বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বেদনাপ্রসূত বিদ্রূপ

ইউনিভার্সিটি বা বিশ্ববিদ্যালয় গুরুতর ও গুরুগম্ভীর প্রতিষ্ঠান। তার সম্পর্ক একদম আক্ষরিকভাবে ইউনিভার্স বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু ছিল এবং আছে, সে সমুদয় সম্বন্ধে বিদ্যাদান, বিদ্যা গ্রহণ, জ্ঞানের অনুসন্ধান, গবেষণা, জ্ঞান-বিজ্ঞান-অধিবিদ্যা ইত্যাদির চর্চা-অনুশীলনের ক্ষেত্র হলো বিশ্ববিদ্যালয়। এহেন সিরিয়াস প্রতিষ্ঠান নিয়ে রসিকতা কিংবা বিদ্রূপ চলে না।

কিন্তু সদ্য প্রকাশিত একখানা বই এই অধমের হস্তগত হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপে ভরপুর। হরেদরে সব বিশ্ববিদ্যালয় নয়, রসিকতা করা হয়েছে জাতির প্রধানতম বিদ্যাপীঠ নিয়ে; মর্মান্তিক বিদ্রূপে বিদ্ধ করা হয়েছে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে খ্যাতিমান আমাদের গৌরবের ধন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।

প্রিয় পাঠক, বইখানার নাম দেখুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: অ-সুখ ও প্রতিকার কিংবা আলিফ লাইলা!

খোদার দুনিয়ায় কোথায় কোন দেশে এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যার কোনো সমস্যা নেই? সমস্যা ছাড়া কি কোনো প্রতিষ্ঠান আছে, না থাকা সম্ভব? অথচ আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য কিছু ‘অ-সুখের’ ফিরিস্তি তুলে ধরার জন্য টেনে আনা হয়েছে আরব্য উপন্যাসের উজিরকন্যা শেহেরজাদি ও তার অনুজা দিনারজাদিকে! বাদ মাগরিব থেকে শুরু করে সুবেহে সাদিক পর্যন্ত বকানো হয়েছে বাচাল উজিরকন্যাকে দিয়ে! একের পর এক বারোটি রজনী ধরে!

কী অন্যায়! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো আমাদের জাতীয় গৌরবের অংশ এবং তা শুধু জ্ঞানবিদ্যার জন্য নয়; রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামের যে ঐতিহ্য আমাদের আজও একটা জাতি হিসেবে চিনতে সাহায্য করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই ঐতিহ্যের উজ্জ্বলতম অংশও বটে। আরব্য উপন্যাসের বাচাল উজিরকন্যাকে দিয়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঠাট্টা-বিদ্রূপের তির ছোড়া নিঃসন্দেহে একটা গর্হিত অপরাধ।

হুম। এইভাবে ভাবতে এই অধমের আপত্তি থাকত না, যদি আলোচ্য বইটির রচনাকার এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষক না হতেন, যিনি অকপটে স্বীকার করেছেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৩০ বছর ধরে তাঁর ‘অন্নদাতা’র ভূমিকা পালন করে চলেছে। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। শুধু তা-ই নয়, তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও ছিলেন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর ‘আলমা মাতের’ বা মাতৃশিক্ষায়তন। এর শোচনীয় দুর্দশায় বেদনার্ত হয়ে দুর্দশা লাঘবের আকুতি জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু সেই আকুতির ভাষা ও সুর হয়ে গেছে বিদ্রূপাত্মক; সম্ভবত এই কারণে যে সিরিয়াস বিষয়ে সিরিয়াস আলোচনায় এই জাতির অন্তরে-বিবেকে আজকাল আর কোনো সাড়া জাগে না। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামগ্রিক চেহারা ও চালচলন এমনই কিম্ভূতকিমাকার হয়েছে যে তা লক্ষ করে সংবেদনশীল নাগরিকদের কখনো কান্না পায়, কখনো পায় হাসি। কাঁদতে কাঁদতে অট্টহাসি হেসে ওঠার মতো উদ্ভট আচরণও তো মানুষের পক্ষে অসম্ভব নয়—মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডিগুলো তার সাক্ষাৎ প্রমাণ।

তো আলিফ লাইলার প্রথম রজনীতে উজিরকন্যা দিনারজাদি অগ্রজা শেহেরজাদিকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপা, পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা পায় না কেন?’—প্রধানত এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই শেহেরজাদিকে পরপর ১২টি রজনী ধরে বকবক করে যেতে হয়। প্রথমে তার কথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে মৃদু কৈফিয়তের সুর ধ্বনিত হয়; সে বলে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টা বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র অংশ বৈ অন্য কিছু নয়। স্বাস্থ্য হলে সারা শরীরে হয়, হাতটা শুধু স্বাস্থ্যবান, মাথাটা স্বাস্থ্যহীন—এমনটা হয় না। বাংলাদেশের কোনো সেক্টরেই যেহেতু মানসম্পন্ন কিছু হচ্ছে না, সেহেতু হঠাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উপচে পড়ার কথা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাঙ্কিংয়ের বাইরে থাকার এটাই হচ্ছে প্রথম কারণ।’

অর্থাৎ দোষটা আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, দোষ বাংলাদেশ নামের গোটা রাষ্ট্রের।

তারপর শেহেরজাদি বলে, র‌্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের সেরা ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় থাকতে হলে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয়, সেগুলো পূরণ করা ‘বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বা গরিব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অসম্ভব না হলেও কঠিন তো বটেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাঙ্কিংয়ে স্থান না পাওয়ার এটা দ্বিতীয় কারণ।’

অসম্ভব হলে তো আলাপ তোলারই কোনো মানে থাকত না; শেহেরজাদিরূপী শিশির ভট্টাচার্য্য আসলে বলেছেন, শর্তগুলো পূরণ করা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষে কঠিন বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাঙ্কিংয়ে স্থান পায় না। কিন্তু তৃতীয় কারণ হিসেবে যা বলেছেন, তা দ্বিতীয় কারণটিকে খারিজ করে দেয়। তিনি বলেছেন, র‌্যাঙ্কিংয়ে স্থান পেতে হলে অক্সফোর্ড বা এমআইটির মতো সেরা মানের বিশ্ববিদ্যালয় হতে হয়। এগুলো সেরা হওয়ার প্রথম কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মধ্যে একাধিক নোবেল পুরস্কারধারী রয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মধ্যে সে রকম কেউ নেই। শিশির ভট্টাচার্য্যের মতে, নোবেল পুরস্কার পেতে হলে ‘বিদ্যাচর্চার যে দীর্ঘকালীন পরিবেশ-মানসিকতা লাগে’ তা পূর্ববঙ্গে নেই, কোনো কালে ছিলও না। ‘ভাটি বা বদ্বীপ অঞ্চলে চাষবাস হতে পারে, কিন্তু জ্ঞানচর্চা হয় কি? সেই পরিবেশ সৃষ্টির সামর্থ্য বাঙালির এখনো নেই, আগেও ছিল না।’

এ বড় মর্মান্তিক কথা। চূড়ান্ত হতাশার কথা। এরপর আর কোনো আশা থাকে না, এরপর আর কোনো বাক্যব্যয়ের উৎসাহ অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। কিন্তু শিশির ভট্টাচার্য্যের অন্তরে তাঁর আলমা মাতেরের জন্য গভীর ভালোবাসা আছে; স্বজাতির শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশের জন্য গভীর আকুতি আছে। তাই তিনি বইটির মুখবন্ধেই লিখেছেন, ‘মধ্যযুগের ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো ‘রাজার জ্যেষ্ঠ কন্যা’। ২০২১ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্ণ হবে। আহা! শততম জন্মদিনের আগেই যদি বাংলাদেশের এই বড় মেয়েটির অ-সুখের সব কটি কারণ দূর করা যেত! সেটা সম্ভব নয় জানি এবং সব সমস্যারই যে সমাধান আছে, তা-ও তো নয়। তবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিচিত্র সব অ-সুখের উপসর্গ, কারণ ও প্রতিকার নীতিনির্ধারকদের সামনে পেশ করলাম এই আশায় যে তাঁরা এই অভাগী মেয়েগুলোকে দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

তাই প্রথম রজনীতেই শেহেরজাদিকে দিয়ে গভীর হতাশার কথা বলিয়েই লেখক থেমে যাননি, একের পর এক তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্দশার কারণ। ছাত্রাবাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের মানবেতর জীবনযাপন থেকে শুরু করে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের মাধ্যমে শিক্ষার বাণিজ্যকরণের পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক, গবেষণা ক্ষেত্রে সমস্যাবলি, শিক্ষক-গবেষকদের কুম্ভীলকবৃত্তি, পদোন্নতি-পদায়নের অসমীচীন পদ্ধতি, ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষকরাজনীতি, প্রশাসনিক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দলীয়করণ ইত্যাদি সমস্যা আলোচনা করেছেন। প্রতিকারের সম্ভাব্য উপায়ও প্রস্তাব করেছেন, এটা মেনে নিয়েই যে সেগুলো সম্পর্কে সবাই একমত হবেন না; ভিন্নমতও থাকবে এবং সেটাই স্বাভাবিক।

গল্পের ঢং ও সরস ভাষার কারণে বইটি বেশ উপভোগ্য হয়েছে।


[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: অ-সুখ ও প্রতিকার কিংবা আলিফ লাইলা, শিশির ভট্টাচার্য্য, প্রথমা প্রকাশন]

মশিউল আলম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক