বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর শিক্ষা নিয়ে একজন মায়ের কথা

ওপরের ছবিটা দেখলে আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে, কোনো শিশু রংতুলি দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে শীতের সকালের একটি ছবি এঁকেছে। এবার নিচে যুক্ত করা ব্রসিউরের ছবিটি দেখুন। সেখানে প্রচ্ছদের লেখাগুলো খেয়াল করলে বোঝা যাবে এর বিষয়বস্তু কী? এই আঁকিয়ের এ রকম সুন্দর আরও ছবি আছে। এর পেছনে যে কী পরিমাণ শ্রম দিতে হয়েছে, তা কল্পনাতীত। জানি, বিনা শ্রমে কিছু লাভ করার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই। কিন্তু এ আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছি না। কারণ, ব্রসিউরের ভেতরের পাতায় তার নামের আগে যে বিশেষণ আছে, সেটা ততটা সুখকর নয়।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন একটি শিশুর পেছনে কী পরিমাণ শ্রম ও মেধা ব্যয় করতে হয়, তা কেবল ভুক্তভোগীই জানেন। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে একেবারে তার শিশুকাল থেকে। এখনো এর ব্যত্যয় ঘটেনি; বরং এখন পরিস্থিতি আরও জটিল।

আমার সন্তান প্রাঞ্জলের আড়াই বছর বয়সে আমরা জানতে পারি ওর অটিস্টিক আছে। এ শব্দের সঙ্গে কখনো পরিচিত ছিলাম না। যখন এর আদ্যোপান্ত জানতে পারলাম, তখন চোখে শর্ষে ফুল দেখলাম। সেই থেকে যে আমাদের লড়াই শুরু হয়েছে, তা কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে, অনিশ্চিত। এ নিয়ে তার বাবা সব সময় দুশ্চিন্তা করলেও আমি তাকে সান্ত্বনা দিই। ইদানীং এ দুশ্চিন্তা আমাকেও পেয়ে বসেছে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পাশাপাশি আবৃত্তি, গান, ছবি আঁকা ইত্যাদি মোটামুটি ভালোভাবেই চলছিল (সমাপনী পরীক্ষায় সে জিপিএ–৫ পেয়েছে)। ওপরের ক্লাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এক্সট্রা কারিকুলাম একে একে বাদ দিতে হলো। এখন সে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। কমার্সে ভর্তি করেছিলাম, কিন্তু সে পড়বে না। তার আগ্রহ বিজ্ঞানে। ব্যাপারটা কি অত সহজ? বিজ্ঞানের এতগুলো শাখা! এখন আবার ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ নামক বিষফোড়ার বাড়তি চাপ!

২০১৭ সালে ১ মার্চ ‘অটিজম ও এনডিডি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মূলধারায় একীভূতকরণ–বিষয়ক নীতিমালার রূপরেখা প্রণয়ন’ কর্মশালায় অভিভাবক হিসেবে আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম। আয়োজন করেছিল ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিজ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা। সেখানে বিশেষ স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকেরা ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে নিজেদের দাবি উত্থাপন করেন। আমার একটি ব্যক্তিগত দাবি ছিল এ রকম—যেহেতু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের লেখার প্রতি ভীষণ অনীহা এবং পরীক্ষা শব্দটায় ভীতি আছে, তাই তাদের প্রশ্নপত্রগুলো সংক্ষিপ্ত উত্তরের ভিত্তিতে তৈরি করা হলে পরীক্ষা জিনিসটা সহজ হতো। এ ক্ষেত্রে আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা সময় বাড়িয়ে দিলেও তেমন ফলপ্রসূ হবে না।

আমাদের প্যারেন্টস ফোরাম নামে একটি সংগঠন আছে, যার সুন্দর একটা স্লোগান হলো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা ‘ডিফারেন্টলি অ্যাবলড’। এদের মধ্যে অনেকের এমন কিছু প্রতিভা আছে, যা আমাদের সাধারণ মানুষের মধ্যে নেই। সে অনুযায়ী তাদের জন্য কিছু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে তারাও দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর হতে পারবে।

বর্তমান কোভিড–১৯ পরিস্থিতিতে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ নামক শিক্ষার অত্যাচারে যেখানে স্বাভাবিক শিক্ষার্থীরা অতিষ্ঠ, সেখানে এ বাচ্চাদের ওপর কী রকম চাপ পড়ছে, তা সহজেই অনুমেয়। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠে কখনো তারা নিজের মাথায় আঘাত করছে, আবার কখনো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। মা-বাবা, প্রাইভেট টিউটর—কারও দিকনির্দেশনা মানবে না। তাকে নিজেকেই পারতে হবে। এমন অস্থির আচরণ যখন করে, তখন মনে হয়, থাক, পড়াশোনার আর দরকার নেই। আবার নিজেই পড়তে বসে। এই করতে করতে সময় চলে যাচ্ছে, সেটাও বুঝতে পারে না।

একটি বিতিকিচ্ছি অবস্থা তৈরি হয়। রাতের পর রাত সেও জাগছে, আমিও জাগছি। শারীরিক, মানসিক—দুদিকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ওদের জন্য অনেক কিছু করছেন। প্রচারের ফলে প্রাপ্তিও কিছু আছে। প্রথমত, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা সহনশীল হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর প্রতিভা এবং তাদের মা–বাবার সংগ্রামের খণ্ডচিত্র প্রকাশ করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকাও অনস্বীকার্য।
প্রথম আলো প্রতিবছর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর আঁকা ছবি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা কার্ড তৈরি করার এবং পুরস্কৃত হওয়ার গল্প ছেপে যাচ্ছে। এটিএন নিউজ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে ‘পাওয়ার প্যারেন্টস’ এবং আরটিভি সাপ্তাহিকভাবে ‘হাত বাড়িয়ে দিলাম’ শিরোনামে নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার করছে। অন্য টিভি চ্যানেলগুলোও কমবেশি কাজ করছে।

এত কিছুর পরও প্রতিনিয়ত একটি চিন্তা হচ্ছে, আমাদের অবর্তমানে ওকে কে দেখাশোনা করবে। সে নিজেকে নিজে আদৌ কি কখনো দেখে রাখতে পারবে?

সাজেদা কলি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মা