বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট নিরসনের উপায় কী

করোনায় ফাঁকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্র
ছবি: প্রথম আলো

এক বছরের বেশি সময় ধরে চলমান কোভিড-১৯ মহামারির কারণে শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্লাস, পরীক্ষা, ফলাফল প্রকাশ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, করোনার প্রকোপে সেই স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে চলেছে এক বছরের বেশি সময়।

২০২০ সালের জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও আগে থেকেই অনলাইনে ক্লাসের পাশাপাশি পরীক্ষা গ্রহণ এবং ফলাফল প্রকাশ কার্যক্রম চালাতে থাকে। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নতুন ভর্তি এমনকি শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানও করেছে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাসের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসতে পারলেও পরীক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় থেকে যায়।

এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরপর দুটি সেমিস্টার শেষ করে বসে আছে। পরীক্ষা না হলে পরবর্তী বর্ষে প্রমোশন পাচ্ছে না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সে তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় সেমিস্টার সিস্টেম ও বর্ষভিত্তিক। সেখানে শিক্ষার্থীরা কোনো শিক্ষা বর্ষে অকৃতকার্য হলে পরবর্তী বর্ষে উন্নীত হতে পারে না। সে কারণে একাডেমিক ক্যালেন্ডার বিপর্যয় ঘটছে। শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সেশনজটের দ্বারপ্রান্তে উপনীত।

নতুন সেশনে ভর্তির কী হবে?

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে একবার স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষে ভর্তি নেওয়া হয়। করোনার কারণে ২০২০ সালে নিয়মিত সময়ে উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষা হতে পারেনি। তথাকথিত অটো পাস দেওয়া হলেও ফলাফল প্রকাশে যথেষ্ট সময় নেওয়া হয়।নানা দীর্ঘসূত্রতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তারিখ, ভর্তির পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। কয়েকবার সময় পরিবর্তন করেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন ভর্তি নিতে পারেনি। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ বছরের জুলাই-আগস্ট বা তারও পরে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কিন্তু ২০২১ সালের মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা নেওয়া যাচ্ছে না। প্রশ্ন হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিক ২০২০ ব্যাচের ভর্তিই যেখানে নেওয়া যাচ্ছে না, সেখানে ২০২১ ব্যাচের ভর্তি পরীক্ষা তাহলে কখন কীভাবে নেওয়া হবে?

ইতিমধ্যে কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য সেমিস্টারের স্থলে ট্রাইমেস্টার পদ্ধতিতে পাঠদানের কথা বলছে। কিন্তু এখানে সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এখানে দুই ধরনের সক্ষমতা বিবেচ্য। এক. অবকাঠামোগত এবং দুই. কৌশলগত। কৌশলগতভাবে প্রশাসন ও শিক্ষকদের প্রেরণা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে, ছুটি কমিয়ে, পাঠদানের সময় বাড়িয়ে, দ্রুততম সময়ে পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশের মাধ্যমে কিছুটা সেশনজট কমানো সম্ভব। কিন্তু ভৌত অবকাঠামোর কী হবে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকট খুবই তীব্র।

উত্তরণের সম্ভাব্য পথ কী?
প্রথমেই চলমান শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত। স্বাভাবিক পরিস্থিতি কবে আসবে, সে জন্য শিক্ষার্থীদের অপেক্ষায় রাখা ঠিক হবে না। জানা মতে দু–একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ওপেন-বুক-এক্সাম, টেক-হোম-অ্যাসাইনমেন্ট, অনলাইন ইন্টারভিউ ইত্যাদির কোনো একটি অথবা কয়েকটির মিশ্রণ পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন শেষ করেছে।

অনেক উন্নত দেশেও শিক্ষার্থী মূল্যায়নে এগুলো স্বীকৃত পদ্ধতি। বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মূল্যায়নে এসব পদ্ধতি বিবেচনা করা যেতে পারে। আবার বর্তমান শিক্ষার্থীদের ‘ট্রেন্ড পাস’ অটো পাসের মতোই একটা বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

উচ্চমাধ্যমিকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী যেখানে অটো পাস পেয়েছে, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ‘ট্রেন্ড পাস’ মহামারি বিবেচনায় প্রযোজ্য সমাধান হতে পারে। সে ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর পূর্ববর্তী এক বা একাধিক সেমিস্টার-বর্ষের ফলাফল বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী ফলাফল দেওয়া যেতে পারে।

এভাবে যেকোনো পদ্ধতিতে চলমান শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করে ফলাফল প্রকাশের মাধ্যমে পরবর্তী সেমিস্টার-বর্ষে প্রমোশন দেওয়া হলে তাদের জন্যও পরের টার্ম শুরু করা যাবে। সব ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্নাতকোত্তর এবং স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন করা যেতে পারে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবশ্যই ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এবং বিদ্যমান অবকাঠামো উন্নয়নের ব্যবস্থা নিতে হবে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি বরাদ্দ ছিল প্রায় ৫ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। বেতন–ভাতা, গবেষণা, পেনশনের বাইরে পণ্য ও সেবা খাতে ক্রয় ও মেরামতের জন্য ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল প্রায় ১ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২০ শতাংশেরও বেশি। প্রায় ১৪ মাস ধরে বন্ধ থাকা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উল্লিখিত সময়ে ক্রয় বা মেরামত খাতে ধরে নেওয়া যায় সামান্যই ব্যয় হয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ তহবিল, অ্যালামনাই সহায়তা ইত্যাদির মাধ্যমে দৃশ্যমান ভৌত অবকাঠামো তথা নতুন হল নির্মাণ, পুরোনো হলগুলোর সময়োপযোগী মেরামত জরুরি ভিত্তিতে করা উচিত। নতুবা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার প্রথম বর্ষে পরপর দুটি ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হলে উদ্ভূত আবাসন সংকট সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

ৎপরিশেষে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রযুক্তি সহায়তা বাড়াতে হবে। করোনাকালে দেখা গেল ছাত্রছাত্রীদের এমনকি ইনস্টিটিউশনাল ই–মেইল অ্যাড্রেস পর্যন্ত নেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ডেটাবেইস না থাকার কারণে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সময়মতো যোগাযোগ পর্যন্ত করা যায়নি। ইউটিউব চ্যানেল, অনলাইন প্রশ্নব্যাংক, লার্নিং মডিউল ইত্যাদি আগে থেকে থাকলে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কিছুটা হলেও সহজ হতো। অথবা মহামারির শুরুতেই প্রস্তুতি নিলে এতদিনে হয়তো যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জিত হতো। বর্তমান সরকার প্রযুক্তির উৎকর্ষে যথেষ্ট আন্তরিক। বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও এ উদ্যোগে এগিয়ে আসতে হবে।
উল্লিখিত সামষ্টিক প্রচেষ্টাগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সেশনজট নিরসন হতে পারে। সরকার, ইউজিসি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিলম্ব না করে কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

ড. শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক