বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা নতুন কিছু নয়

সম্প্রতি বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে—এমন সব মন্তব্যের ওপর বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিএসইসির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়েছে, ‘এ ধরনের কথা প্রচার করা হচ্ছে, তা মোটেও সঠিক নয়।’ এই দাবির পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন কোম্পানির আইপিওতে চাহিদার চেয়ে ৫, ১০ এমনকি ১৫ গুণ বেশি আবেদন পড়ছে। এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থারই প্রকাশ।’ অন্যদিকে, ডিএসই কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছে, ‘২০১২ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে এসে বাজার মূলধন ৩১ শতাংশ বেড়েছে। এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থারই প্রতিফলন।’ এখানে বাজার কিংবা শেয়ারবাজার বলতে অবশ্যই সেকেন্ডারি মার্কেটকে বোঝানো হয়েছে।
আস্থা থাকার প্রমাণ হিসেবে উপরিউক্ত যুক্তিগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, প্রাইমারি মার্কেটের চাহিদা দিয়ে সেকেন্ডারি মার্কেটের ওপর আস্থা আছে কি না, তা স্বল্প মেয়াদে বোঝা সম্ভব নয়। সেকেন্ডারি মার্কেট দীর্ঘদিন ধরে ধুঁকতে থাকলে প্রাইমারি মার্কেটের চাহিদা স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। স্বল্প মেয়াদে চাহিদার ওপর ভর করে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বুঝতে হলে সেকেন্ডারি মার্কেটের চাহিদার পরিবর্তনের ওপরই আলোকপাত করতে হবে। দৈনিক গড়ে এই চাহিদা অনেক দিন ধরে ১০০ কোটি থেকে ১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই চাহিদার পরিবর্তনকে আস্থার প্রতিফলন হিসেবে দেখা অর্থপূর্ণ বা যুক্তিসংগত হবে না। আর তা করলে মনে হবে, প্রতিদিন কিংবা প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি মাসেই বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থার হেরফের হচ্ছে।
অন্যদিকে, বাজার মূলধনের পরিবর্তনকে বিনিয়োগকারীদের আস্থার প্রতিফলন হিসেবে দেখতে হলে এর পরিবর্তনের অন্যান্য কারণকে গণনায় আনতে হবে। গত তিন বছরে কোম্পানির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। পুরোনো কোম্পানির শেয়ার সরবরাহও বেড়েছে অনেকটা। এসব কারণে বাজার মূলধন অনেক বেড়েছে। ফলে বাজার মূলধনের পরিবর্তনকে শুধুই বিনিয়োগকারীদের আস্থার প্রতিফলন হিসেবে দেখা ঠিক নয়। তবে স্বল্প মেয়াদে, অনেক নতুন কোম্পানির আগমনকে প্রাইমারি মার্কেটের ওপর আস্থা হিসেবে দেখাই যেতে পারে। সেকেন্ডারি মার্কেট ঠিক না হলে প্রাইমারি মার্কেটের ওপর থেকে ধীরে ধীরে আস্থা চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে বিএসইসি ও ডিএসই কর্তৃপক্ষের যুক্তি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও হঠাৎ করেই বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, এমনটি মনে করার কোনো কারণ দেখছি না।
বাজারে শেয়ারের দাম নির্ধারিত হয় তার সরবরাহ ও চাহিদার মাধ্যমে। অন্যদিকে, সরবরাহ ও চাহিদা পরিবর্তিত হয় অনেক কারণে, যার শুধু একটি হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে শেয়ারের মৌল ভিত্তির পরিবর্তন, আইনগত পরিবর্তন, করসম্পর্কীয় পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিবর্তন, মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার পরিবর্তন প্রভৃতি। ফলে কোনো শেয়ারের চাহিদা কমে গিয়ে এর দাম পড়ে গেলে আমরা অন্য কারণগুলোর উপস্থিতি না দেখলে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতাকে এর কারণ হিসেবে ধরে নিই। যখন নির্দিষ্ট কোনো একটা কিংবা কতিপয় শেয়ারের দাম কমে যায়, চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে তখন আমরা একে সামগ্রিকভাবে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা হিসেবে দেখি না। কিন্তু বাজারের বেশির ভাগ শেয়ারের দাম কোনো কারণ ছাড়াই কমতে থাকলে আমরা বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতাকে দায়ী করি। প্রশ্ন হলো, এরূপ উপসংহারে পৌঁছার আগে আমরা অন্য কারণগুলো খতিয়ে দেখি কি না। অথবা বিনিয়োগকারীদের আস্থা পরিমাপ করে এরূপ উপসংহারে পৌঁছাই কি না।

>তারল্য থাকলেও অনেক ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে ধীরে চলো নীতিতে এগোচ্ছে। ফলে রয়েছে প্রবল আস্থাহীনতা। এটা বেশ কয়েক বছর ধরেই রয়েছে

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের ওপর জরিপ চালিয়ে বিভিন্ন আস্থা সূচক বানানো হয়। যেমন: আপনি আগামী ১ মাসে, ৩ মাসে, ৬ মাসে, ১ বছরে কিংবা ১০ বছরে বাজার সূচক কত শতাংশ বাড়বে/কমবে বলে মনে করেন? তারপর যেসব বিনিয়োগকারী সূচক বাড়ার আশা করেন তাঁদের শতাংশ পরিমাপ করা হয়। এখন কোনো মাসে এই শতাংশ আগের তুলনায় কমে যাওয়াকে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা আপাতত কমে গিয়েছে বলে ধরা হয়। কোনো একদিন সূচকের বড় ধরনের পতন হলে তারপরের দিন তা আবার ঘুরে দাঁড়াবে, এমনটি মনে করেন কত শতাংশ বিনিয়োগকারী, তার ওপর ভিত্তি করে আরেকটি আস্থা সূচক তৈরি করা হয়। আগামী ছয় মাসে অতীতে ঘটে যাওয়া বড় ধরনের শেয়ার মার্কেট ক্রাশ আবার ঘটবে, এমনটি ঘটার আশঙ্কা ১০ শতাংশের বেশি মনে করেন কত শতাংশ বিনিয়োগকারী, তার ওপর ভিত্তি করে অন্য আরেকটি আস্থা সূচক তৈরি করা হয়, যাকে বলা হয় ক্রাশ আস্থা সূচক। কত শতাংশ বিনিয়োগকারী সার্বিকভাবে শেয়ারবাজার অতিমূল্যায়িত নয়, এমনটি মনে করেন তার ওপর ভিত্তি করে আরেক ধরনের আস্থা সূচক তৈরি করা হয়। এই বিভিন্ন ধরনের সূচকের সমন্বয়ে সার্বিক আস্থা সূচক তৈরি করা হয়।
আমাদের শেয়ারবাজার অতিমূল্যায়িত নয়, এমনটি বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীই মনে করেন। নিকট ভবিষ্যতে শেয়ারবাজার ১৯৯৬ কিংবা ২০১০-এর মতো ক্রাশ করবে, এমনটি হয়তো কেউই মনে করেন না। এই দুই দিক দিয়ে কোনো আস্থাহীনতা রয়েছে বলে মনে হয় না। তবে কোনো একদিন সূচকের বড় ধরনের পতন হলে তার পরদিন তা আবার ঘুরে দাঁড়াবে, এমনটি আস্থার সঙ্গে বলতে পারেন খুব কম বিনিয়োগকারীই। এই কারণেই পতন শুরু হলে তা থামতে সময় লাগে। আগামী এক মাসে বাজার সূচক কত শতাংশ বাড়বে, তার উত্তর ইতিবাচকভাবে দিতে পারবেন খুব কম বিনিয়োগকারীই। এই কারণেই তারল্য থাকলেও অনেক ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে ধীরে চলো নীতিতে এগোচ্ছে। ফলে রয়েছে প্রবল আস্থাহীনতা। এই আস্থাহীনতা আজ-কালকে নতুন করে তৈরি হয়েছে, তা নয়। এটা বেশ কয়েক বছর ধরেই রয়েছে।
বাবল তৈরি হওয়ার সময় অতিরিক্ত সরবরাহ আসে শেয়ারবাজারে। সর্বত্রই হয়। বাবল ফেটে গেলে চাহিদা চুপসে যায়। অতিরিক্ত সরবরাহ তখন বাজারের জন্য বোঝা হয়ে যায়। সেই বোঝা শেয়ারবাজারে দাম কিংবা শেয়ার মার্কেটের সূচককে মাটিতে নামিয়ে নিয়ে আসে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে মার্কেট ক্রাশ করার পর চাহিদা কমে গিয়েছিল। অথবা চাহিদা কমে গিয়েছিল বলেই মার্কেট ক্রাশ করেছিল। যেভাবেই দেখি না কেন চাহিদা কমে গিয়েছিল। বিপরীতে তৈরি হওয়া অতিরিক্ত সরবরাহ বোঝা হয়ে গিয়েছিল। সেই বোঝা শেয়ারবাজারের দাম কিংবা শেয়ার মার্কেটের সূচককে মাটিতে নামিয়ে নিয়ে এসেছিল, যা এখনো বিদ্যমান।
বাবল তুঙ্গে ওঠার সময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার কোটি টাকা। এখন তার প্রায় আট-দশ ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। অথচ সরবরাহ বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি। ফলে ধুঁকছে শেয়ারবাজার। এই অবস্থার পেছনের কারণ হলো বাবল তৈরির সময়ের সৃষ্ট অতিরিক্ত সরবরাহ। পণ্যের বাজারে সরবরাহ কমে আসে চাহিদা কমলে। কিন্তু ক্যাপিটাল মার্কেটের সরবরাহ স্বল্প মেয়াদে কমানো যায় না। ফলে চাহিদা পর্যাপ্ত না বাড়া পর্যন্ত এই বাজারের সূচকে খুব একটা ঊর্ধ্বগতি আশা করলে নিরাশ হওয়াটাই স্বাভাবিক। গত কয়েক বছরের আশা-নিরাশার দোলাচলে তৈরি হয়েছে এই আস্থাহীনতা। প্রকারান্তরে, সরবরাহ আরও বাড়তে থাকলে সূচকের ঊর্ধ্বগতি সুদূরপরাহত হয়ে আস্থাহীনতা আরও বাড়বে। এখন দরকার সরবরাহ আর না বাড়িয়ে বাজারে শেয়ারের চাহিদা বাড়ানো। তাই বলে কোনো কোম্পানি বাজারে আসতে চাইলে তাকে তো আর বাধা দেওয়া যাবে না। মোদ্দা কথা, বাড়তি প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে সরবরাহ বাড়ানোর কোনো ধরনের প্রয়োজন নেয় এই মুহূর্তে।
ড. মোহাম্মদ হেলাল: সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; গবেষণা পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)।