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত বাক্ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৯৭ জন। যার মধ্যে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯০৭ জন বাকপ্রতিবন্ধী ও ৪৭ হাজার ৪৯০ জন শ্রবণ প্রতিবন্ধী। এই বিশাল বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ১৯৯২ সালে ‘জাতীয় বধির সংস্থা’ ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের আলোকে এ দেশে সর্বপ্রথম বাংলা ইশারা ভাষা ও বিধান প্রণয়ন ও প্রকাশ করে।
২০০৯ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা ইশারা ভাষাকে অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দেন। এরপর থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন সংবাদে সংকেত ভাষা ব্যবহার করে আসছে। বাংলাদেশ সরকার কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব পারসনস উইথ ডিজ্যাবিলিটিস (সিপিআরডি)-এর আলোকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩- স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের সকল ইশারা ভাষার প্রচার ও প্রসারের বিষয়ে নির্দেশনা থাকলেও এখনো এই আইন অনুসারে সংকেত ভাষা নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষণীয় নয়।
সম্প্রতি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধী বিভাগ সরকারী ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপনের পদক্ষেপ নিয়েছে যা আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। আমরা যদি বাইরের দেশে দিকে তাকাই তাহলে দেখব অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, নরওয়ে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফিনল্যাল্ড ও সাউথ আফ্রিকা তাদের দেশে ইশারা ভাষা আইন, ইনস্টিটিউট ও দোভাষী সনদ প্রাপ্তিসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং দিয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ভাষার আইনি স্বীকৃতি। আর বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে উগান্ডা ১৯৯৫ সালে সংকেত ভাষাকে আইনি স্বীকৃতি দেয়। তাছাড়া ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায়ও সংকেত ভাষাকে একাডেমিক ও অফিশিয়াল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার প্রাদেশিক আইনে উল্লেখ আছে একাডেমিক ক্রেডিট কোনো কোর্সকে গ্রহণ করবে না যদি সেই প্রতিষ্ঠান ইশারা ভাষাকে স্বীকৃতি না দেয়। প্রতিবেশী দেশ ভারত ২০১১ সালে ইন্দিরা গান্ধী উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ভারতীয় ইশারা ভাষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। সেদিক থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল বিচারে বাংলাদেশের বাক্ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য আমরা উদ্যোগে দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছি।
আমাদের সকল উদ্যোগের শুরুটা করতে হবে ইশারা ভাষা প্রমিতকরণের মাধ্যমে। সেখানে শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব সঠিকভাবে প্রতিফলিতও হতে হবে। তবে একথাও সত্যি যে, বাংলা সংকেত ভাষার প্রমিতকরণের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল বাংলা সংকেত ভাষাকে একটি পূর্ণ ভাষার মতো লিপিবদ্ধকরণ ও ভাষিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এ কাজটি সময়সাপেক্ষ এবং এর জন্য বহুল গবেষণাও প্রয়োজন। ভাষা মাত্রই একটি সুনির্দিষ্ট শৃঙ্খলা মেনে চলে। তাই যেকোনো প্রাকৃতিক ভাষার মতো সংকেত ভাষাও সূত্রশাসিত। সংকেত ভাষার রয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক ব্যাকরণিক কাঠামা রয়েছে। তাই প্রকৃত অর্থে, বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতকরণে ভাষা বৈজ্ঞানিক ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে এর বৈশিষ্ট্য, গঠনরীতি ও ব্যাকরণ আবিষ্কার করা প্রয়োজন—যা এখনও করা হয়নি। ভাষা পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলা সংকেত ভাষা ব্যবহারবিধি উন্নয়ন, এ ভাষার বিভিন্ন উপাদান সংকলন ও মুদ্রণ এবং সর্বত্র এ ভাষার প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করাও আবশ্যক। যেহেতু ইশারাভাষীদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে এ ভাষার উদ্ভব, তাই এ বিষয়েও যথেষ্ট গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, বিশেষ শিক্ষা বিভাগ এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে জাতীয় বধির সংস্থা ছাড়াও দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলা সংকেত ভাষা নিয়ে কাজ করে আসছে- একটি ‘সেন্টার ফর ডিজএবিলি ইন ডেভেলপমেন্ট’ সংক্ষেপে ‘সিডিডি’ এবং অন্যটি ‘সোসাইটি অফ দ্য ডেফ অ্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজারস’ সংক্ষেপে ‘এসডিএসএল’। এই দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলা সংকেত ভাষা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। ‘সিডিডি’ ১৯৯৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৩৫০০ জন ব্যাক্তিকে বাংলা সংকেত ভাষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এ ছাড়া এই প্রতিষ্ঠান বাংলা ইশারা ভাষা সহায়িকা নামে ৬ খন্ডের একটি প্রকাশনা করেছে। পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ৫০০ সংকেত নিয়ে আরও একটি প্রকাশনা ও সফটওয়ার তৈরি করেছে। তবে এই ইশারা ভাষা সহায়িকাটি মূলত বাংলা সংকেত ভাষা সহায়িকা। মূলত এটি বাংলা সংকেত ভাষার শব্দভান্ডার হিসেবে গুরুত্ব রাখে। কিন্তু বাংলা সংকেত ভাষাকে একটি পরিপূর্ণ ভাষা হিসেবে ব্যাখ্যার জন্য যে ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক, বাক্যতাত্ত্বিক বিষয় প্রয়োজন তার অনুস্পস্থিতি রয়ে গেছে। একই বিষয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘এসডিএসএল’-এর ক্ষেত্রেও ঘটেছে। এছাড়া এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবহৃত সংকেত ভাষার মধ্যেও কিছু সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য রয়েছে।
বাংলাদেশ বধির সংস্থার প্রবর্তিত ইশারা ভাষা অভিধানেও এর ব্যতিক্রম আমরা দেখতে পাই না। অর্থাৎ বাংলাদেশে সর্বমহলে ব্যবহার ও বাংলাদেশের সকল বাক্ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাদানের জন্য একটি নির্দিষ্ট সংকেত ভাষার প্রচলন করা সম্ভব হয়নি। যার কারণে এদেশের বাক্ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাদান বহু বছর ধরে ব্যহত হচ্ছে। বিশেষত একটি নির্দিষ্ট ধাপের পর বাংলাদেশের বাক্ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুরা উচ্চ শিক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলা সংকেত ভাষার প্রমিতকরণ জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারি উদ্দ্যোগে একটি বাংলা সংকেত ভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন ও বাংলা সংকেত ভাষার প্রমিতকরণ এখন সময়ের দাবি।
তাওহিদা জাহান চেয়ারপারসন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়