মার্কিনরা শুধু নিজেদের স্বার্থেই কাজ করে

হেনরি কিসিঞ্জার চীন সফর শেষে দেশে ফেরার পর ১৩ জুলাই (১৯৭১) সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল কে ঝার বাসভবনে ফোন করেন। রাষ্ট্রদূত ঝা তখন বাসায় ছিলেন না, শহরের কোথাও একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। ফোনটি তুলেছিলেন তাঁর বাসার এক নিরাপত্তা প্রহরী। কিসিঞ্জার তাঁকে নিজের নাম বলে ও টেলিফোন নম্বর দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রদূত যেন তাঁকে ক্যালিফোর্নিয়ায় ফোন করেন। নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন আধা শিক্ষিত, ভারতীয় পুলিশের জুনিয়র পর্যায়ের কর্মকর্তা। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে রাষ্ট্রদূত ঝা যখন বাসায় ফেরেন, তখন সেই কর্তব্যপরায়ণ নিরাপত্তা প্রহরী তাঁকে বলেন যে, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কিষেণ সিং নামের এক ব্যক্তি ফোন করেছিলেন; তিনি একটা ফোন নম্বর দিয়েছেন, তিনি সেটা টুকে রেখেছেন, যেন রাষ্ট্রদূত বাসায় ফিরে ওই নম্বরে ফিরতি ফোন করতে পারেন।
ফোনটা কে করেছিল তা বুঝতে রাষ্ট্রদূত ঝার বেশি সময় লাগেনি। তিনি তক্ষুনি আমাকে তাঁর বাসায় যেতে বলেন। তিনি চাচ্ছিলেন, কিসিঞ্জারের সঙ্গে তিনি যখন কথা বলবেন, তখন যেন আমি তাঁর পাশে থাকি। আমি তাঁর বাসায় যাওয়ার পর কিষেণ সিংয়ের কাহিনি নিয়ে বেশ হাসাহাসি হলো। ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় রাত আটটার দিকে কিসিঞ্জারকে লাইনে পাওয়া গেল। দ্রুত শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর তিনি রাষ্ট্রদূত ঝাকে বললেন, তিনি যে ওই দিনই আরও আগের দিকে চীন সফর শেষে দেশে ফিরেছেন, এই আগাম সংবাদ তিনি যে চার-পাঁচজন রাষ্ট্রদূতকে জানাচ্ছেন, রাষ্ট্রদূত ঝা তাঁদের একজন। কিসিঞ্জার রাষ্ট্রদূত ঝাকে আরও বলেন, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পরের বছর চীন সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।
এ পর্যন্ত কথাবার্তা ভালোই চলল; রাষ্ট্রদূত ঝা কিসিঞ্জারের কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গতভাবে প্রশংসাসূচক কিছু বললেন।
কিন্তু তারপর কিসিঞ্জার একেবারেই নিষ্প্রয়োজনীয়ভাবে আরও যেসব কথা বললেন, কূটনৈতিক বাকরীতিতে তা হুমকি হিসেবেই গণ্য হবে। তিনি বললেন, ‘আমি আশা করি, ভারতীয় সরকার এ বিষয়ে (প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করা সম্পর্কে) প্রীতিকর কিছু বলবে। ভারতের দিক থেকে কোনো ধরনের সমালোচনা আমাদের ভালো লাগবে না; আমরা তা বুঝব না।’ তার পরেই লাইন কেটে গেল। কিসিঞ্জার যে চীন সফর করে এসেছেন, এটা তখনও সরকারিভাবে জানানো হয়নি; ১৫ জুলাই (১৯৭১) প্রেসিডেন্ট নিক্সন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় টেলিভিশনে সেটা জানান। তখন আমরা ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে নয়াদিল্লিতে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরণ সিংকে এ বিষয়ে একটি গোপনীয় সংক্ষিপ্ত টেলিগ্রাম বার্তা পাঠাই।
রাষ্ট্রদূত এল কে ঝার মধ্যে কিসিঞ্জারের কথাবার্তা ও আচরণ সর্বদাই ইতিবাচকভাবে ব্যাখ্যা করার একটা ঝোঁক ছিল। এ কারণে নয়াদিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাঁকে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখা হতো। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের প্রতি কিসিঞ্জারের দ্বিধাহীন সমর্থন, পূর্ব পাকিস্তানে নিরীহ বাঙালি নারী, পুরুষ ও শিশুদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে কিসিঞ্জারের নিষ্ঠুর উপেক্ষা কোনোরকমের ব্যাখ্যার দ্বারা উড়িয়ে দেওয়া দুরূহ ছিল। কিসিঞ্জার ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন উভয়ই ভারত ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ঘৃণা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতেন। প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করার ফলে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তাব্যবস্থায় যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি দেখা দেয়, সে ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জারের চরম উদাসীনতা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটা বড় সমস্যা হয়ে উঠছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় দূতাবাস নিক্সন প্রশাসনকে রাজি করার চেষ্টা করছিল, তারা যেন পূর্ব পাকিস্তানে সহিংসতা বন্ধ করতে, শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানি নাগরিকদের (বাঙালি) ভারতে প্রবেশ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করে। কিন্তু আমাদের সেসব প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হচ্ছিল না। তাই আমরা মার্কিন কংগ্রেস ও আমেরিকার জনগণকে এ বিষয়গুলো জানানোর উদ্যোগের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করি। আমেরিকান সংবাদমাধ্যম আমাদের বিষয়গুলো ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিল, তারা আমাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এক দিন পরপরই হয় রাষ্ট্রদূত ঝা, নয় আমি আমেরিকান জাতীয় টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলোতে কথা বলতাম; নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার কথা তুলে ধরতাম, ওই সব হত্যাযজ্ঞের কাজে তারা যে আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহার করছে, সে কথাও বলতাম।
ওয়াশিংটনে আমাদের দূতাবাসের কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমি বেশ কটি বড় শহর, প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে গিয়েছি। সেখানকার আগ্রহী শ্রোতাদের আমরা পূর্ব বাংলায় চলমান গণহত্যার কাহিনি শোনাতাম। চীনের ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালনের কারণে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ভূমিকা প্রশংসিত হলেও তাঁর দক্ষিণ এশীয় নীতির প্রতি আমেরিকার জনগণের সহানুভূতি ছিল না।
একদিন রাষ্ট্রদূত ঝা আমাকে বললেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের আন্ডার সেক্রেটারি জন আরউইন তাঁকে ডেকেছেন; তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, আমি যেন তখন তাঁর সঙ্গে থাকি। আরউইন ছিলেন হালকা-পাতলা ও নীরস প্রকৃতির, নিজের উচ্চ অবস্থান সম্পর্কে সচেতন, চট করে রেগে যেতেন। আমি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের (চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স) দায়িত্ব পালন করার সময় একবার তাঁর সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছিল; সংক্ষিপ্ত সেই বৈঠক ভালো হয়নি। তখন থেকে এই ভদ্রলোক সম্পর্কে আমার মনে অস্বস্তি ছিল। কিন্তু ঝা ও আরউইনের সম্পর্ক এমন ঘনিষ্ঠ ছিল যে তাঁরা পরস্পরকে ডাকতেন নামের প্রথম অংশ ধরে। বৈঠক শুরু হলো অত্যন্ত প্রীতিকরভাবে। ঝা আরউইনকে বললেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে এমন শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখে পেঁৗছেছে এবং আরও দলে দলে শরণার্থী ঢুকছে। পরিস্থিতি ভারতের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠছে। তাঁর সব কথার প্রতিই আরউইন সায় দিলেন, কিন্তু একধরনের অনিচ্ছার সঙ্গে। তিনি বললেন, ভারতের যুদ্ধপ্রস্তুতি গ্রহণের বিষয়টা ভালো হচ্ছে না; ভারত পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের জন্য বাঙালি গেরিলা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ও অস্ত্র জোগাচ্ছে—এটা আন্তর্জাতিক রীতিনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিশ মিনিটের ওই কথোপকথনে আরউইন পঞ্চম বারের মতো বলেন, দায়িত্বশীল শক্তি হিসেবে ভারতের চূড়ান্ত সংযম দেখানো উচিত।
রাষ্ট্রদূত ঝা আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে আমার মনে হলো, তিনি জানতে চাইছেন, আরউইনকে আমাদের আরও কিছু বলার বাকি আছে কি না। এই সুযোগে আমি আরউইনকে বললাম, ‘স্যার, ভারত সংযমই দেখাচ্ছে। তা সত্ত্বেও আপনি যে আরও সংযমের কথা বলছেন, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু ভালো হয়, যদি পাকিস্তান সরকার ও তাদের সেনাবাহিনীকেও সংযম দেখাতে বলা হয় এবং (পূর্ব বাংলার) নিরীহ জনসাধারণের ওপর হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার মধ্য দিয়ে ভারতে শরণার্থীর ঢল থামানোর উপদেশ দেওয়া হয়।’
আমার কথাগুলো বদমেজাজি ভদ্রলোককে ক্রুদ্ধ করে তুলল। তাঁর নাকের ছিদ্রদুটো ফুলে উঠল, ঘৃণাসূচক বিস্ময়ের ভাঁজ খেলে গেল কপালে; মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি মিস্টার আরইউন ক্রদ্ধ চোখে তাকালেন আমার দিকে নয়, বরং রাষ্ট্রদূত এল কে ঝার দিকে, এবং বললেন, ‘ইয়োর এক্সিলেন্সি, আমরা যা করছি তা আমাদের জাতীয় স্বার্থেই করছি, এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থেই আমরা আমাদের কাজ অব্যাহত রাখব। আমাদের কী করা উচিত আর কী উচিত নয়, এ ব্যাপারে কারও কোনো উপদেশের প্রয়োজন আমাদের নেই!’
আগামীকাল: নিক্সন-কিসিঞ্জার কিছুই কর্ণপাত করেন না
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
মহারাজাকৃষ্ণ রাসগোত্রা: ভারতের সাবেক কূটনীতিক।