অভিষেক বক্তৃতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেছেন, আমেরিকানরা মূল্যায়িত হবে কীভাবে তারা বর্তমান যুগের লাগাতার সংকটের সমাধান করেছে তার দ্বারা। তাঁর দেশ ‘সময়ের ডাকে সাড়া দেবে’ বলে আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছে এবং অঙ্গীকার করেছে যে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দেবে ‘আমাদের শক্তির উদাহরণ দিয়ে নয়, বরং উদাহরণের শক্তি দিয়ে’।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনৈক্যবাদী, বিচ্ছিন্নকারী বক্তব্যের এর থেকে ধারালো জবাব আর হয় না। কিন্তু আমেরিকার আপাতপতন ঠেকানোর চেয়ে ভিন্ন স্বরে কথা বলা অনেক সহজ। সেটা করতে হলে বাইডেনকে বিজ্ঞ, ভবিষ্যৎমুখী নেতৃত্ব জোগাতে হবে। আর তার অর্থ এই নয় যে ট্রাম্প যা যা করেছেন, তার সব ভেস্তে দিতে হবে।
আমেরিকাকে দুর্বলকারী রাজনৈতিক মেরুকরণের আন্তর্জাতিক অবস্থানকেও খাটো করেছে। দলীয় চিন্তাভাবনা দীর্ঘমেয়াদি পররাষ্ট্রনৈতিক লক্ষ্যের চেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়া নীতি তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে আছে। ঐক্যের জন্য বাইডেনের আকুতি থেকে এ বিষয়ে তাঁর সচেতনতা বোঝা যায়। কিন্তু সত্য হলো, মার্কিন সমাজের গভীর ভাঙন কোনো একক প্রেসিডেন্টের পক্ষে সারানো হয়তো অসম্ভব। তাই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে না ডুবে বাইডেনের উচিত সেসবের ঊর্ধ্বে ওঠা।
এবং এখনো এমন একটি ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে উভয় দলের মধ্যে সমঝোতা দেখা যায়: চীনের মোকাবিলা করার জরুরত। ট্রাম্প এটা বুঝেছিলেন। তাঁর চীন নীতি ছিল সবচেয়ে ধারাবাহিক এবং গঠনমূলক পররাষ্ট্রনৈতিক উত্তরাধিকার। বাইডেন যদি একই নীতি অনুসরণ না করেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বের বিলোপ অনিবার্য হয়ে উঠবে।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল এক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কেন্দ্র এবং ভূরাজনৈতিক সংঘাত বিন্দু। এই অঞ্চলই হলো কার্যকর চীন কৌশলের মূলে। বিশ্বব্যবস্থায় এই অঞ্চলের অসীম গুরুত্ব উপলব্ধি করে চীন একে তার স্বার্থ অনুযায়ী গড়ন দিচ্ছে। ব্যবহার করছে তীব্র অর্থনৈতিক চাপ, বলপ্রয়োগ, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদ, যাতে হিমালয় থেকে হংকং ও দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগর পর্যন্ত তার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য ধরে রাখার একমাত্র উপায় হলো গণতন্ত্রভিত্তিক ব্যবস্থা অথবা ট্রাম্প প্রশাসনের ভাষায় বললে, ‘মুক্ত ও খোলা ইন্দো-প্যাসিফিক’। গত এক বছরে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে উৎসাহিত হয়ে এ অঞ্চলের গণতন্ত্রগুলো তাদের কৌশলগত বন্ধন দৃঢ় করেছে এবং অনেক দূরের ইউরোপকেও অনুরূপ সমর্থনমূলক নীতি গ্রহণে প্রেরণা দিয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের নেতৃত্বের অধীনে, দেশগুলোর উচিত এই অগ্রগতির ওপর দাঁড়ানো, গণতান্ত্রিক দেশগুলোর এমন ঐকতান তৈরি করা, যা ইন্দো-প্যাসিফিকের ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় সমর্থ হবে।
দৃশ্যত মনে হয় বাইডেন এটা বোঝেন। চীনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক জোট গঠনে তাঁর আগ্রহ পরিষ্কার। কিন্তু তিনিও তাঁর চিন্তাভাবনা দমিয়ে রাখার ঝুঁকিতে।
প্রথমত, বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার আগে পর্যন্ত ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ কথাটা গ্রহণ করেননি। যখন করলেন তখন ‘মুক্ত ও খোলা’ কথাটার বদলে ব্যবহার করলেন ‘নিরাপদ ও সমৃদ্ধিশালী’। কিন্তু যেখানে ‘মুক্ত ও খোলা’ বলতে আপনা–আপনি বোঝায় আইনভিত্তিক, গণতন্ত্র পরিচালিত ব্যবস্থা, সেখানে ‘নিরাপদ ও সমৃদ্ধিশালী’ ধারণার মধ্যে স্বৈরাচারী শাসকদেরও অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে। ঘটনা আরও খারাপ হয়ে দাঁড়ায় যখন বাইডেন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নতুনভাবে গড়ার ইঙ্গিত দেন।
ট্রাম্পের চীন নীতি কেবল ব্যবসা আর মানবাধিকার নিয়ে ছিল না। তিনি সঠিকভাবেই এ বার্তা দিয়েছিলেন যে একটি আগ্রাসী কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে চীনের কোনো রাজনৈতিক বৈধতা অথবা আইনের শাসনের যোগ্যতা নেই।
ট্রাম্পের চীন নীতি কেবল ব্যবসা আর মানবাধিকার নিয়ে ছিল না। তিনি সঠিকভাবেই এ বার্তা দিয়েছিলেন যে একটি আগ্রাসী কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে চীনের কোনো রাজনৈতিক বৈধতা অথবা আইনের শাসনের যোগ্যতা নেই। যদি বাইডেন প্রশাসন চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তুলে নেয় এবং চীনকে কঠিন শত্রু হিসেবে না দেখে শুধুই প্রধান প্রতিযোগী হিসেবে দেখে, তাহলে পরিস্থিতির সুবিধা চীনের দিকেই হেলবে। এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের ওপর ভরসা কমবে। এটা কেবল ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের তৈরি করা অস্থিতিশীলতাকেই বাড়াবে; আর তাইওয়ান হবে এর সরাসরি শিকার।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের এই নমনীয়তা ভারতকেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি নতুন করে ভাবাবে এবং জাপানকেও সামরিকীকরণের দিকে নিয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে খারাপ হবে যদি বাইডেন ইন্দো-প্যাসিফিকের ক্ষমতা চীনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন। বাইডেনের বর্তমান নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান এবং কুর্ট ক্যাম্পবেল ২০১৯-এ এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। চীনকে তাঁরা দরকারি মার্কিন অংশীদার বলে অভিহিত করেছিলেন।
ট্রাম্পের চার বছরের পর বাইডেন অভ্যন্তরীণ সংহতিকে বেশি গুরুত্ব দিতেই পারেন, কিন্তু চীনের প্রতি কঠোরতার নীতি হলো তা, যার পেছনে আমেরিকানরা ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে পারে। ইন্দো-প্যাসিফিকের স্থিতিশীলতা এবং বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার জন্য এটাই একমাত্র নিশ্চয়তা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ব্রহ্ম চেলানি ভারতের নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক