‘বিপদ’ পিছু ছাড়ছে না অস্ট্রেলিয়ার

অস্ট্রেলিয়া নিঃসন্দেহে বিশ্বের উন্নত অর্থনীতি, নাগরিকবান্ধব আইনশৃঙ্খল, কল্যাণমুখী সুবিধা ও বাসযোগ্য দেশ। তারপরও অনেক ক্ষেত্রে ভালো করতে গিয়ে মন্দ করে ফেলে। উপলক্ষ যা-ই হোক, বিপদ পিছু ছাড়ছে না দেশটিকে। অতিমারির প্রথম যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, তা যেন শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না। সমস্যার নতুন নতুন ধরনে আটকে পড়ছে দেশটি।

গত বছর চার দেশের সামরিক জোট কোয়াড্রালেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ সংক্ষেপে ‘কোয়াড’ নিয়েই শুরু। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া এ জোটে আছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারত। এ রকম জোট থেকে অন্যরা সুবিধা পেলেও অস্ট্রেলিয়ার বেলায় ঘটেছে উল্টো।

কোয়াডকে সামরিক জোট হিসেবেই দেখা হয়। কেউ কেউ এটিকে এশিয়ার ‘ন্যাটো’ বলেও অভিহিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত চীনবিরোধী। তাই ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কোয়াড হয়ে দাঁড়ায় চীনাবিরোধী জোট। অস্ট্রেলিয়া এ জোটে যোগ দিলে একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু চীন হয়ে ওঠে তার ‘শত্রু’। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এতে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হলেও অস্ট্রেলিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রথমে অস্ট্রেলিয়া ও চীন এটাকে বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবে নিলেও এখন সব ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে।

কোয়াড এখনো অদৃশ্য, প্রকাশ্য বিরোধ শুরু হয় পৃথিবীকে ধরাশায়ী করা করোনাভাইরাসের উৎস নিয়ে। চীনকে আন্তর্জাতিক স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। এতে ক্ষুব্ধ হয় বেইজিং। তাদের দাবি, চীনকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেই এ দাবি তোলা হয়েছে। এরপর ঢিল খেয়ে পাটকেল ছুড়তে থাকে তারা। অস্ট্রেলিয়া যেসব পণ্য চীনে রপ্তানি করত, প্রায় সবকিছুর ওপর আমদানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চীন সরকার। এতে অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম বাজার চীনে কয়লা, যব, তামা, বার্লি, মদসহ বেশ কয়েকটি পণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে এসব শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় মারাত্মকভাবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীনের ওপর অস্ট্রেলিয়ার যে ব্যবসায়িক-অর্থনৈতিক নির্ভরতা, তা থেকে বের হতে হলে কমপক্ষে ২৫ বছরের প্রস্তুতি প্রয়োজন। সেখানে সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা কিছু বলে দেওয়া বোকামি। অস্ট্রেলিয়া অভিবাসীদের দেশ। ফলে, নাগরিকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের চেতনা কম। তাই অস্ট্রেলিয়া সরকারের চীনবিরোধী নীতির সমর্থনও কম।

বাণিজ্যিক বিরোধ না কাটতেই অভিযোগ ওঠে, অস্ট্রেলিয়ায় চীনা নাগরিকেরা বর্ণবাদের শিকার। চীন থেকে করোনাভাইরাস সঙ্গে নিয়ে আসার ধারণা থেকে চীনা নাগরিকদের হয়রানি করার ঘটনাও ঘটছে। এর জবাবে অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে আসা চীনা শিক্ষার্থীদের কাছে অস্ট্রেলিয়া নিরাপদ নয় বলে ঘোষণা দেয় বেইজিং। অস্ট্রেলিয়ায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশ চীনা নাগরিক। দেড় লাখের বেশি চীনা শিক্ষার্থী সেখানে পড়াশোনা করতেন। তাঁদের ফিরিয়ে নেওয়া এবং সেখানে নতুন শিক্ষার্থীদের আসতে না দেওয়ার অজুহাত খোঁজে তারা। এর জবাবে চীনে বসবাসরত অস্ট্রেলীয় কূটনৈতিকেরা নিরাপদ নন বলে মন্তব্য করে ক্যানবেরা। এ কথার জের ধরে দুই দেশই একে অপরের কূটনীতিকদের জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানি করতে থাকে।

বিষয়টিকে বেইজিং অস্ট্রেলিয়ার ‘নিকৃষ্টতম’ হস্তক্ষেপ বলে মন্তব্য করে। তাদের মতে, ভূরাজনৈতিক লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিয়েছে। অন্যদিকে, দুই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিরোধ কীভাবে মেটানো যায়, সেই চেষ্টাও আছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীনের ওপর অস্ট্রেলিয়ার যে ব্যবসায়িক-অর্থনৈতিক নির্ভরতা, তা থেকে বের হতে হলে কমপক্ষে ২৫ বছরের প্রস্তুতি প্রয়োজন। সেখানে সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা কিছু বলে দেওয়া বোকামি। অস্ট্রেলিয়া অভিবাসীদের দেশ। ফলে, নাগরিকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের চেতনা কম। তাই অস্ট্রেলিয়া সরকারের চীনবিরোধী নীতির সমর্থনও কম।

সিডনির ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের আইন অনুষদের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ওয়েইহুয়ান জাও সম্পর্কোন্নয়নের পরামর্শ দিয়েছেন। চীনা বংশোদ্ভূত এই অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষাবিদ বলেন, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ দূরে রেখে অস্ট্রেলিয়াকে উত্তেজনা হ্রাস করতে এবং চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কারণ, অস্ট্রেলিয়ান গ্রাহকের কাছে চীনা পণ্য এখনো অবিকল্প ভাবা হয়।

অন্যদিকে, চীনের এই শক্ত অবস্থান অস্ট্রেলিয়ার জন্য ‘ওয়েক আপ কল’ বলে বর্ণনা করেছেন অনেকে। অস্ট্রেলিয়ার প্রভাবশালী সংবাদপত্র সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক পিটার হার্টচার তাঁর নিবন্ধের শিরোনামই করেছেন ‘আমাদের সার্বভৌমত্ব: চীন আমাদের কোনো বিকল্প দেয়নি’। তিনি লিখেছেন, অস্ট্রেলিয়া এখন সত্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এটি এখন সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক স্বার্থের মধ্যে বাছাই করার বিষয় হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি সরাসরি প্রশ্ন রেখেছেন, ‘সার্বভৌমত্ব নাকি অর্থ। অস্ট্রেলিয়ার পছন্দ কোনটি’?

এদিকে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও নানা জটিলতার মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা ৬ লাখের বেশি, ব্রাজিলে ৫ লাখ ও ভারতে ৪ লাখের বেশি। সেখানে অস্ট্রেলিয়ায় এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা মাত্র ৯৩২ জন। অস্ট্রেলিয়ার আয়তন ও জনসংখ্যার তুলনায় এ হার কিছুই নয়। অস্ট্রেলিয়া শুরু থেকে করোনামুক্ত দেশ হিসেবেই ছিল। এর কারণ সংক্রমণ ঠেকাতে দেশটির কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ। এত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশেও সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে নতুনভাবে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে নিজ দেশে লাখে লাখে নাগরিক মারা যাওয়ার সময়ও সীমানা খুলে রেখেছিল। কিন্তু সেখানে শুরুতেই বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় অস্ট্রেলিয়া। সেই সঙ্গে নিজ দেশের নাগরিকদের মধ্যে শূন্য সংক্রমণ হার রেখে চলার চেষ্টা করেছে তারা। এ জন্য দেশটির আন্তর্জাতিক সীমানা তো বটেই, বিধিনিষেধ এতই কঠোর যে দেশটির রাজ্যগুলোও নিজেদের সীমানা বন্ধ করে রেখেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানেও রাজ্য সীমানা খুলতে নারাজ ছিল রাজ্য সরকার।

বাংলাদেশে সফরে এসে একের পর এক নানা শর্ত জুড়ে দিতে থাকে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ড। পুরো একটা খালি হোটেল তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা, তারা অনুশীলন করার সময় অন্য কেউ মাঠে প্রবেশ করতে না পারা, এমনকি বাইরের খাবারও তাদের দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়

অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের সুরক্ষায় এত কঠোর পদক্ষেপগুলো কম সমালোচনার সৃষ্টি করেনি। এর আরেকটি উদাহরণ অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটকে ভালোবাসে এ কথা সবার জানা। তবে এই অতিমারির মধ্যেও বাংলাদেশে খেলতে এসেছে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট টিম। কারণ অস্ট্রেলিয়ানরা মনে করে, খেলাধুলা থাকলে পৃথিবীর ঘরবন্দী মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হবে। দেশটির খেলাধুলার সব অঙ্গনই সচল আছে। কিন্তু বাংলাদেশে সফরে এসে একের পর এক নানা শর্ত জুড়ে দিতে থাকে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ড। পুরো একটা খালি হোটেল তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা, তারা অনুশীলন করার সময় অন্য কেউ মাঠে প্রবেশ করতে না পারা, এমনকি বাইরের খাবারও তাদের দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া সবাইকে বায়ো-বাবলে থাকতে হবে—এমন শর্ত না মানতে পারার কারণে মুশফিকুর রহিমকে খেলতেও দেয়নি তারা।

তাদের এত কঠোর অবস্থানের কারণ শুধু নিজ দেশের নাগরিকদের সুরক্ষিত রাখা। কেননা, ভারতে যখন করোনার প্রকোপ ভয়াবহ, তখন দেশটিতে আইপিএল খেলতে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটারদের ওপর, নাগরিক হয়েও নিজ দেশে ফিরে এলে জেল জরিমানা দেওয়ার হুমকি দেয় অস্ট্রেলিয়ার সরকার। আর নিজ দেশেই অস্ট্রেলীয়রা কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মনে চলে। ফলে, দেখা গেছে যে মাত্র একজন আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় ২০ লাখ বাসিন্দাকে গৃহবন্দী করে ফেলার নজির আছে দেশটিতে। এমনকি মাত্র ৩০ সেকেন্ড মাস্ক না পরার কারণে খোদ দেশটির এক উপপ্রধানমন্ত্রীকেও জরিমানা করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই সফরে গিয়েও নিয়ম মেনে চলবেন জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। আর নীতিমালা মানতে গিয়েই অস্ট্রেলিয়াকে বারবার পড়তে হচ্ছে সমালোচনার মুখে।

নাগরিকদের সুরক্ষার ব্যাপারে বাড়তি সচেতন হতে গিয়েও তিক্ত কথা শুনতে হয়েছে দেশটিকে। শুরুতে বিশ্বের সেরা যে করোনা টিকা ছিল, সেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আড়াই কোটি নাগরিকের দেশে পাঁচ কোটি টিকা আমদানি করার চুক্তি করে অস্ট্রেলিয়া। পাশাপাশি টিকা নিজ দেশে উৎপাদন করার স্বত্বও নিয়েছিল সরকার। তবে প্রতিজন টিকা নেওয়া নাগরিকের তথ্য রাখতে গিয়ে দেখা মেলে নতুন সমস্যার। অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় রক্ত জমাট বাঁধা এবং মৃত্যুর কয়েকটি ঘটনা ঘটে। ফলে, দেশের ভেতর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ায় অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়া বন্ধ করে দেয় অস্ট্রেলিয়া। পরিবর্তে ফাইজারের টিকা দেওয়া শুরু করে।

শুরুতে দেশটির নাগরিকেরা টিকা গ্রহণে তেমন কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। তবে ভাইরাসের ডেলটা ভেরিয়েন্টে সংক্রমণের হার বেশি হওয়ার কারণে আতঙ্কে মানুষ টিকা নেওয়া শুরু করেছে এখন আগের চেয়ে বেশি। সঙ্গে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকাও। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। দুর্নাম, উত্তেজনা, ক্ষতি সবই।

কাউসার খান অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী অভিবাসন আইনজীবী ও সাংবাদিক
[email protected]