বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভাবমূর্তি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা ছাড়াও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরাও শামিল হয়েছেন এই আলোচনায়।
কথা হলো, ২০১৯ সালের ভর্তি পরীক্ষার একটি বিষয় এখন কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে আলোচনার বিষয় হলো? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক সমিতি কিংবা কর্তাব্যক্তিরা কি পারতেন না এর সমাধান দিতে?
শুরুটা হয় গত ২৭ জুন অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০তম সিন্ডিকেটের পর। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকদের সংগঠনের ফেসবুক পেজে প্রকাশিত একাধিক খবরের সূত্র ধরে। বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে চটকদার শিরোনামে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, কোষাধ্যক্ষ ও উপাচার্যের বক্তব্যসহ সাংবাদিকতা বিভাগের দুজন ও গণিত বিভাগের একজন শিক্ষকের ছবিসহ শাস্তির খবর ছাপা হয়। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত প্রকাশ না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার ব্যক্তিবর্গের বক্তব্যসহ ওই খবর সত্য বলে প্রতীয়মান হয়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় অংশটির মধ্যে আশঙ্কা ও ক্ষোভ তৈরি হয়। একটু পেছনে ফেরা যাক। শিক্ষকদের এই অংশটি ২০২১ সালের শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে রেজিস্ট্রার-সমর্থিত বাকি দুটি গ্রুপের কাছে পরাজিত হয়। এরপর থেকেই তাঁদের ওপর একের পর এক অন্যায় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। কারও পদোন্নতি আটকে দিয়ে, কারও পদোন্নতিতে অপ্রয়োজনীয় কালক্ষেপণ, কাউকে পিএইচডি ছুটি না দিয়ে। শিক্ষক কাজী আনিছের পদোন্নতি বাতিল এবং মাহবুবুল হক ভূঁইয়ার চাকরিচ্যুতির উদ্যোগ সর্বশেষ সংযোজন।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহবুবুল হক ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এক পরীক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষা না দিয়ে ১২তম স্থান লাভের বিষয়ে গণমাধ্যমে তথ্য দেন। এ ঘটনার জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদে একবারও হাজির হননি ‘বি’ ইউনিট কমিটির প্রধান অধ্যাপক মাসুদা কামাল। অথচ পুরো ঘটনাটির মূল দায়দায়িত্ব যে দুজনের, তিনি তাঁদের একজন। অন্যজন ‘বি’ ইউনিট কমিটির সদস্যসচিব শামীমুল ইসলাম, যিনি বর্তমানে শিক্ষক সমিতির সভাপতি। মূলত তাঁকে রক্ষা করার জন্যই রেজিস্ট্রারসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এত আয়োজন।
মাহবুব ‘বি’ ইউনিটের উপকমিটি প্রবেশপত্র কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন। ওই কমিটিই ফলাফলে গরমিলের বিষয়টি খুঁজে বের করে এবং লিখিতভাবে ‘বি’ ইউনিটের প্রধান ও সদস্যসচিবকে জানায়। কিন্তু বিষয়টি সুরাহা না করেই তাঁরা পূর্বঘোষিত সময়ে মৌখিক পরীক্ষা নেন। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
পরবর্তী সময়ে সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত কমিটি ইউনিটপ্রধান ও সদস্যসচিবের গাফিলতির কথা জানায়। কিন্তু রেজিস্ট্রারসহ প্রশাসন তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু সংবাদের সোর্স খুঁজে বের করতে ‘উচ্চতর তদন্ত কমিটি’ নামে আরেকটি কমিটি করে। শিক্ষক সমিতির তৎকালীন সভাপতি হওয়ার বদৌলতে সদস্যসচিব কথিত সোর্সের শাস্তির দাবিতে একটি মানববন্ধনও করিয়ে নেন।
এখন প্রশ্ন হলো, গণমাধ্যমে সত্য তথ্য দেওয়া অপরাধ কি না? যে সোর্স গণমাধ্যমে তথ্য দিয়ে একটি অবৈধ ভর্তিকে রুখে দিলেন, তাঁর বিচার হবে; নাকি যাঁদের ইচ্ছায় বা গাফিলতিতে একজন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা না দিয়েও ১২তম হলেন, তাঁর বিচার হওয়া উচিত?
সাংবাদিকতা বিভাগের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের ব্যক্তিগত ক্ষোভের প্রকাশ দেখা যায় ২০১৯ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদে। তিনি তখন ‘সাংবাদিকতা বিভাগ খুলে পাপ করেছি’ বলে গণমাধ্যমে মন্তব্য করেন। আমরা তারই ধারাবাহিকতা দেখতে পাই সাংবাদিকতা বিভাগেরই আরেক শিক্ষক কাজী আনিছের ঘটনায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৯তম সিন্ডিকেটে তাঁকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়। তিনি উক্ত পদে যোগদান করেন এবং আজ অবধি ওই পদের সব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু গণমাধ্যম মারফত জানা যায়, গত ২৭ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০তম সিন্ডিকেটে তাঁর পদোন্নতি স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু ওই সিন্ডিকেটের আগেই প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়েরিতে তাঁর পদবি প্রভাষক লেখা হয়। তবে কি ডায়েরি প্রকাশনা কমিটি আগেই জানত যে কাজী আনিছের পদোন্নতিটি স্থগিত হবে? উল্লেখ্য, উক্ত ডায়েরির প্রকাশক রেজিস্ট্রার এবং প্রকাশনা কমিটির আহ্বায়ক মো. শামীমুল ইসলাম, যিনি ‘বি’ ইউনিট কমিটিরও সদস্যসচিব ছিলেন।
কাজী আনিছকে বলা হয় তাঁর অভিজ্ঞতার সনদে ‘টু রেজিস্ট্রার’ এর পরিবর্তে ‘টু হুম ইট মে কনসার্ন’ লেখা ছিল, তাই তিনি পদোন্নতি পাবেন না। এখন প্রশ্ন হলো, কোনো প্রতিষ্ঠান তার কর্মীকে অভিজ্ঞতা সনদ প্রদান করবে তার নিজস্ব কাঠামোতে, নাকি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশিত কাঠামোতে? দ্বিতীয়ত, ‘টু হুম ইট মে কনসার্ন’ শিরোনামের সনদ কি পৃথিবীর কোথাও অগ্রহণযোগ্য? কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন কি ভিন্ন গ্রহের? আর পদোন্নতির আগে এগুলো যাচাই-বাছাই না করা কার অদক্ষতা?
জানা যায়, ওই একই সিন্ডিকেটে গণিত বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা স্পষ্টত বিশ্ববিদ্যালয় আইনের পরিপন্থী ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত রীতিতেই তার সমাধান সম্ভব।
বস্তুত, বিশ্ববিদ্যালয়টির এই সমস্যার মূলে রয়েছে শিক্ষকদের বিভিন্ন দলে বিভক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমত, ভিন্ন ভিন্ন দল থাকবে, সেটি স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন তখনই ওঠে, যখন প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় একটি পক্ষ কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অন্য পক্ষকে কোণঠাসা করতে থাকে। রেজিস্ট্রার-সমর্থিত পক্ষটি বছরের পর বছর ধরে প্রভাব খাটিয়ে নিজ পক্ষের শিক্ষকদের জন্য নানা অনিয়মে পদোন্নতির ব্যবস্থা, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন, ডিন-চেয়ারম্যান নিয়োগে অনিয়ম, ব্যক্তিবিশেষের খাতিরে পদোন্নতি নীতিমালায় পরিবর্তন, অন্য পক্ষের শিক্ষকদের পদোন্নতি আটকে রাখাসহ নানা অনিয়মের উদাহরণ তৈরি করেছে।
এসব ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট করছে এবং একাডেমিক পরিবেশকেও চরমভাবে বিঘ্নিত করেছে।
রেজিস্ট্রারকেন্দ্রিক পক্ষটির স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের দায় কি বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজের কাঁধে নেবে, নাকি তার প্রতিকার করে নজিরবিহীন ‘ভাবমূর্তি’ তৈরি করবে? এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির অংশীদার হয়ে প্রত্যাশা করছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রথমত প্রভাবমুক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের দৈনন্দিন জীবনের সব পথচলাকে সাধারণ শিক্ষকদের জন্য নির্ভয় করবে। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অতীতের ভর্তি পরীক্ষা-সংক্রান্ত সব ধরনের জালিয়াতির প্রতিকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নজির স্থাপন করবে। অন্যায়ভাবে পদোন্নতিসহ সব বিলম্বিত পদোন্নতির সুরাহা করবে।
সাধারণ শিক্ষকদের ভয় ও উৎকণ্ঠা দূর করে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে, যাতে তাঁরা শিক্ষা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করতে পারেন।
পরিশেষে, প্রভাবশালী শিক্ষকদের হাতে যেন সাধারণ শিক্ষকদের মর্যাদাহানি না হয়, সেদিকে সুদৃষ্টি রাখবে। এ কথা হলফ করে বলা যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিপক্ষে। তাঁরা শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে নিজ ও জাতির উন্নয়নের পক্ষে। আমাদের দাবি, যাঁরা পড়াশোনা করতে চান, উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁদের তা করতে দেওয়া হোক। আর একজন শিক্ষককেও যেন উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য বিদেশে গমন, যোগ্যতা অর্জন সাপেক্ষে পদোন্নতি, অযাচিত শাস্তির আতঙ্ক এবং প্রভাবশালীদের সামনে আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার শঙ্কা নিয়ে দিনাতিপাত করতে না হয়।
লেখকবৃন্দ: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক।