ভাষার দূষণ ও শব্দদূষণ দুটিই অপরাধ
মানুষ হলো ‘হায়ওয়ানে নাতিক’ তথা বাক্শক্তিসম্পন্ন প্রাণী। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ কোরআন শেখানোর জন্য মানুষ সৃষ্টি করলেন এবং তাকে ভাষা বা বয়ান শেখালেন।’ (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত: ১-৪)। মানুষের ভাষা যেন মোলায়েম ও শ্রুতিমধুর হয় এবং কর্কশ ও শ্রুতিকটু না হয়, এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি সংযতভাবে পদক্ষেপ করো এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করো, নিশ্চয়ই গাধার স্বরই সবচেয়ে নিকৃষ্ট।’ (সুরা-৩১ লুকমান, আয়াত: ১৯)। ‘তোমরা উভয়ে ফেরাউনের নিকট যাও সে সীমা লঙ্ঘন করেছে। তোমরা তার সঙ্গে নম্র কথা বলো, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।’ (সুরা-২০ ত্বহা, আয়াত: ৪৩-৪৪)।
হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘প্রকৃত মুসলমান সে ব্যক্তি যার হাত ও জবান থেকে অন্যরা প্রশান্তি লাভ করে বা নিরাপদ থাকে ও নিরাপত্তা লাভ করে (মুসলিম)।’ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনিই মানবকে জীবন দিয়েছেন, মরণও তাঁরই ইচ্ছাধীন। তিনিই জীবন ও মৃত্যুর মালিক। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রাচুর্যময় তিনি (আল্লাহ) যাঁর হাতে রাজ্যক্ষমতা, তিনি সকল বস্তুর ওপর ক্ষমতাবান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে পরীক্ষা করবেন তোমাদের, কে তোমাদের কর্মে উত্তম। তিনি পরাক্রমশালী স্নেহশীল ক্ষমাময়।’ (সুরা-৬৭ মুলক, আয়াত: ১-২)।
ইসলামি বিধানসমূহের মৌলিক উদ্দেশ্য বা মাকাসিদুশ শরিয়াহ হলো জীবন সুরক্ষা, সম্পদ সুরক্ষা, জ্ঞানের সুরক্ষা, প্রজন্ম বা বংশধারার পবিত্রতা সুরক্ষা ও ধর্মের সুরক্ষা। মানুষ স্রষ্টা নয় এবং সৃষ্টির মালিকও নয়। মানুষ জীবন–মৃত্যুর মালিকও নয়। দুনিয়াতে আসা ও যাওয়া তার ইচ্ছাধীন নয়। তাই সে কারও জীবনাবসান বা প্রাণ সংহার করতে পারে না। মানুষের ক্ষতি হয় বা কষ্ট হয় এমন সব কাজকর্ম ইসলামে নিষিদ্ধ। এমন কোনো বিধান আল্লাহ দেননি, যা মানুষের জন্য কষ্টকর। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ মানুষকে তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৮৬)।’
‘আল্লাহ সহজ করতে চান, কঠিন করতে চান না; যাতে তোমরা তাঁর বিধান পূর্ণ করতে পারো এবং তিনি তোমাদের যে সরল পথ দেখিয়েছেন সে জন্য তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করো। আশা করা যায় তোমরা কৃতজ্ঞ হবে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৫)। মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো আল্লাহর দেওয়া জীবন, আল্লাহর দেওয়া সময় বা আয়ু, আল্লাহর দেওয়া সম্পদ, আল্লাহর দেওয়া মেধা, আল্লাহর দেওয়া সুযোগ ও সামর্থ্য আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় পরিচালনা, প্রয়োগ ও ব্যবহার করা বা পরিচালনা করা।
জিকির, তিলাওয়াত এবং ইবাদতের মাধ্যমেও কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। যেমন: ইবাদতকারীর ইবাদতে বিঘ্ন হয়, অসুস্থ ব্যক্তির অস্বস্তির কারণ হয় বা কারও ঘুমের ব্যাঘাত হয়, এমন অবস্থায় জিকির ও তিলাওয়াত নিম্ন স্বরে করতে হবে। আনন্দ–উল্লাস করে মানুষকে কষ্ট দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত অন্যায় এবং ইসলামি বিধানমতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তাতে তাদের জন্য বিধান দিয়েছিলাম প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং জখমের (আঘাতের) বদলে জখম (সুরা-৫ মায়িদাহ, আয়াত: ৪৫)।’
মানুষ হলো প্রথমত, আল্লাহর ভালোবাসার সৃষ্টি ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব। দ্বিতীয়ত, মানুষ হলো ‘আবদুল্লাহ’ তথা আল্লাহর বান্দা, দাস বা গোলাম; যে ইবাদত ও আনুগত্যের পরাকাষ্ঠায় সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর ইচ্ছা পূর্ণ করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘জিন ও ইনসানকে আমি আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি (সুরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ৫৬)।’ তৃতীয়ত, মানুষ হলো খলিফাতুল্লাহ বা আল্লাহর প্রতিনিধি। যে সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ করে, সৃষ্টির লালন ও সংরক্ষণে খোদা প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করবে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি দুনিয়াতে খলিফা বা প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ৩০)।’ চতুর্থত, মানুষ হলো ‘ওয়ালিয়ুল্লাহ’ বা আল্লাহর প্রিয় বন্ধু। উক্ত ‘আবদুল্লাহ’ ও খলিফাতুল্লাহ’–এর দায়িত্বসমূহ পালন করে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’–এর মর্যাদা সমুন্নত করতে পারলে মহান আল্লাহ তাআলা তাকে প্রিয় বন্ধুরূপে বরণ করে সম্মানিত করবেন। এই-ই হলো জীবনের সফলতা ও সার্থকতা।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম